সিলেটটুডে ডেস্ক

২৫ মে, ২০২০ ১৬:১৩

বাংলাদেশের করোনা যোদ্ধাদের জন্য চীনের নদীকর্মীদের উপহার

মার্চের শেষের দিকে বাংলাদেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে লক-ডাউন ঘোষণা করা হয় তখন নদী ও পানি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংগঠন ওয়াটারকিপার এলায়েন্সের চায়না অঞ্চলের কো-অর্ডিনেটর হাও জিং-এর সাথে কোভিট-১৯ সংকট নিয়ে ওয়াটারকিপার এলায়েন্সের বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর ও বুড়িগঙ্গা রিভার ওয়াটারকিপার শরীফ জামিল-এর কথা হয়। শরীফ জামিল এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে চায়নার বন্ধুদের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। হাও জিং নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ারের পাশাপাশি আর কিভাবে সাহায্য করতে পারেন- জানতে চাইলে, শরীফ জামিল স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দেয়ার অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশজুড়ে সে সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। স্বাস্থ্যকর্মী সহ জরুরী সেবাদানকারীদের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে সর্বমহলে চরম উৎকন্ঠা।

বাংলাদেশের নদী আন্দোলনের সংগঠক শরীফ জামিল-এর অনুরোধে চায়নার হাও জিং সাধ্যমত চেষ্টা করার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে তিনি ওয়াটারকিপার্স চায়না'র প্রতিনিধিদের সাথে মিলে বাংলাদেশের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে প্রদান করার উদ্যোগ নেন। সে উদ্যোগে এগিয়ে আসে কুয়ানতাং রিভার ওয়াটারকিপার, গ্রিনঝেজাং রিভার ওয়াটারকিপার ও চীনের কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। বাংলাদেশের জন্য তিন হাজার ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক, এক হাজার সুরক্ষা চশমা ও আঠার হাজার মাস্কের ব্যাবস্থা করা হয়। হাও জিং সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যাবস্থা করার কথা জানালেও সমস্যা দেখা দেয়- বাংলাদেশে সামগ্রীগুলো পাঠানো নিয়ে। নৌপথে পাঠানো সাশ্রয়ী হলেও সময় লাগবে অনেক। বিকল্প হচ্ছে আকাশপথ। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত ব্যায়বহুল। এই ব্যায় নির্বাহ করা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাছাড়া বাংলাদেশে এই উপহার সামগ্রী রিসিভ করতে হলেও আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতা মোকাবেলা করতে হবে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-চায়না ই-মেইল যোগাযোগ চলতে থাকে। এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত করা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-কে। শরীফ জামিল নিজেই বাপা'র সাধারণ সম্পাদক। তিনি বাপা'র অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করেন। যোগাযোগ করা হয়- বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে (আই ই ডি সি আর)-এর পরিচালক ডঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা-র সাথে। তিনি সুরক্ষা সামগ্রীর চালানটি রিসিভ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সহায়তায় সর্বাত্মক সহযোগীতার আশ্বাস প্রদান করেন। ওয়াটারকিপার্স চায়না, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, বাপা ও আই ই ডি সি আর-এর মধ্যে কো-অর্ডিনেশন করতে থাকেন শরীফ জামিল। সরকারী বিভিন্ন অনুমোদন নেয়ার কাজ চলতে থাকে।

এদিকে বাংলাদেশে সুরক্ষা সামগ্রীর চালান রিসিভের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও আকাশপথের ব্যায় নির্বাহের কোন ব্যাবস্থা তখনো করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে যুক্তরাস্টের সাভানা রিভার ওয়াটারকিপার তনয়া বানিতাতিবাস (Tonya Bonitatibus) সহযোগিতার হাত বাড়ান। তিনি নীজ উদ্যোগে কিছু ফান্ড কালেকশন করেন। পাশাপাশি চায়নার আরও কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানো এগিয়ে আসে। অবশেষে ৮৫টি কার্টুনের বিশাল চালানটি ১৩ মে বাংলাদেশে এসে পৌঁছে।

চালানটি বাংলাদেশে পাঠানোর পুর্বে হাংঝু ঝেজাং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রিভার এঞ্জেল খ্যাত শিশু কিশোরগণ উপহারের প্রায় ৮৫ কার্টন সামগ্রীতে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ভালবাসার স্বারক হিসাবে চিত্রাঙ্কন করে দুই দেশের জাতীয় পতাকা ও 'বেঙ্গল টাইগারের জন্য পান্ডার উপহার' শীর্ষক চিত্র। শিক্ষার্থীরা এই কার্টনগুলো নিজেরা বহন করে সাংহাই বিমানবন্দরের নির্ধারিত এয়ারকার্গোতে উঠিয়ে দেয়।

অবশেষে ১৩ মে বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে (আই ই ডি সি আর)-এর মাধ্যমে শুভেচ্ছা উপহার সামগ্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গ্রহণ করা হয়। যদিও দেশে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট অনেক কমেছে কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মী সহ জরুরী সেবাদানের সাথে জড়িত সরকারী ও বেসরকারী অনেক ব্যাক্তির কাছে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর বড় অংশ বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে (আইইডিসিআর) ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে বাপা ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে পৌঁছে দেয়া হয়।

ওয়াটারকিপার্স চায়না'র বন্ধুদের পাঠানো এই শুভেচ্ছা উপহার সামগ্রীর কিছু অংশ বাংলাদেশের চারটি রিভার ওয়াটারকিপার যথাক্রমে ঢাকার বুড়িগঙ্গা রিভার ওয়াটারকিপার, হবিগঞ্জের খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার, খুলনার পশুর রিভার ওয়াটারকিপার ও সিলেট-এর সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার'কে  দেয়া হয়। যা থেকে স্থানীয় প্রয়োজন বিবেচনা করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরী সেবাদানের সাথে জড়িত সরকারী-বেসরকারী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়েছে।

গত ১৬ মে সিলেট ও হবিগঞ্জে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী এসে পৌঁছালে ঐ দিনই 'কলের গাড়ী' খ্যাত সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীদের জরুরী খাদ্য সহায়তার মানবিক উদ্যোগে জড়িত স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য ৫০টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), দশটি সুরক্ষা চশমা ও দেড় শত মাস্ক হস্তান্তর করা হয়। যা গ্রহণ করেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট-এর সভাপতি মিশফাক আহমেদ মিশু ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেট-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম লিটন। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা-সিলেট শাখারt সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।

১৭ মে হবিগঞ্জের জন্য প্রেরিত 'ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী' হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ মুখলিসুর রহমান উজ্জল এর কাছে ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী হস্তান্তর করেন খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল। এসময় উপস্থিত ছিলেন ডাঃ ওমর ফারুক ও পরিবেশ কর্মী ডাঃ আলী আহসান চৌধুরী পিন্টু।

১৭ মে সিলেটে পরিবেশ ও প্রাণীপ্রেমিদের একটি বেসরকারী উদ্যোগে পনেরোটি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ৮টি সুরক্ষা চশমা ও ৫০টি মাস্ক হস্তান্তর করা হয়। এই উদ্যোগ থেকে সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন খাদ্য সংকটে থাকা বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়াল খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়।

উল্লেখ্য যে, বাপা সিলেট লক ডাউন শুরুর সপ্তাহান্তে চাষনীপীর মাজারের অভুক্ত বানরদের ও নগরীর বেওয়ারিশ কুকুরদের খাবার দিয়ে এই উদ্যোগের সুচনা করে এবং বিভিন্ন মহলের প্রতি আহ্বান জানায়- এদের সহায়তা দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে ভূমিসন্তান বাংলাদেশ ও এনিম্যাল লাভার্স অব সিলেট (এ এল এস) সহ আরো কিছু সংগঠন ও ব্যাক্তি সড়কে থাকা বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালদের জন্য নিয়মিত খাবার প্রদানের উদ্যোগ নেয়। যা বর্তমানে পরিবেশকর্মী ও প্রাণীপ্রেমিদের একটি সমন্বিত উদ্যোগ হিসাবে চলমান রয়েছে। প্রতিদিন এই কার্যক্রমে ১৫ কেজি চাল ও বয়লার মোরগের প্রায় সাত-আট কেজি ঘিলা-কলজার খিচুড়ি রান্না করা হয়। কোনরুপ ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক ছাড়াই আটটি টিম প্রতিদিন রাতে মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় দুই শতাধিক কুকুরকে খাবার পৌঁছে দেয়। এই উদ্যোগের পক্ষ্যে সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন ওয়াজি আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অরুপ শ্যাম বাপ্পী, আশরাফুল কবির, বিমান তালুকদার প্রমুখ। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।

১৮ মে সিলেটে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে ব্যাবহৃত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতাল-এ ১০০টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ১০টি সুরক্ষা চশমা প্রদান করা হয়। সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাঃ জন্মজয় দত্ত। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।

১৯ মে সিলেটে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে ব্যাবহৃত ৩১শয্যাবিশিষ্ট খাদিমপাড়া শাহপরান হাসপাতালে ৫০টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ১০টি সুরক্ষা চশমা প্রদান করা হয়। সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন হাসপাতা্ল সুপার ডাঃ জালাল আহমেদ। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।

১৯ মে সিলেটের বিভিন্ন স্থল বন্দরে জরুরী পণ্য আমদানী-রফতানী কাজে কর্তব্যরত শুল্ক কর্মকর্তাদের জন্য ২৫টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ৮টি সুরক্ষা চশমা ও ১০০টি মাস্ক প্রদান করা হয়। সিলেট কাস্টম, এক্সাইগ ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ে অতিরিক্ত কমিশনার জনাব মোহাম্মদ স্ফিউর রহমান সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।

২২শ মে সিলেটে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মিডলেভেল ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশনকে  ২৫টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ৫টি সুরক্ষা চশমা ও দুই শত সার্জিক্যাল মাস্ক প্রদান করা হয়। সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন নিউরো মেডিসিন বিভাগের রেজিস্টার ডাঃ সৈয়দ আব্দুল্লাহ বুরহান ও  সার্জারী বিভাগের রেজিষ্টার ডাঃ মোঃ আদনান চৌধুরী। সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ও পরিবেশকর্মী ওয়াজী আহমেদ।  

২২শে মে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে স্থাপিত করোনা পরীক্ষা ল্যাবে ১৫টি ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই), ৫টি সুরক্ষা চশমা, ১০০টি মাস্ক  প্রদান করা হয়। সামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক প্রধান । সামগ্রীগুলো হস্তান্তর করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও বাপা, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ও পরিবেশকর্মী ওয়াজিহ আহমেদ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত