সিলেটটুডে ডেস্ক

১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ২৩:২৩

‘শহীদ রাজীবের সাথে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে’

গণজাগরণ আন্দোলনে শহীদ জাফর মুন্সি এবং রাজীব হায়দার শোভন স্মরণে সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকালে শাহবাগে সমাবেশ ও আলোক প্রজ্বলন করা হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ চত্বরে শুরু হয় গণ-আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লঘু দণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে তরুণ প্রজন্মসহ সর্বস্তরের মানুষ। আন্দোলনের ১০ দিনের মাথায় যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-শিবিরের হামলায় নিহত হন মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের লিফটম্যান জাফর মুন্সী। ১৩ ফেব্রুয়ারি অগ্রণী ব্যাংক ভবনে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সংবলিত ব্যানার ছিঁড়তে গেলে জামাত-শিবিরের কর্মীদের বাধা দেন জাফর মুন্সী, যিনি এর আগে গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। তখন জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জাফর মুন্সী।

এর ঠিক একদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি, শাহবাগ থেকে মিরপুরে নিজ বাসায় ফেরার পথে ঘাতকেরা নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার ও স্থপতি আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে।

স্মরণ সমাবেশে রাজীব হায়দারের পিতা ডাক্তার নাজিম উদ্দিন বলেন, "সন্তানহারা পিতামাতার কষ্ট অনেক বেশি। বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁদের কাছে বেশি সহজ। যে আদর্শের জন্য রাজীব প্রাণ দিয়েছে সেই আদর্শ থেকে তার সহযোদ্ধারা বিচ্যুত না হয়, গণজাগরণ মঞ্চের কাছে এই আমার প্রত্যাশা”।

বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. নাজিমউদ্দিন বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়েছিলো, সারা দেশের মানুষ, দেশের বাইরের মানুষ তাদের সমর্থন দিয়েছিলো। সেই বিচার আজ খুব ধীর গতিতে চলছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে গিয়ে যারা খুন হয়েছে, তাদের বিচার আজ আরও বেশি ধীরগতিতে চলছে”।

রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় সম্পর্কে তিনি বলেন, “গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের মধ্যে শুধু রাজীবের হত্যার বিচারই হয়েছে। এই বিচার করতে সময় লেগেছে তিন বছর। তিন বছর পর যে বিচার আমরা পেয়েছি, সে বিচার আমার কাছে প্রহসনের বিচার মনে হয়েছে। যে সাতজন খুনি সরাসরি রাজীবকে হত্যায় জড়িত ছিলো, তাদের মধ্যে মাত্র দুইজনের ফাঁসির রায় হয়েছে। কারো দুই বছর, কারো তিন বছর, কারো পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে, অথচ সবাই রাজীবের হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল”।

রাজীব হত্যা মামলার প্রধান আসামী রেদোয়ানুল আজাদ রানাকে গ্রেফতারে প্রশাসনের ব্যর্থতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই রানা রাজীব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডে সে জড়িত ছিল, অথচ এখনো তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। যতদিন রাজীব হত্যাকাণ্ডের মূল আসামী শিবির নেতা  রানাকে গ্রেফতার করে তার স্বীকারোক্তি আদায় করা না যাবে, ততদিন কোনো ব্লগার-লেখক হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার করা সম্ভব হবে না”।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচার সুষ্ঠু হচ্ছেনা অভিযোগ করে সমাবেশে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, আজ বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠু হচ্ছে কিনা সেই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। কদিন আগেই আমরা দেখেছি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে প্রসিকিউশন টিম গঠিত হয়েছে তার চীফ প্রসিকিউটর একজন আইনজীবীর অব্যাহতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন, যে আইনজীবী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করছিলেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, সর্ষের ভেতরেই ভূত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য এ দেশের জনগণের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল।

তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করি, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এবং এই বিচার চাইতে গিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে যেসব তরুণ শহীদ হয়েছেন, তাদের হত্যাকারীদের বিচার সুষ্ঠু প্রক্রিয়াতে সম্পন্ন হবে, যাতে করে আমাদের আর কোনো আন্দোলনে যেতে না হয়। নতুবা জনতার আদালত থেকে কেউ ছাড় পাবেন না এবং এর সমস্ত দায়দায়িত্ব বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পর্কিতদেরই নিতে হবে।

ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শহীদ রাজীব হায়দারের সাথেই বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে মন্তব্য করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “রাজীব হায়দার এবং জাফর মুন্সীর হত্যাকাণ্ডের তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই তিন বছরে আমাদের আরো অনেক সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৫ সালেই আমাদের ৫ জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশব্যাপী অন্তত বিশজন সহযোদ্ধাকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যে রাজীব হায়দার শোভন ন্যায়বিচারের দাবিতে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে, প্ল্যাকার্ড লিখেছে, আমি মনে করি বিচারের নামে তার সাথে সবচেয়ে বড় প্রহসন হয়েছে”।

তিনি আরও বলেন, “যে সাতজন খুনি নিজেরা স্বীকার করেছে, বর্ণনা করেছে কিভাবে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের দেয়া হয়েছে লঘুদণ্ড। আমরা আশঙ্কা করছি, প্রভাবশালী মহলের ইশারায় বিচার বিভাগ এই ন্যক্কারজনক রায় দিয়েছে। রাজীব হায়দারের সাথে যে অবিচার হয়েছে সেটি এদেশের শাসকগোষ্ঠীর একটি ঐতিহাসিক ভুল কেননা রাজীব হায়দারসহ যে বিশজনের অধিক সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে তাঁরা কেউই কোনো ব্যক্তিগত দাবি নিয়ে রাজপথে আসেন নি। তাঁরা দেশকে কলংকমুক্ত করার দাবি নিয়ে এসেছিলেন। অথচ তাঁদের সাথেই বিচারের নামে প্রহসন করা হলো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর জবাব শাসকগোষ্ঠীকে দিতে হবে”।

ইমরান বলেন, “আমরা দেখেছি, কিভাবে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভেতরে থেকেই একজন প্রসিকিউটর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কলকাঠি নেড়েছেন। আমরা দেখেছি, এখনো সরকারি সুযোগসুবিধা নেয়া একজন বিচারপতি কিভাবে অবসরে গিয়েই স্বাধীনতাবিরোধিদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন, তিনি বিত্তবান যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর পক্ষে মামলায় দাঁড়িয়েছেন। কাজেই এই বিচারবিভাগ রাজীব হায়দার শোভনদের হত্যার কেমন বিচার করবেন তা সহজেই বোধগম্য, এই বিচারকেরাই রাজীবের হত্যাকারীকে তিনবছরের, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জসিমউদ্দিন রাহমানিকে পাঁচ বছর কারাদণ্ডের হাস্যকর রায় দিয়েছেন”।

জঙ্গিবাদ দমনে সরকার দ্বিমুখী আচরণ করছে অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, “একদিকে জঙ্গিবাদ দমনে জিরো টলারেন্সের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, অন্যদিকে তারা ব্লগার হত্যার খুনিদের ধরতে, সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গড়িমসি করেন। আমি তাদের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করুন”।

শহীদ সহযোদ্ধাদের আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

এরপর গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক মুষ্টিবদ্ধ হাতের ফুলেল প্রতিকৃতিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন মঞ্চের কর্মীরা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত