সিলেটটুডে ডেস্ক

২৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:৪৯

বাংলাদেশের রূপান্তরে বদলে যাচ্ছে মেঘালয়ের ডাউকি

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড় এলাকার সীমান্তবর্তী শহর ডাউকি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অঞ্চলটি সম্প্রতি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আদিবাসী খাসিয়ারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। দুই দশক আগেও এখানকার স্থানীয়রা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। তবে বর্তমানে সেই দারিদ্র্য দূর হয়ে অনেকটাই সচ্ছল হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা শহর ডাউকির অবকাঠামোগত চেহারাও বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী কুঁড়েঘরগুলোর জায়গায় গড়ে উঠছে একের পর এক অট্টালিকা।

খাসিয়াদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে স্থানীয় প্রযুক্তিতে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন ও রপ্তানি। গত দুই দশকে মেঘালয়ের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। একের পর এক মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সরকার। কয়েকটি এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। কাজ শেষের পথে রয়েছে আরও কয়েকটি। সামনের দিনগুলোয় এমন আরও কিছু মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর বাইরেও জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নির্মাণ হচ্ছে সড়ক ও যোগাযোগসহ আরও অনেক অবকাঠামো। এর পাশাপাশি বড় হচ্ছে আবাসন নির্মাণ খাতও। এ উন্নয়ন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পাথরের, বিশেষ করে লাইমস্টোন বা চুনাপাথরের চাহিদা বেড়েছে অনেক। নির্মাণ খাতের কাঁচামাল সিমেন্ট বা কংক্রিটের উৎপাদনে হোক বা সড়কের ভিত্তি তৈরির জন্য হোক; উন্নতমানের পাথর ও চুনাপাথরের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। আর এ চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিকটবর্তী ও সুলভ উৎস হয়ে উঠেছে ভারতের মেঘালয়। বিশেষ করে শিলং ও ডাউকিতে এখন প্রচুর পাথর আহরণ করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ডাউকি-তামাবিল স্থলবন্দর হয়ে।

বর্তমানে রাজ্যের রাজধানী শিলংকে ছাড়িয়ে মেঘালয়ের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক পাথর বাণিজ্যে সরবরাহ চেইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে ডাউকি। শুধু সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর নয়, রপ্তানিকৃত পাথরের উৎস হিসেবেও। সরবরাহ চেইনটিও বেশ সরল। জৈন্তিয়া পাহাড় এলাকায় পাথরসমৃদ্ধ জমির মালিকরা নিজ নিজ মালিকানাধীন ভূমি থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরণ করছেন। যাদের জমি নেই তারা পাথর সংগ্রহ করছেন ডাউকি নদী (স্থানীয়ভাবে উমংগট বা আমগট হিসেবে পরিচিত) থেকে। এরপর বিভিন্ন রফতানি পয়েন্ট দিয়ে তা এসে জড়ো হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। এজন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতিও মেলে খুব সহজেই। জটিলতামুক্ত এ উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যবস্থাই এখন হয়ে উঠেছে ডাউকির খাসিয়াদের জীবন-জীবিকার বড় উৎস।

তবে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কও রয়েছে অনেক। পরিবেশবাদী সংগঠন ও কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই এ পাথর উত্তোলনের বিরোধিতা করে এসেছেন। অন্যদিকে মেঘালয়ের রাজ্য সরকারও কঠোর নিয়মকানুনের ভিত্তিতে পাথর উত্তোলন কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক রুলের ভিত্তিতে খাসিয়াসহ স্থানীয় আদিবাসীদের সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। তবে এটুকু সুযোগকেই তারা বেশ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। পাথর বাণিজ্য শুধু তাদের দরিদ্রতাই দূর করেনি, একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী করে তুলেছে। কয়েক বছর আগে রাজ্য সরকারের এক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডাউকির খাসিয়ারাসহ মেঘালয়ের পাথর উত্তোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের পাথর রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল তারা। আবার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নানা সিদ্ধান্ত নিয়েও অভিযোগ ছিল তাদের। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেও তাদের এ ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।

এক সময় ডাউকি-তামাবিল দিয়ে বাংলাদেশে আসা পণ্যের অধিকাংশই ছিল মেঘালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আহরিত কয়লা। তবে ২০১৪ সালে রাজ্যটিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তের দুই পারে ডাউকি-তামাবিল শুল্ক স্টেশনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম কিছুদিনের জন্য ঝিমিয়ে পড়ে। তবে অচিরেই তা আবার চাঙ্গা করে তোলে চুনাপাথর বাণিজ্য। এ বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সরকারই নিজ নিজ সীমান্তে গড়ে তোলে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ডাউকি-তামাবিল দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের গড়ে প্রায় ৯৮ শতাংশই পাথর ও চুনাপাথর। তামাবিল পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে যাত্রা করে ২০১৭ সালে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাবিল দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৮২ হাজার ৪৬৪ টন। কোভিডের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮০ হাজার ২১২ টনে।

ডাউকির পাথর বাণিজ্যে এখন স্থানীয় খাসিয়াদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলেও এর বিকাশ হয়েছিল মূলত বহিরাগতদের মাধ্যমে। চুনাপাথরসহ নানা ধরনের খনিজ পাথরের প্রাচুর্যের জন্য মেঘালয় অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত। রাজ্যটির মোট চুনাপাথর মজুদের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশই রয়েছে জৈন্তিয়া পাহাড় এলাকায়। খাসিয়া পাহাড় এলাকায় রয়েছে ৩৮ শতাংশ। এ অঞ্চলে চুনাপাথর বাণিজ্য বিকশিত হয়েছে মূলত বহিরাগতদের হাতে। ১৯০৬ সালের আসাম জেলা গেজেটিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতকের দিকেও এখানে চুনাপাথর আহরণ ও বাণিজ্য চালু ছিল। এখানকার চুনাপাথরকে কেন্দ্র করে সিলেট, জৈন্তিয়া পাহাড় ও খাসিয়া পাহাড় অঞ্চলের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক হাবও গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকেও এ আহরণ ও বাণিজ্যের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শুধু চুন তৈরি করা। নৌপথে সিলেট পর্যন্ত পণ্যটি পরিবহনেরও সুবিধা ছিল অনেক। পরে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এখানকার চুনাপাথর ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। একপর্যায়ে তারা এর নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়।

দেশভাগের পর অঞ্চলটির চুনাপাথরের প্রাচুর্যকে কাজে লাগিয়ে এখানে সরকারিভাবে একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়। পরে এখানে লাফার্জ ইউমিয়াম মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় এলাকায় বৃহদায়তনে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য এ পাথর উত্তোলন করা হয়। ২০০৬ সালে শুরুর এক বছরের মাথায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পরিবেশ-সংক্রান্ত এক রুলিংয়ে এ উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে তা ২০১১ সালে আবার শুরু হয়।

অতীতে বহিরাগতরা স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বড় হলেও খাসিয়াদের তাতে লাভ হয়েছিল খুব সামান্য। মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী খাসিয়াদের জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছিল মূলত কৃষি ও বনজ সম্পদ আহরণকে কেন্দ্র করে। বন উজাড়ের কারণে একসময় তাদের অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয় দিনমজুরিকে। পুরনো পেশা আঁকড়ে ধরে যারা টিকে ছিল, তাদের জন্য পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলেছিল ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক রায়।

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ঘোষিত ওই রায়ে মেঘালয়ের বন থেকে কাঠসহ অন্যান্য বনজ সম্পদ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর আগ পর্যন্ত সম্পদ আহরণে খাসিয়াদের সনাতনী টেকসই পদ্ধতি বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। এ কারণে খাসিয়াদের কেউ বন উজাড়ে দায়ী না করলেও প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘোষিত ওই রায় তাদের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দরিদ্র খাসিয়ারা আরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে রূপ নেয়। তাদের এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হয়ে ওঠে পাথর আহরণ। এর আগ পর্যন্ত আদিবাসী খাসিয়াদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন এ পাথর আহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল। গত কয়েক দশকে এ সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে।

এর মধ্যেই প্রতিবেশী বাংলাদেশেও ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে আহরিত পাথরের চাহিদাও বেড়ে যায় ব্যাপক মাত্রায়। বাণিজ্যিক এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দিনবদল করতে সক্ষম হয়েছে ডাউকির স্থানীয় বাসিন্দারা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত