সিলেটটুডে ডেস্ক

০৭ মার্চ, ২০২১ ২২:৪৪

প্রথমবারের মতো ৭ মার্চ পালন করলো বিএনপি

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ৪৩ বছরে এবারই প্রথম ৭ মার্চের ঐতিহাসিক দিবসটি পালন করল বিএনপি। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ বারবার অভিযোগ করে আসছে, তারা ভাষণটি বাজাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছে।

দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে রোববার ৭ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটি।

সেখানে বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকার করলেও এটির উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘দরকষাকষির জন্যই’ ভাষণ দিয়েছিলেন।

দলটির নেতারা আরও বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না। তখনকার ছাত্র সমাজ ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যে প্রত্যাশা করেছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি সে ভাষণে।

৭ মার্চ নিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিকৃতি করছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই ৭ মার্চ পালন করা উচিত, কি উচিত নয়– এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, ৫০ বছর আগে এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল। আর ৫০ বছর পরে নতুন প্রজন্মের নতুন ইতিহাস জানার অধিকার রয়েছে।

‘আজকে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সেই প্রেক্ষাপটে সত্যকে এড়িয়ে সম্পূর্ণভাবে একটা দলীয় ধারণা এই জাতির ওপরে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা সেই জায়গায় এ দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে মনে করি, এই সত্যি ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির সভাপতি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকে আমাদের প্রশ্ন করেছেন, আপনারা আগে তো ৭ মার্চ পালন করেননি। আমাদের পরিষ্কার জবাব, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর একটি দিন হিসেবে আমরা ৭ মার্চ পালন করছি। সুবর্ণজয়ন্তী ইতিপূর্বে আর কোনোদিন আসেনি।’

মোশাররফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল।

তিনি বলেন, ‘ওই ভাষণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু নির্দেশনা ছিল। এটা আমরা অস্বীকার করতে চাই না। সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন জনাব মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, এটাও আমরা অস্বীকার করি না।

‘জিয়াউর রহমান যতবার জাতির উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক ও সংসদে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নামও স্মরণ করেছেন। আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও যতবার জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল। আমরা কারও নাম ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাই না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘এই ৭ মার্চ আমরা পালন করব ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের যে প্রতিক্রিয়া সে সম্পর্কে বলি। শনিবার ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ৭ মার্চ পালন করছে এটা বলার জন্য যে “একটি ভাষণ স্বাধীনতা এনে দেয়নি।” তিনি তা অগ্রিম চিন্তা করলেন। তিনিই তো বলে দিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলছি, একটি ভাষণ স্বাধীনতা এনে দিতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘‘এই ভাষণ নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যেভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। এ ভাষণে কী ছিল তার কিছুটা বিকৃত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ কয়েকটি কথার ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান এও বলেছিলেন যে, ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তাহলে তো বলা যেতেই পারে সে সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সময়ের সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির অংশ হিসেবেই তিনি এই কথা বলেছিলেন।’’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের (বতর্মান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা মোশাররফ বলেন, ‘সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে বর্তমান সরকার এক সঙ্গে করে দিচ্ছে। সংগ্রাম ও যুদ্ধ এক হতে পারে না।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তখন বিএনপি ছিল না। জিয়াউর রহমানকেও বাংলাদেশের মানুষ চিনত না। ৭ মার্চের আলোচনায় আমরা কোনো দলকে ছোট করার জন্য আলোচনা করতে আসিনি। এখানে তুলনা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জিয়াউর রহমান এখানে বিষয়বস্তু না। আমরা ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য এখানে আলোচনা করতে আসিনি।’

২ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবসের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আজকে যারা ইতিহাসকে বিকৃত করছে তারা ওই দিনগুলোকে মনে করতে চায় না।’

এ সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে ছাত্র সমাজ যেখানে পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেছে, স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র সমাজ, সারা বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করা হবে। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা এখানে বক্তব্য রেখেছেন। আমি তখন উচ্চশিক্ষায় বিদেশে ছিলাম।’

মোশাররফ বলেন, ‘এটাও বিবেচনা করতে হবে যে তখনকার ছাত্র সমাজ ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যে প্রত্যাশা করেছিল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি সে দিনের ভাষণে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আজকে আমাদের ৭ মার্চের অনুষ্ঠানটি নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করি, ৭ মার্চ দিবসটি যে আমরা পালন করছি এটাই আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসে ছোট্ট একটা অংশ ৭ই মার্চ। যেহেতু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেহেতু স্বাধীনতা নিয়ে তাদের কোনো পুঁজিপাট্টা নাই। ৭ মার্চের ভাষণই একটা পুঁজি।’

৭ মার্চের ভাষণের কারণে দেশ স্বাধীন হয়নি উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমিও সেদিন বক্তব্য শুনেছি, এখনও শুনি। কিন্তু ওই বক্তব্যের ভেতরে আওয়ামী লীগ যা কিছু খুঁজে পেয়েছে, আমি কিন্তু তা পাইনি।

‘৭ মার্চ আমরা আশা করেছিলাম, বাঁশ নিয়ে গেছি- একটা ঘোষণা তো এসেই যাবে। কিন্তু দেখলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা আসল না। বরং ওই পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন সে প্রচেষ্টা চলেছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও অভিযোগ করেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দরকষাকষির অংশ।

তিনি বলেন, ‘উনি (বঙ্গবন্ধু) এক খানে বলছে, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। আবার বলেছেন, একটা গুলি করলে ১০টা গুলি করব।’

৭ মার্চের ভাষণ এখনও কানে বাজে উল্লেখ করে টুকু বলেন, ‘এই ভাষণে আমরা উদ্বেলিত হয়েছি, কিন্তু ভাষণে যে স্বাধীনতার ঘোষণা সেটা পাইনি। তখন তো আমরা তরুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, যুদ্ধে যাব। যুদ্ধের ঘোষণা আজকে আসবে, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টগুলো দখল করে নেব।

‘যে পতাকা আ স ম রব উঠিয়েছে, সে পতাকা হবে আমাদের পতাকা। কিন্তু শেষে গিয়ে তিনি বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। আর এখন কেটে দিয়েছে জয় পাকিস্তান।’

‘আমি বলতে পারি সেদিন মাঠে যারা ছিল, তারা আশায় বুক বেঁধে এসেছিল যে উনি (বঙ্গবন্ধু) আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন। কিন্তু মন খারাপ করে মানুষকে দেখেছি ফিরে যেতে। নির্দেশনা না পেয়ে মানুষ ফিরে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বলেছে, আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, এ জন্য আমরা ৭ মার্চ পালন করছি। ৫০ বছর তো দেখলাম, তারা কত মিথ্যাচার করতে পারে। কিন্তু আমরা ইতিহাসকে বিকৃত করি না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ৭ মার্চ অনেক মাইলফলকের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে অনেকগুলো মাইলফলক আছে, সেগুলো ধুলায় ঢেকে গেছে। সংস্কারের অভাবে সেই মাইলফলকগুলো ভেঙে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমাদের সেই মাইলফলকগুলোকে ধুলা মুক্ত করতে হবে এবং সংস্কার করতে হবে।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুপরিকল্পিভাবে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে তাদের ভ্রান্ত ইতিহাস দিচ্ছে। ধারণা দিচ্ছে- একটা মাত্র দল, একটা ব্যক্তি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সেই ধারণার সত্যতা তুলে ধরতে চাই। তাদের (আওয়ামী লীগ) বক্তব্যের কোথাও তোফায়েল আহমেদের কথাও খুঁজে পাবেন না। তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা একবারও উচ্চারণ করেন না। এমনকি যুদ্ধে যে সর্বাধিনায়ক ছিলেন এম এ জি ওসমানী, তার নামও একবারও উচ্চারণ করেন না। আর যুদ্ধকালীন যে সরকার, যিনি নেতৃত্ব দিলেন ‘তাজউদ্দিন আহমেদ’ তার নামও একবারও উচ্চারণ করেন না।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘কত সংকীর্ণ এরা! কত ভয়ঙ্কর। শুধু মাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এবং একজন মানুষকে মহিমান্বিত করার জন্য, একটি পরিবারের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করার জন্য মিথ্যা ইতিহাস মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।’

সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএনপি বসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা বলেছিলেন, আপনারা কেন সূবর্ণজয়ন্তী পালন করছেন? আরে স্বাধীনতা কি একা আওয়ামী লীগের। না কোনো ব্যক্তির? স্বাধীনতা হচ্ছে, সমগ্র দেশের।’

সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘এ দেশের জনগণ যখন স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। সেই ভাষণে জনগণ আশা করেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। কিন্তু উনি বক্তব্যের মধ্যে বলেছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। কারণ তারা তখন চাচ্ছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষমতা বণ্টন করতে। আলোচনা চলতে ছিল।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত