সিলেটটুডে ডেস্ক

০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৩:১৮

‘সেলিম টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলে যে, উনি ইসলামবিরোধী, একে হত্যা করতে হবে’

শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিন জনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আনসার আল ইসলামের সদস্য আব্দুর সবুর ওরফে সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ ৬ দিনের রিমান্ডের মধ্যেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

টুটুল ও দীপনকে একই দিনে একই গ্রুপ হত্যার পরিকল্পনা করলেও হামলার পরও প্রাণে বেঁচে যান টুটুল। সাদ জানায় সে টুটুলকে মারার মিশনে গিয়েছিল দীপনকে হত্যার সময় উপস্থিত ছিল না। তবে তাদেরই অন্য দল একই সময়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে।


জবানবন্দিতেই সে বলে, তাদের নির্দেশদাতার নাম হচ্ছে সেলিম। আর এই সেলিমের হাতেই খুন হন ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। সাদের ভাষ্য, ‘সেলিম টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলে যে, উনি ইসলামবিরোধী, একে হত্যা করতে হবে।’

জবানবন্দিতে যা বলেছে সবুর ওরফে সাদ:

বৃহস্পতিবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সবুর ওরফে সাদ জানিয়েছে, তার বাবার নাম মাওলানা ইদ্রিস পাটোয়ারী। মায়ের নাম তাহেরা বেগম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাঙ্গলকোট থানাধীন ঢালুয়া ইউনিয়নের জাপানন্দী এলাকায়। সবুর ওরফে সাদের ভাষ্য, সে ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে আইটপাড়া আজিজিয়া কওমী মাদ্রাসায় নূরানী পড়তো। এরপর শিংগিড়িয়া ফয়জুল উলম ইসলামীয়া মাদ্রাসায় ৩০ পাড়া কোরআন হেফজ পড়ে। এরপর নারায়ণগঞ্জ দেওভোগ কওমী মাদ্রাসায় ৪ বছর পড়াশুনা করে। পরবর্তীতে ঢাকার গেণ্ডারিয়া ফরিদাবাদের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। ২০১৩ ও ১৪ সালে সে মিসকাত ও দাওরা পড়া সম্পন্ন করে।

জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গে সবুর ওরফে সাদ আদালতে বলেছে, ২০১৩ সালের শেষের দিকে ফরিদাবাদ মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে আসরের নামাজ শেষে একজন লোক তার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। সাদ তার নাম জিজ্ঞাসা করলে ওই লোক নিজের নাম ইসতিয়াক বলে পরিচয় দেয়। এসময় ইসতিয়াক একটি ফার্মে চাকরি করে নিজের পরিচয় দেয়। এর ২/৩ সপ্তাহ পর সে আবার ঐ মসজিদে আসে। সে তাকে প্রথমে পড়ালেখা ভালোভাবে করার উপদেশ দেন। এর এক দেড় মাস পর ইসতিয়াক আবার তাকে ব্লু-টুথের মাধ্যমে মোবাইলে অডিও বয়ান দেয়। এসব বয়ান ছিলো জসিমউদ্দিন রাহমানীর। এর কিছুদিন পর ইসতিয়াক তাকে জিজ্ঞাসা করে যে সে বয়ানগুলি শুনেছে কি না? সাদ তাকে শোনার কথা বলে।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সবুর ওরফে সাদ বলে,‘ইসতিয়াক আমাকে বলে ইসলামের জন্য জিহাদ করবো কিনা। আমি বললাম করবো। এরপর ইসতিয়াকের সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হতো। পরে একদিন ইসতিয়াক আমাকে ফোন দিয়ে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে যেতে বলে। আমি পরদিন ১টার দিকে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে যাই। ইসতিয়াক আমাকে নিয়ে কাছেই একটি বাসায় যায়। সেখানে ইসতিয়াক আমাকে সেলিম, সাব্বির, আরিফ, সাইফুলদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।ইসতিয়াক সবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। জিহাদের বিষয়ে আলোচনা করে। সেখানে তিন ঘণ্টার মতো ছিলাম। আমাকে প্রটেক্টেড টেক্সট ডটকমে এ পিটি আইডি খুলে দেয়। আইডি নেম ও পাসওয়ার্ড কাগজে লিখে দেয়। আমি ঐ আইডির মাধ্যমে চ্যাট করতাম। চ্যাটের মাধ্যমে ইসতিয়াক ও সেলিম যাত্রাবাড়ী এলাকায় দুই রুমের একটি বাসা খুঁজতে বলে। দুইদিন খুঁজেও বাসা পাইনি। পরে সেলিম বলে যে বাসা খোঁজা লাগবে না। বাসা পাওয়া গেছে।

সাদ স্বীকারোক্তিতে জানায়, ‘‘জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে আমাকে যাত্রাবাড়ী যেতে বলে। আমি ১ তারিখে জুম্মার নামাজ শেষে যাত্রাবাড়ী যাই। সাব্বির আমাকে নিয়ে মাহমুদ হাসানের মাদ্রাসার পূব পাশের রসুলপুর এলাকার চতুর্থ তলা বিল্ডিং এর ৩য় তলায় একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমি, সাব্বির, মাসফি, আসাদ তিন মাস থাকি। সেখানে আমাদেরকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে বাসা ভাড়া নেওয়ার কৌশল শেখায়। সেলিম চাপাতি ও ৯ এমএম পিস্তল বানানো ও চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়। সে ২/৩ দিন পর পর এসে ট্রেনিং দিত। একদিন এশার নামাজের আগে সেলিম বলে ‘একটা কাজ হবে দোয়া করো যাই।২/৩ ঘণ্টা পর বলে কাজ হয়েছে।’ পরে শুনি অভিজিৎ খুন হয়েছে।’’

১৬৪ ধরায় দেওয়া জবানবন্দিতে সাদ আরও বলে, ‘এটা ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। তিন মাস ট্রেনিং-এর পর আমি ফরিদাবাদ মাদ্রাসার পাশের একটি মেসে উঠি। অন্যরা চলে যায়। ঐ মেসে ২ মাস থাকি। একদিন সেলিম ফোন করে দক্ষিণ খান দেওয়ান বাড়ী যেতে বলে। আমি সেখানে গেলে শরিফুল আমাকে নিয়ে দক্ষিণখানের একটি দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। সেখানে সেলিমের সঙ্গে আমি সপ্তাহ খানেক থাকি। এরপর আমাকে আব্দুল্লাহপুর মাস্টারপাড়ায় আরেকটি দ্বিতল ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। সেখানে আমি, সিফাত ও শরিফুল তিন মাস থাকি। মাঝে মধ্যে দক্ষিণখানে সেলিম ভাইয়ের বাসায় যেতাম। এরপর টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকার আরেকটি দোতলা ভবনের নীচতলায় আমি, সিফাত ও শরিফুল উঠি।ঐ বাসার কাছেই টঙ্গীর কলেজ গেইট বর্ণমালা রোডের ৪ তলা বিল্ডিংয়ের নীচতলার একটি বাসায় আনছার আল ইসলামের মারকাজ ছিল। শরীফুল সেখানে ট্রেনিং করাতো। শরীফুল বাসায় গেলে সেলিম আমাকে ট্রেনিং করানোর কথা বলে। আমি তখন আকাশ, আলম, সিহাব, তৈয়ব, রায়হান, রাফিদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। সেলিম ২/৩ দিন পরপর আসতো।’

টুটুল ও দীপন হত্যার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সাদ আদালতকে বলে, ‘এক মাস ট্রেনিংয়ের পর আমাদেরকে দুই ভাগ করা করা হয়। সিফাত, আকাশ, তৈয়ব, আলমকে মহাখালী পাঠায়। এদেরকে প্রকাশক দীপন হত্যার জন্য পাঠায়। সিহাব, সাব্বির, তাহসিন, বাবর, ইয়াহিয়াকে এক মাস ট্রেনিং দিয়ে আমাকে প্রধান করে প্রকাশক টুটুল হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেলিম ভাই ও ইসতিয়াক ভাই টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলে যে, উনি ইসলামবিরোধী, একে হত্যা করতে হবে। আমার টিম নিয়ে আমি লালমাটিয়া শুদ্ধস্বরের অফিসের এলাকায় দুই দিন গিয়ে রেকি করি। আমি সঠিকভাবে রিপোর্ট দিতে না পারায় আমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে শরিফুলকে দায়িত্ব দেয়। পরে ৩১ অক্টোবর শরিফুল, সিহাব, সাব্বির, বাবর, ইয়াহিয়া, তাহসিনদের নিয়ে সকাল ১০টার দিকে বের হয়ে যায়। শরিফুল অপারেশন শেষ করে টঙ্গীর বাসায় ফিরে আসে। একই দিন সিফাতের নেতৃত্বে আলম, আকাশ, তৈয়বসহ আরও ২ জন প্রকাশক দীপনকে হত্যা করে।’

সবুর ওরফে সাদ জবানবন্দিতে আরও বলে,‘গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং এর ৫ তলা বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলায় বোমা বানানো, বহন ও বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নেই। আলী ওরফে নোমান, আইমান ও তানভীর প্রশিক্ষণ দিত। বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার একটি বাসার নীচতলায় অস্ত্র ও চাপাতির ট্রেনিং করানো হতো।’

গত বছরের ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ার কার্যালয়ে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। একই দিন আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দিপনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ৪ সেপ্টেম্বর টঙ্গী এলাকা থেকে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ চার মাসুলের দায়িত্বে থাকা সবুর ওরফে সাদকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। যাকে ধরিয়ে দিতে ২ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিলো। পরে তাকে টুটুল হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়।


এর আগে গত ১৬ জুন টুটুল হত্যাচেষ্টায় সুমন হোসেন পাটোয়ারি ওরফে সিহাব ওরফে সাকিব ওরফে সাইফুল নামে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দীপন হত্যার ঘটনাতেও গত ২৪ আগস্ট মাইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সমীর ওরফে ইমরান নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছিলো পুলিশ। এরা সবাই আদালতে দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত