সিলেটটুডে ডেস্ক

২৪ আগস্ট, ২০১৫ ১৮:৩০

কুমার সাঙ্গাকারা: গুডবাই জিনিয়াস!

জীবনের শেষ ইনিংসে মাত্র ১৮ রান, যেন নামের সাথে যায় না মোটেও। কুমার সাঙ্গাকারা, মহান ক্রিকেটশিল্পী শেষ করলেন তার টেস্ট ক্রিকেট ক্যারিয়ার। গুডবাই কুমার সাঙ্গাকারা, গুডবাই জিনিয়াস!

গৌরবদীপ্ত এক ক্যারিয়ারের শেষটা হয়েছে দলের বড় পরাজয়ে, তবু তিনি তার কীত্তিতে অমলিন থাকবেন ক্রিকেট ইতিহাসে।

রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ফ্লাইটেড ডেলিভারি টার্ন করে ব্যাটে লেগে জমা পড়ল গালিতে থাকা মুরালি বিজয়ের হাতে। ব্যাট বগলদাবা করে হাঁটা দিলেন সাঙ্গাকারা। মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল আন্তর্জাতিক আঙিনায় ১৫ বছরের পথচলা।

২২ গজে যার ব্যাট অসংখ্যবার আলো ছড়িয়েছে, শাসন করেছে ক্রিকেট বিশ্ব, রচিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার অনেক জয়ের গল্প, কিন্তু শেষটায় হলো না কোনো ইতিহাস। ব্যাট হাতে যিনি লিখেছেন দারুণ সব মহাকাব্য, মনকে প্রশান্তি দেওয়া সব উপন্যাস, মনোজগতকে নাড়া দেওয়া সব গল্প, শেষ বেলায় তা কেবলই এক ছোটগল্প। শেষ হয়েও যেন হলো না শেষ! তার কাছে পাওনা যেন আরও বেশি!

শেষটা রাঙিয়ে যাওয়া হলো না সাঙ্গাকারার। প্রথম ইনিংসের ৩২ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আউট ১৮ রানে। ৫৮-এর বেশি গড় নিয়ে শুরু করেছিলেন বিদায়ী সিরিজ। ২ টেস্ট মিলিয়ে ৪ ইনিংসে ৯৫ রান করায় নেমে এলো গড়, ক্যারিয়ার শেষ করলেন ৫৭.৪০ গড় নিয়ে। স্পিনের বিপক্ষে বরাবরই দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান শেষ সিরিজে চার ইনিংসেই আউট হলেন অশ্বিনের অফ স্পিনে।

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ১২টি দ্বিশতকের রেকর্ড অধরাই থেকে গেল। শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের লড়াইয়ে অনেকেই সাঙ্গার সঙ্গে যার তুলনা করেন, সেই অরবিন্দ ডি সিলভা ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে করেছিলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দ্বিশতক; এই পি সারা ওভালেই ২০০২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে।

একই মাঠে সাঙ্গাকারার শেষটা হতাশার ছোটগল্প হয়ে গেল। শেষবারের মত তার কাছে একটা বড় ইনিংস চাইছিল দলও, সামনে যে দূরহ লক্ষ্য! কিন্তু এবার আর ভরসা হয়ে উঠলো না চির আস্থার ব্যাট। শেষটাও তাই রাঙিয়ে যাওয়া হলো না!

আসলেই কি তাই? উইকেট পাওয়ার উচ্ছ্বাসে দ্রুতই বিরতি দিয়ে ভারতের সব খেলোয়াড় যে ছুটলেন আউট হওয়া ব্যাটসম্যানকে অভিনন্দন জানাতে! একটু করদর্মন, শেষবারের মতো কিংবদন্তির একটু ছোঁয়া পাওয়ার চেষ্টা! ১৮ রান করে আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের সম্মানে দাঁড়িয়ে মাঠের সবাই!

বছরের পর বছর ধরে লঙ্কান ক্রিকেটের ‘সমর্থক নম্বর ওয়ান’ পার্সি অভয়সেকেরা ঠিকই জাতীয় পতাকা উড়িয়ে মাঠ থেকে বরণ করে বাইরে নিয়ে এলেন নায়ককে। শেষটা আর কজন মনে রাখে, সাঙ্গাকারা সবসময়ই লঙ্কান ক্রিকেটের মহানায়ক।

গত জানুয়ারিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটন টেস্টে ক্যারিয়ারের একাদশ দ্বিশতক করেছিলেন সাঙ্গাকারা। ওই সিরিজ শেষে তার ক্যারিয়ার ব্যাটি গড় ছিল ৫৮.৬৬। কিন্তু নতুন মৌসুমে ক্যারিয়ারের শেষ চার টেস্টের আট ইনিংসে পঞ্চাশ ছুঁতে পেরেছেন মাত্র একবারই। গড়টাও তাই নেমে গেছে আটান্নর নিচে। তার পরও কমপক্ষে ৯ হাজার রান করাদের মধ্যে ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা গড় এটিই।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি শতক, ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দ্বিশতক, ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় মহাকাব্যিক সব ইনিংস, ২০১১ সালে এমসিসি স্পিরিট অব ক্রিকেট কাউড্রে লেকচারে অসাধারণ সেই বক্তৃতায় ক্রিকেট বিশ্বের মন জয় করা, ক্রিকেটার পরিচয় ছাপিয়ে ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা আর অসাধারণ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া, বিদায় বেলায় পুরো ক্রিকেট বিশ্বের টুপি খোলা অভিনন্দন, প্রাপ্তির পাল্লা কত সমৃদ্ধ!

সাঙ্গাকারার ক্যারিয়ার যেন চোখধাঁধানো অসংখ্য মনিমুক্তা খচিত উজ্জ্বল এক রাজমুকুট। শেষের ব্যর্থতার সাধ্য কি সেই মুকুটের ঔজ্জ্বল্য এতটুকু ম্লান করবে!

সাঙ্গাকারার বিদায়ি ম্যাচে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে জয় পেয়েছে সফরকারী ভারত। স্বাগতিকদের ২৭৮ রানে হারিয়ে সিরিজে ১-১ এ সমতায় ফিরল ভারত।

প্রথম ইনিংসে ভারতের করা ৩৯৩ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা করে ৩০৬ রান। ৮৭ রানে এগিয়ে থেকে টিম ইন্ডিয়া ৮ উইকেট হারিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। শ্রীলঙ্কাকে ৪১৩ রানের বিশাল টার্গেট ছুঁড়ে দিলে স্বাগতিকরা পঞ্চম দিনে এসে অলআউট হওয়ার আগে করে ১৩৪ রান।

চতুর্থ দিন শেষে দুই উইকেট হারিয়ে ৭২ রান তুলেছিল লঙ্কানরা। হাতে আট উইকেট নিয়ে আর ৩৪১ রানে পিছিয়ে থেকে ম্যাচের পঞ্চম ও শেষ দিন মাঠে নামে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ বাহিনী।

এর আগে ৪১৩ রানের টার্গেটে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা ভালো করেনি স্বাগতিকরা। দলীয় ৮ রানের মাথায় অশ্বিনের বলে বিনির তালুবন্দি হয়ে ফেরেন ওপেনার কুশল সিলভা। আর দলীয় ৩৩ রানের মাথায় ব্যক্তিগত ১৮ রান করে বিদায়ী টেস্টে বিদায় নেন সাঙ্গাকারা। প্রথম ইনিংসে লঙ্কান এ গ্রেটের ব্যাট থেকে আসে ৩২ রান। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ও ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে অশ্বিনের বলে আউট হন সাঙ্গা।

পঞ্চম দিন ওপেনার করুনারত্নের ব্যাট থেকে আসে ৪৬ রান। লঙ্কান দলপতি ম্যাথুজ প্রথম ইনিংসে শতক হাঁকালেও দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ২৩ রান। এছাড়া চান্দিমাল ১৫, থিরিমান্নে ১১ রান করেন।

ভারতের হয়ে ১৬ ওভার বল করে ৪২ রান খরচায় সর্বোচ্চ ৫টি উইকেট তুলে নেন অশ্বিন। প্রথম ইনিংসেও তিনি দুটি উইকেট তুলে নেন। ভারতের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক সিরিজে হরভজন সিংকে টপকে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিকও হলেন অশ্বিন (১৭ উইকেট)। আর প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট পাওয়া অমিত মিশ্র দ্বিতীয় ইনিংসে ৩টি উইকেট দখল করেন।

এর আগে দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ১২৬ রান করেন আজিঙ্কা রাহানে। ২৪৩ বলে রাহানের ইনিংসটি সাজানো ছিল ১০টি চারের সাহায্যে। এছাড়া ওপেনার মুরালি বিজয় খেলেন ৮২ রানের ইনিংস। আগের ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান লোকেশ রাহুল ২, বিরাট কোহলি ১০, রোহিত শর্মা ৩৪, স্টুয়ার্ট বিনি ১৭, সাহা ১৩, অশ্বিন ১৯ আর অমিত মিশ্র ১০ রান করেন। লঙ্কানদের হয়ে ৪টি করে উইকেট তুলে নেন ধামিক্কা প্রসাদ এবং থারিন্ডু কুশল।

এদিকে, ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই অসাধারণ পারফরমেন্স করা সাঙ্গাকারাকে বিদায় বেলা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আইসিসি’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন। সোমবার (২৪ আগস্ট) ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট খেলে অবসরে যান এ কিংবদন্তি।

রিচার্ডসন বলেন, ‘ক্রিকেট থেকে একজন গ্রেট তারকা অবসর নিল। তিনি ক্রিকেটের পাশাপাশি একজন দূত হিসেবেও অসাধারণ। তিনি তার ক্যারিয়ারে ব্যাটিং ও উইকেটের পেছনে কিপিংটাও দারুণ উপভোগ করেছেন। সাঙ্গা ক্রিকেটের জন্য উদাহারণ হয়ে থাকবেন।’

সাঙ্গাকারা বিগত ১৫ বছর ধরে ক্রিকেটে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে রাখেন। এ সময় তিনি ১৩৪ টেস্টে ১২,৪০০ রান, ৪০৪ ওয়ানডেতে ১৪,২৩৪ রান ও ৫৬ টি-টোয়েন্টিতে ১৩,৮২ রান করেছেন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত