সিলেটটুডে ডেস্ক

১৬ এপ্রিল, ২০২১ ১৭:৫৫

হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার

হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক সহিংসতার পর কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। প্রথম দিকে হেফাজতের নিচের সারির কর্মীরা গ্রেপ্তার হলেও ধীরে ধীরে উপরের সারির নেতারাও গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

হেফাজতের উগ্রতা নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, শীর্ষ পর্যায়ের আরও কয়েক নেতা নজরদারির মধ্যে আছেন, শিগগিরই তারা গ্রেপ্তার হতে পারেন।

হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক তাণ্ডবে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সবশেষ গত বুধবার গ্রেপ্তার হন সংগঠনের কেন্দ্রীয় দুই সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি ও মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী।

ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘হেফাজতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। হেফাজত নেতারা মুখে এক রকম বলছেন, কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে আরেক রকম। তাদের কথিত আন্দোলন আবার সহিংস রূপ ধারণ করছে। তারা নিজেদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এর সুযোগ নিচ্ছে জামাত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা। হেফাজতের আন্দোলনকে পুঁজি করে উগ্রবাদী জঙ্গিরাও ফায়দা নিচ্ছে।’

ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে গত ২৬ মার্চ সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালান হেফাজত কর্মীরা। এ সময় গুলিতে নিহত হন চারজন।

দুই দিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতার সময় দুই দিনে ১২ জন নিহত হন।

এরপর ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারী নিয়ে মামুনুল হক অবরুদ্ধ হওয়ার পর হেফাজত কর্মীরা ওই এলাকা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে তাণ্ডব চালান।

ওই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা হেফাজতকে সতর্ক করে বক্তব্য রাখতে থাকেন।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক ঘটনার পাশাপাশি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর তাণ্ডবের মামলাও আবার সচল করা হয়।

৫ মের মামলায় গত রোববার রাতে পুলিশ চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে। এর এক দিন পরেই গ্রেপ্তার হন সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ্। তাকেও শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

হেফাজতের নারায়ণগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাহকে ২৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ হরতাল চলাকালে তাণ্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া, ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের মামলায় আসামি করা হয়েছে হেফাজত নেতা মামুনুল হককেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পটিয়া, হাটহাজারীকে এক শরও বেশি হেফাজত কর্মীকে গত কয়েক দিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পাশাপাশি গত সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার পর মারা যাওয়া হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগ এনে করা মামলায় গত রোববার যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সেখানে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শুধু ঢাকাতেই মামলা হয়েছিল ৫৩টি। হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয় সেসব মামলায়। চারটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। আরও দুটি মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির অপেক্ষায় আছে।

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে ও সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির মতিঝিল জোনে। মতিঝিল জোনের উপ পুলিশ কমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম জানান, হেফাজতকে আর ছাড় দেয়া হবে না।

তিনি বলেন, ‘মামলার গ্রাউন্ড, মামলায় যা যা অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিটি বিষয় তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে যারা দোষী প্রমাণিত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হবে। অপরাধী যেই হোক ছাড় দেয়া হবে না, তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না।’

হেফাজতের বিরুদ্ধে পুরানো মামলাগুলো সচলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে কখনও অগ্রগতি হয় কখনও হয় না। আবার কিছু সময় আসে যখন এসব মামলাকে মনিটর করা হয় ও তরিৎগতিতে নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের মামলাগুলো তদন্তাধীন ছিল, এখন সেগুলো পুনরায় বিবেচনার সময় এসেছে।’

ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের তাণ্ডবের পর হেফাজতের বর্তমান আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখন তিনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন, হেফাজত আর কখনও কোনো সহিংস আন্দোলন করবে না।

‘আরও কিছু বিষয়ে তারা নমনীয় হয়েছিল বলেই তখন তাদের ছাড় দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের এখন কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে হচ্ছে।’

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে গত ৭ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকে আইশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পরিষ্কার নির্দেশনা এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলেও হেফাজত দমনে মাঠপর্যায়ের অভিযানে গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র‌্যাবকে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক অভিযানগুলোতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’

ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামে জামাত-শিবির ও উগ্রপন্থীদের দুটি আলাদা গ্রুপ আছে। ওই দুটি গ্রুপের হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত ছাড়া হেফাজতের কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয় না। আমরা ইতিমধ্যেই ওই দুই গ্রুপের নেতাদের তালিকা তৈরি করেছি। এখন যারা গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে আছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সেই তালিকা মিলিয়ে নেয়া হচ্ছে।’

সূত্র : নিউজবাংলা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত