নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:১৩

ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে সিলেট বিএনপি

দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। নেতাদের বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়। দলীয় কর্মসূচীতেও অনুপস্থিত। তবে বিরোধে ঠিকই চাঙ্গা সিলেট বিএনপি। দলটির নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিবাদ লেগেই আছে।

সিলেট বিএনপিতে ক্ষোভ আর বিরোধ চলে আসছে অনেকদিন থেকেই। সম্প্রতি একটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এই ক্ষোভ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ক্ষোভে পদত্যাগেই করে বসেন এক নেতা। এরপর দলটির অঙ্গসহযোগী সংগঠনে রীতিমত পদত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে।

ইতোমধ্যে নবগঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলের ১১ নেতা ও মহানগর তাঁতী দলের তিন নেতা পদত্যাগ করেছেন। আরও অনেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে।

ফলে মাঠে নিষ্ক্রিয় থেকেও এখন উত্তাপ ছড়াচ্ছে সিলেট বিএনপির রাজনীতি। নেতাদের বিরোধে হঠাৎ উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন।

এনিয়ে বিএনপির সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। তবে কয়েকজন নেতার পদত্যাগের ঘটনায় নিজেরা বিব্রত ও অস্বস্তিতে আছেন বলে জানিয়েছেন।

সিলেটে বিএনপির পুরনো বিরোধ সম্প্রতি নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠে জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে। গত ১৭ আগস্ট সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদক।

কমিটিতে জেলার শাখায় আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুল আহাদ খান জামাল ও সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা দেওয়ান জাকির হোসেন খান। এদিকে মহানগরের আহবায়ক হিসেবে আব্দুল ওয়াহিদ সুহেল ও সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আজিজুল হোসেন আজিজ।

নিজেদের বলয়ের নেতারা কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়ায় এই কমিটি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন সিলেট বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা। এরমধ্যে গত ১৮ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জামান জামান পদত্যাগের ঘোষণা। ওইদিনই তিনি দলের মহাসচিব বরাবরে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন।

পদত্যাগপত্রে জামান ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দলে মূল্যায়ন না করা এবং নিজে সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক হওয়ার পরও তার সাথে আলোচনা না করেই সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি অনুমোদন করা হয় বলে অভিযোগ তুলেন।

জামানের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই নবগঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ১১ নেতা। গত ২১ আগস্ট তারা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন। আর ২৩ আগস্ট পদত্যাগ করেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন তাঁতী দলের তিন নেতা।

২১ আগস্ট সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন- যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদ বক্স, সদস্য মওদুদুল হক, শহীদুল ইসলাম কাদির, আলতাফ হোসেন বিল্লাল, আমিনুল হক বেলাল ও শাহিদুল ইসলাম চৌধুরী লাহিন। মহানগর কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন- সদস্য আব্দুর রকিব তুহিন, রুজেল আহমদ চৌধুরী, আব্দুল হান্নান ও আক্তার আহমদ।

স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রকিব তুহিন বলেন, নতুন কমিটিতে যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। নিষ্ক্রিয় ও অযোগ্যদের দিয়ে একটি পকেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির আমাদের হতাশ করেছে। তাই আমরা পদত্যাগ করেছি।

এরপর ২৩ আগস্ট পদত্যাগ করেন সিলেট মহানগর তাঁতী দলের সভাপতি ফয়েজ আহমদ দৌলত, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল গফফার।

এ প্রসঙ্গে আব্দুল গফফার বলেন, যে দলে মূল্যায়ন নাই, গণতন্ত্রের আভাস নাই, সেখানে রাজনীতি করে যাওয়া কঠিন। আমরা শহীদ জিয়ার যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করতাম, তা এখন দেখতে পাচ্ছি না।

গফফার বলেন, আমাদের কর্মীরা মূল্যায়ন পাচ্ছে না। যারা নির্যাতিত হয়েছে, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে, তারা যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না। তাই পদত্যাগ করেছি।

জানা যায়, অঙ্গসহযোগী সংগঠন থেকে পদত্যাগকারী সকলেই গত ১৭ আগস্ট পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শামসুজ্জামান জামানের অনুসারী। নেতার পদত্যাগের ঘোষণার পর তাকে অনুসরণ করেই পদত্যাগ করছেন অন্যরা। জামান অনুসারী হিসেবে পরিচিত আরও কয়েকজন নেতা পদত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে পদত্যাগী তাঁতীদল নেতা আব্দুল গফফার বলেন, জামান ভাই ত্যাগী নেতা। রাজপথের ইলিয়াস ভাই (ইলিয়াস আলী) পরেই আন্দোলন-সংগ্রামে জামান ভাইয়ের অবদান বেশি। তার মূল্যায়ন না হলে....তার তুলনায় আমরা তো বহু নিচে। জামান ভাইয়ের মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরা দুঃখ পেয়েছি।

বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে বিবাদ ও ক্ষোভ বছরখানেক ধরেই চলছে। গত বছর ঘোষিত হয় সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটি। এই কমিটিগুলোতে নিজেদের পছন্দের লোক ঠাঁই না পাওয়ায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক, শামসুজ্জামান জামানসহ সিলেটের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। পরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এর আগে জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি নিয়েও এই ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখা দেয়।

বিএনপি নেতারা জানান, বহুধাবিভক্ত সিলেট বিএনপি এখন মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের অনুসারী ও তার বিরোধী এই দুই বলয়ের মধ্যেই এখন বিরোধ সবচেয়ে তুঙ্গে। খন্দকার মুক্তাদিরের বিরোধী বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, শামসুজ্জামান জামানসহ কয়েকজন নেতা।

গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। তবে শুরু থেকেই মুক্তাদিরের বিরোধিতা করে আসছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। আরিফ বলয়ের নেতারা প্রার্থী হিসেবে চাইছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলটির উপদেষ্টা হয়ে যাওয়া ইনাম আহমদ চৌধুরীকে। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ তখন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন। তবে দল থেকে খন্দকার মুক্তাদিরকেই প্রার্থী করা হয়। এরপর নানা চেষ্টা করে আরিফের মান ভাঙান মুক্তাদির। কেন্দ্রের চাপে মেয়র আরিফ তখন প্রকাশ্যে মুক্তাদিরের পক্ষে প্রচারণায় নামলেও আড়ালে মেয়র ও তার অনুসারীরা মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সেই নির্বাচনে হেরে গেলেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের সাথে খন্দকার মুক্তাদিরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে তার অনুসারী একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এই সম্পর্কের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে মুক্তাদির বলয়ের নেতারাই বেশি প্রাধান্য পান।

তবে এনিয়ে ক্ষুব্ধ হন তার বিরোধী বলয়ের নেতারা। দীর্ঘদিন থেকে জমা এই ক্ষোভ থেকেই সাম্প্রতিক পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক বলেন, দলে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের ভুল বুঝিয়ে নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠন করছে। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরীক্ষিত নেতারা বঞ্চিত হওয়ায় অনেকেরে মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এই ক্ষোভ থেকেই জামানসহ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন।

এ ব্যাপারে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নেতাদের এমন পদত্যাগের ঘোষণাকে বিব্রতকর আখ্যা দিলেও এতে দলে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মন্তব্য করেছেন সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার।

তিনি বলেন, অনেকের ক্ষোভ থাকতে পারে। এই ক্ষোভ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রকাশ্যে এভাবে পদত্যাগের ঘোষণা শোভন নয়। তবে তাদের এমন ঘোষণায় দলে তেমন প্রভাব ফেলবে না। পদত্যাগকারীরা সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির কোনো দায়িত্বেও নেই।

মাঠে কোনো কর্মসূচী থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন রাজপথে কোনো কর্মসূচী নেই। তবে নিয়মিতই আমরা ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করি। সঙ্কটে পড়া মানুষের পাশেও আমরা আছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত