বিবিসি বাংলা

০১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ১১:১৯

বিটিআরসি যখনতখন বন্ধ করে দেয় ওয়েবসাইট, জবাবদিহি নেই

ভারতের একটি সংবাদ ওয়েবসাইট  ‘দ্য ওয়্যার’ যাতে বাংলাদেশের ভেতরে দেখা না যায়, সেজন্য সম্প্রতি সেটিকে ব্লক করে দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি। এরআগে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ওয়েব সাইট বন্ধ করা হয়েছিল।

বিটিআরসি বলছে বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য প্রায়ই পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়া হয়। ইন্টারনেটের বিস্তারের সাথে সাথে নানা বিষয়ের ওয়েবসাইট এখন পাঠকদের সামনে আসছে।

ওয়েবসাইটের বিস্তার যেমন হচ্ছে, তেমনি এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার নানা নজরদারিও বেড়েছে।

সম্প্রতি 'দ্য ওয়্যার' নামের সংবাদ-ভিত্তিক যে ভারতীয় ওয়েবসাইট বাংলাদেশের ভেতরে ব্লক করে দেয়ে হয়েছে, সেখানে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ শিক্ষক মোবাশ্বার হাসানকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছিল। সেটির কারণেই এ ওয়েবসাইটটি ব্লক করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলছেন না কর্মকর্তারা।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আপত্তির কারণেই সে ওয়েবসাইটটি ব্লক করা হয়েছে। এমন কথা জানিয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ।

কেন ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়ে সেটি নিয়ে অনেক সময় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মইনুল হোসেন বলেন,ওয়েবসাইট বন্ধ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কোন কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করে না।

তিনি বলেন, "ফ্রান্স কিংবা আমেরিকার মতো দেশেও ওয়েবসাইট বন্ধ করার ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের একটি নির্দিষ্ট গ্রাউন্ড দেখাতে হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোতে পলিটিকাল এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এটি করা হয়। অনেকটা জবরদস্তিমূলক ভাবে একাজ করা হয়। যারা ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান , তাদের জবাবদিহিতা থাকা উচিত জনগণের কাছে।"

গত বছরের আগস্ট মাসে বিটিআরসি সংবাদ-ভিত্তিক ওয়েবসাইটসহ ৩৫টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছিল।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি'র তরফ থেকে তখন জানানো হয়েছিল যে, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশের পরামর্শে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। কেন বন্ধ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ জানায়নি বিটিআরসি।

কিন্তু পরে তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, জঙ্গি বিরোধী অভিযান নিয়ে বিভ্রান্তিকর এবং উস্কানিমূলক খবর বা বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, পরামর্শটি এসেছে গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে থেকে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, তিনি বিভিন্ন সময় এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, ওয়েবসাইট বন্ধ করার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে নির্ভর করছে গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতামতের উপর।

তিনি বলেন, "আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ সংস্থার কাছে এ বিষয়টি নির্ভর করে। এখানে ভারসাম্য বজায় রাখার কোন বিষয় লক্ষ্য করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ সংস্থা এ নির্দেশনাগুলো দিয়ে থাকে।"

এখনো পর্যন্ত যাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে কিংবা সাময়িকভাবে ব্লক করা হয়েছে তাদের কেউ বিষয়টিকে আইনগত ভাবে মোকাবেলা করেনি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি।

সাধারণত কেউ যদি মনে করে তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে তাহলে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।

কিন্তু কোন ওয়েবসাইট বন্ধ কিংবা ব্লক করলে তারা কি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন? বাংলাদেশর আইন কী বলছে?

এবিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জানান, বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা আছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকৃতি দেয়া আছে। বিটিআরসি যদি কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করে তাহলে আপনি সেটি চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করার সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন।

২০০২ সালে বিটিআরসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এটি। গত ১৫ বছরে এ প্রতিষ্ঠানটির অনেক লোকবল যন্ত্রপাতি এবং ক্ষমতা বেড়েছে। বিভিন্ন সময় ওয়েবসাইট বন্ধ করার কাজটি করে বিটিআরসি।

বিটিআরসি বলছে, আপত্তিকর কনটেন্টের কারণেই বিভিন্ন সময় সাইটগুলো বন্ধ করা হয়।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, "আইন প্রয়োগকারী সংস্থারা আমাদের জানায়। কোন একটা ওয়েবসাইট সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করছে। ওরা কোন মাপকাঠিতে একটা ওয়েবসাইটকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে, সেটা আমরা বলতে পারবো না। কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য আমরা কারণ দেখানোর জন্য অপেক্ষা করিনা। আমরা টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান। আমরা বন্ধ করা কিংবা খোলার মালিক।"

একটি ওয়েবসাইট যখন বন্ধ করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট পোর্টালটি যারা পরিচালনা করেন তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয় না। বন্ধ করা কিংবা ব্লক করার বিষয়টি অনেক সময় তাদের জানানোও হয় না।

আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, ওয়েব সাইট বন্ধ করার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে আইনের মাধ্যমে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০০৪ সালের লাইসেন্সিং আইনে রেগুলেটরি অথরিটি বা বিটিআরসিকে ক্ষমতা দেয়া আছে।

যদি কোন ওয়েবসাইট থেকে রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করা হয়, তখন লাইসেন্সিং বিটিআরসি চাইলে বলতে পারে যে তোমরা এটা বন্ধ করো। কিংবা জরিমানাও করতে পারে বলে জানান তিনি।

আইনজীবী এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বলছে, কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করা হলে কেউ যদি নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে তাহলে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাস্তবতা ভিন্ন রকমের।

অতীতে যেসব ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে তাদের কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে তারা কোন ধরনের মন্তব্য করতে রাজী হয়নি।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে একাজ করা হয়, তখন বিষয়টিকে কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস পায় না। তিনি বলেন, "আদালতে যাওয়ার সুযোগ তো আছে। কিন্তু এমন একটা ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে সমাজে, সেজন্য কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে চান না।"

আইন অনুযায়ী বিটিআরসির ক্ষমতা থাকলেও কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতামতই প্রাধান্য পায়।

কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়েবসাইট বন্ধ করার পরামর্শ কখনো লিখিত কিংবা কখনো মৌখিকভাবে দেয়া হয়।

সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কোন পরামর্শ দেয় সেটিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয় বিটিআরসি।

সংস্থাটি বলছে, এক্ষেত্রে দেশের আইন অনুযায়ী আদালতের অনুমতি নেবার কোন প্রয়োজন নেই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত