সিলেটটুডে ডেস্ক

৩০ নভেম্বর, ২০১৭ ২২:৫৭

বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহবান পোপ ফ্রান্সিসের

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস। একই সঙ্গে এই রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
 
মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশে এসে বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান পোপ ফ্রান্সিস।
 
তবে বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে যান পোপ। মিয়ানমার সফরেও রোহিঙ্গা নামটি উচ্চারণ করেন নি তিনি। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।

এরআগে বিকাল ৩টায় ঢাকায় পৌঁছে তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। সেখান থেকে যান বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে তিনি বক্তব্য দেন।
 
পোপ ফ্রান্সিস বলেন, গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ উদার মন এবং অসাধারণ সংহতির পরিচয় দিয়েছে।

“এটা ছোট কোনো বিষয় নয়, বরং পুরো বিশ্বের সামনেই এটি ঘটেছে। পুরো পরিস্থিতি, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি।”
 
মিয়ানমারে নিপীড়িত মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে পোপের অবস্থানকে ‘প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ক্যাথলিক ধর্মগুরুর এই অবস্থান সঙ্কট সমাধানে আশা দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের সাহায্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় পোপের আহ্বান বিশ্ব সম্প্রদায়কে নৈতিক বাধ্যতা দেয়।
 
রাষ্ট্রপতি পোপের সামনে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, “আমাদের সরকার প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদেরকে নিজেদের আবাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে জোরপূর্ব বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।

“নারী-শিশুসহ হাজারো মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি ভষ্মীভূত হতে তারা নিজ চোখে দেখেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংসতার কারণে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের জনগণ তাদের খোলামনে স্বাগত জানিয়েছে। খাদ্য-আশ্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে।”

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা তুলে ধরে পোপের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, “অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষ্যিত দেশের মতো আমরাও পাশ্চাত্য সমাজে ইসলামফোবিয়ার উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, এ ধরনের উগ্রবাদী প্রবণতা রোধে সমাজের সব স্তরে আন্তঃধর্মীয় আলোচনা জরুরি।”

আবদুল হামিদ বলেন, “আপনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মানুষ যখন তাদের বিশ্বাসের চর্চা ভয়মুক্ত পরিবেশে চর্চা করতে পারে। আমাদের দেশে আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে লালন করি।”

পোপ ফ্রান্সিসও বলেন, “প্রাথমিকভাবে যদিও আমার সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়া, তারপরও আগামীকাল রমনায় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ গুরুত্বপূর্ণ।

“সেখানে আমরা সবাই একসাথে শান্তির জন্য প্রার্থনা করব এবং শান্তির জন্য কাজ করতে আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করব।”

বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ, জাতি কিংবা রাষ্ট্র একা এগিয়ে যেতে পারে না উল্লেখ করে পোপ বলেন, “মানবজাতির সদস্য হিসেবে আমাদের একে অন্যকে প্রয়োজন এবং পরষ্পরের ওপর নির্ভর করতে হয়।”

বাংলাদেশে আসার পথে এই দেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে তার কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করেন তিনি। এদেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কেও জেনেছেন তিনি।

“আমি মনে করি, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই  আপনাদের বিশেষ পরিচয়ের ধারক। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির জাতি-গোষ্ঠির মধ্যে ঐক্য রয়েছে।”

বাংলাদেশের জাতির জনকের কথা উল্লেখ করে পোপ বলেন, “প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এবং এই আদর্শ সংবিধানে যুক্ত করার কথা বলেছিলেন। তিনি আধুনিক, বহুত্ববাদী এবং অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ এবং জাতি মুক্ত, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারবে, যেখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমান অধিকার থাকবে।”

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের প্রশংসা করেন পোপ। তবে বিভক্তি তৈরি করতে কখনও কখনও ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত বছর গুলশানে জঙ্গি হামলার কথাও তিনি স্মরণ করেন।

বাংলাদেশে ক্যাথলিকরা সংখ্যায় কম হলেও স্কুল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে এই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ রেখে চলেছে মন্তব্য করে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন পোপ।

বঙ্গভবনে পৌঁছার পর প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন পোপ ফ্রান্সিস; পরে তিনি দরবার হলে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের সামনে ভাষণ নিয়ে আসেন। বঙ্গভবনের পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আনিসুল হক, হাসানুল হক ইনু, এ এইচ মাহমুদ আলী, আসাদুজ্জামান নূর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, মসিউর রহমান ছিলেন। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াও ছিলেন অনুষ্ঠানে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, সারাহ বেগম কবরী, রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ। তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।

বৃহস্পতিবার বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে পোপকে বহনকারী বিশেষ বিমান হযরত শাহজালাল (রহ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে  পোপকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে বিমানবন্দরে পোপ ফ্রান্সিসকে লালগালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
 
সফরের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিস্টধর্মীয় উপাসনা ও যাজক অভিষেক অনুষ্ঠানে পোপ বক্তব্য রাখবেন। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পোপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে ক্যাথেড্রাল পরিদর্শন করবেন এবং রমনায় প্রবীণ যাজক ভবনে পোপের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশপদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে পোপ বক্তব্য রাখবেন। তারপর আর্চ বিশপ হাউসের মাঠে শান্তির জন্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃমাণ্ডলিক সমাবেশে পোপ বক্তব্য রাখবেন।
 
পোপ তার সফরের শেষ দিন শনিবার সকালে তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা ভবন ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শন করবেন। তার পর তেজগাঁও গির্জায় যাজকবর্গ, ব্রাদার-সিস্টার, সেমিনারিয়ান ও নবিশদের সমাবেশে পোপ বক্তব্য রাখবেন। তিনি তেজগাঁওয়ে পুরনো গির্জা পরিদর্শন করবেন।
 
বিকালে নটর ডেম কলেজে যুব সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখবেন। শনিবার ৫টার দিকে রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন।
 
সফরকালে পোপ লা মেরিডিয়ান হোটেলে থাকবেন। ওই হোটেলে বিশাল মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। পোপের সফর কভার করার জন্য প্রায় ৩০০ বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় রয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে পোপের এবারের ঢাকা সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
 
ইতিপূর্বে ভ্যাটিকান থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দমনপীড়নের তীব্র নিন্দা করেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। তখন তিনি রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা ভাই ও বোন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু তিনি মিয়ানমার সফরে যাওয়ার আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিয়ানমার সফরকালে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেন। মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ করেননি তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত