নিউজ ডেস্ক

০৫ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:১১

নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ, বাড়ছে গণধর্ষণও

নারী নির্যাতনের হার ও বীভৎসতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। একটি হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে ১৬৯ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি।

নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ 

আরও কয়েকটি সংস্থার নিজস্ব পরিসংখ্যানও নারী নির্যাতন পরিস্থিতির অবনতির চিত্র দিচ্ছে। পুলিশের মামলার হিসাবও বলছে, নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। নারী আন্দোলনকর্মী, মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিনিয়তই এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের এক জরিপে জানা যায়, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ব্রাকের নিজস্ব কর্মীদের মাধ্যমে ৫৫টি জেলায় সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ব্র্যাকের তথ্য মতে, নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। নথিভুক্ত হলে সংখ্যাটি আরও বাড়ত।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পরিচালক আন্না মিন্স বলেন, সাধারণ যে পরিবারের মেয়েরা নির্যাতনে শিকার হন তারা আইনি সেবা নিতে উৎসাহ দেখান না। বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই মাত্র এক-চতুর্থাংশ মামলা হয়। আইনি দীর্ঘসূত্রতাসহ অর্থ সংকটের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিতের পরিবার আসামিপক্ষের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে বা সামাজিক উপায়ে আপস করে ফেলেন।

বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২২০। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়েবসাইটেও গুরুত্বপূর্ণ মামলার তালিকায় ‘নারী নিপীড়ন’ শিরোনামে ১০০ মামলার কথা উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন-সংস্থা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নারী নির্যাতনের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ বছর দুই মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ হাজার ৬৫৬ নারী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ি, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে।

রক্ষা পাচ্ছে না শিশুরাও

পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। শিশুদের নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ঠিক পরের বছর ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২১; যা ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় আড়াইগুণ বেশি।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ৬৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে পাঁচজন গণধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় দুই শিশুকে। এছাড়া সংগঠনটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ৮৬ শিশু, ২০১৩ সালে ১৭০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ২২০ নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচজন ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু চিকিৎসার জন্য আসছেন।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ঢাকার মতো শহরে যেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেখানে গ্রামে কিংবা নিভৃত পল্লীতে এর প্রবণতা আরও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তবে যে পরিমাণ নারী ধর্ষণের শিকার হয় সেই পরিমাণ অভিযোগ হয় না।

মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, খবরের কাগজে যা দেখা যায়, ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা তার চেয়েও বেশি। অপরাধীরা মনে করে ভিকটিম থানায় মামলা করবে না। এজন্য ধর্ষণের প্রবণতাও বাড়ছে। গণধর্ষণ বেড়েছে ১৪ ভাগ ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫-তে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে ২৩ শতাংশ। শুধু ধর্ষণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। গত বছর প্রতিদিন গড়ে দুজনের বেশি নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

গণধর্ষণ বেড়েছে ১৪ শতাংশ

তবে ২০১৬ সালে এখন পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে আগের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক কলহ, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র নারীর প্রতি নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুরা সঠিকভাবে বিচার পাচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় পুলিশি সহায়তা না পাওয়ায় ভিকটিমরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ২৯ মার্চ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নারী নির্যাতন পরিস্থিতি আলোচনায় স্থান পায়। আলোচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুততার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইন ও বিচার বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করার কাজে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়। এ মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ সেলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তনু হত্যাসহ নয়টি মামলা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

হেল্পলাইন ১০৯২১

নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর নির্যাতনের তথ্য জানাতে ডায়াল করতে হবে হেল্পলাইন ১০৯২১। এটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি টোল-ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর। এ লাইন ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর ২০১২ সালের ১৯ জুন জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার এ সেবা চালু করেছে। এছাড়াও আটটি বিভাগীয় শহরে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৬০টি ওসিসি সেলসহ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সূত্র: যুগান্তর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত