সিলেটটুডে ডেস্ক

০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৮:০৬

এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে বৈষম্য দূরীকরণের দাবি

কলেজ শিক্ষক পরিষদের সংবাদ সম্মেলন

২০১৮ সালের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোর কিছু ধারা শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে বলে দাবি করে অবিলম্বে নীতিমালা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন কলেজ শিক্ষক পরিষদ সিলেটের নেতৃবৃন্দ।

শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন নেতৃবৃন্দ।

তারা বলেছেন- বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষকরা আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত। সর্বশেষ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর কতিপয় ধারা শিক্ষকদের বিশেষ করে কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি কলেজের প্রভাষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে। তাই অবিলম্বে এসব ধারা সংশোধন করতে হবে।

শিক্ষকদের দাবিগুলো হলো- সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাত প্রথা বাতিল করা, একটি নির্দিষ্ট সময় পর ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি কলেজের সকল প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি, পদোন্নতি বিলম্বিত প্রভাষকদের ১০ বছর পূর্তিতে ৭ম গ্রেড প্রদান, ১২ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি কলেজের সকল প্রভাষককে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের সুযোগ সৃষ্টি, কোনো প্রকার আবেদন ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষকদের গ্রেড/স্কেল পরিবর্তন এবং মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে চলতি বছরেই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে কলেজ শিক্ষক পরিষদ সিলেটের সভাপতি জ্যোতিষ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষকদেরকে বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষকরা আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। সর্বশেষ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর কতিপয় ধারা শিক্ষকদের বিশেষ করে কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি কলেজের প্রভাষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে।

২০১৮ এর এমপিও নীতিমালার ১১.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “এমপিওভূক্ত প্রভাষকগণ প্রভাষক পদে এমপিওভূক্তির ৮ বছর পূর্তিতে ৫:২ অনুপাতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। এতে মোট পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। অন্য প্রভাষকগণ এমপিওভূক্তির ১০ বছর সন্তোষজনক চাকরি পূর্তিতে বেতন গ্রেড ৯ থেকে ৮ প্রাপ্য হবেন।”

এই অনুচ্ছেদের পর্যালোচনা করে জ্যোতিষ মজুমদার বলেন, ৮ বছর পর একটি কলেজের ৭ জন প্রভাষকের মধ্য থেকে দুইজনকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে (৬ষ্ঠ গ্রেডে) পদোন্নতি দেওয়া হবে। অর্থাৎ ২৮ শতাংশ সৌভাগ্যবান প্রভাষক শুধুমাত্র আগে যোগদান, এমপিওভূক্তি কিংবা বয়সে বড় হওয়ার কারণে সহকারী অধ্যাপক পদে (৬ষ্ঠ গ্রেড, বেতন স্কেল ৩৫৫০০) পদোন্নতি পাবেন। অবশিষ্ট ৭২ শতাংশ প্রভাষক ১০ বছর পর ৯ম গ্রেড (২২০০০) থেকে ৮ম গ্রেডে (২৩০০০) উন্নীত হবেন। কিন্তু তাদের বেতন বাড়বে মাত্র ১ হাজার টাকা। কারণ ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেডের ব্যবধান মাত্র ১ হাজার টাকা। একই পদে একই যোগ্যতায় চাকরি করে কারো ৮ বছর পরে পদোন্নতি সহ বেতন বাড়বে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর অবশিষ্ট অধিকাংশের ক্ষেত্রে সারা জীবন পদোন্নতি তো পাবেনই না বরং ১০ বছর পর বেতন বাড়বে মাত্র ১ হাজার টাকা! এ রকম কালো আইন বোধ হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ১৯৯৫ এর নীতিমালা অনুযায়ী প্রভাষকরা ২ বছর পূর্তিতে ৮ম গ্রেড (বর্তমান পে স্কেলে ২৩০০০ টাকা) এবং ৮ বছর পূর্তিতে ৭ম গ্রেড (বর্তমান পে স্কেলে ২৯০০০ টাকা) পেতেন। ২০১০ এর এমপিও নীতিমালায় ২ বছর পর ৮ম গ্রেডের বিধান পরিবর্তন করলেও ৮ বছর পর ৭ম গ্রেড বহাল রাখা হয়।

জ্যোতিষ মজুমদার জানান, সরকারি কলেজের প্রভাষকরা প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেও এমপিওভূক্ত কলেজের প্রভাষকরা সারাজীবনে মাত্র একটি পদোন্নতি পান (সহকারী অধ্যাপক পদে)। তাও আবার অনুপাত প্রথার কারণে ৭২ শতাংশ প্রভাষককে আজীবন একই পদে থেকে অবসরে যেতে হচ্ছে। নীতিমালার কিছু ধারার কারণে দেখা যায়, একজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক অবসরের সময়েও প্রভাষকই থাকছেন। অথচ উনার ছাত্র সহকারী অধ্যাপক হয়ে গেছে। এ ধরনের ঘটনা কতটা হৃদয় বিদারক তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আগের নীতিমালাগুলোতে পদোন্নতি বঞ্চিত প্রভাষকরা ২ বছর পর ৮ম গ্রেড এবং ৮ বছর পর ৭ম গ্রেড পেয়ে কিছুটা সান্ত¡না পেতেন। কিন্তু ২০১৮ এর নীতিমালায় ১০ বছর পর ৮ম গ্রেড তথা ১ হাজার টাকা বৃদ্ধি করার বিধান করায় প্রভাষকদের শেষ ভরসাটুকুও আর রইলো না।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকবৃন্দ জানান, ২০১০ এর জনবল কাঠামোর ১১(৫) ধারায় সহযোগী অধ্যাপক পদের কথা উল্লেখ থাকলেও ২০১৮ এর নীতিমালায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০১০ এর নীতিমালায় প্রভাষকরা ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ কিংবা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে এবং ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু ২০১৮ এর নীতিমালায় অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে ১২/১৫ বছরের অভিজ্ঞতার সাথে সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার বিধান করা হয়েছে। ফলে যারা সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না তাদের আর কোনো সুযোগই থাকে না।

বৈষম্যমূলক এসব ধারা পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে শিক্ষকবৃন্দ বলেন, গত বছরের ১২ নভেম্বর এমপিও নীতিমালা সংশোধনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে ১ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করতে বলা হয়েছিল। কলেজ শিক্ষক পরিষদসহ বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে নীতিমালা সংশোধন কমিটির কয়েকটি বৈঠকে এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনাও হয়। তখন প্রভাষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু দীর্ঘ দশ মাস যাবত উক্ত কমিটি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি। ফলে প্রভাষকদের হতাশা আরও বেড়েছে।

শিক্ষকবৃন্দ বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর একটি পত্রিকায় “গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর শর্ত শিথিল” শিরোনামে নীতিমালা সংশোধন কমিটির সদস্য গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলারের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে; যা দেখে কলেজ শিক্ষকরা আরো হতাশ হয়েছেন। প্রতিবেদনের ভাষ্য মতে, নীতিমালা সংশোধনী চূড়ান্তকরণের সভায় ইন্টারমিডিয়েট কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে আর পদোন্নতি দেওয়া হবে না, বরং এর পরিবর্তে সিনিয়র প্রভাষক পদ সৃষ্টি করা হবে বলে আলোচনা হয়েছে। অথচ উভয় স্তরের প্রভাষকদের একই যোগ্যতায় নিয়োগ, একই পদবি, একই বেতন স্কেল এবং এর আগে প্রভাষক পদে কখনও উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি এ রকম কোনো বৈষম্য ছিল না। উক্ত সভায় আরো আলোচনা হয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিকের কোনো শিক্ষক একই কলেজে অধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারবেন না, তবে ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকরা আবেদন করতে পারবেন। আমরা জানিনা এই প্রতিবেদনের সত্যতা কতটুক। যদি সত্যি হয় তাহলে সেটা হবে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি চরমভাবে নিরুৎসাহিত করে জাতিকে মেধাশূন্য করার একটা অপচেষ্টা। আমরা বিশ্বাস করি এটি সত্য নয় এবং চূড়ান্ত নীতিমালায় এ রকম কোনো বৈষম্য স্থানতো পাবেই না বরং শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নীতিমালায় বিদ্যমান সকল অসঙ্গতি অচিরেই সংশোধন করে কলেজ শিক্ষকদের হতাশামুক্ত করে শিক্ষার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবেন।

শিক্ষকবৃন্দ বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯৭ শতাংশ দায়িত্ব পালন করেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ। অথচ তাদের বেতন ভাতা খুবই নগণ্য। তাদের সামান্য যে সুযোগ্য সুবিধা ছিল তাও যদি কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে শিক্ষকদের মনে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেবে। ফলে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তাছাড়া এভাবে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কমতে থাকলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি নিরুৎসাহিত হবে এবং জাতি মেধাশূন্যতার দিকে ধাবিত হবে। তাই শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে এবং মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে নীতিমালার বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন করে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামরুল আনাম চৌধুরী, সহ সভাপতি এম. এ. মতিন, সাংগঠনিক সম্পাদক শংকর কুমার দাস, সহ সভাপতি নন্দ কিশোর রায়, দিরাই উপজেলা কমিটির সভাপতি মো. আলকাবুর রহমান, সহ সভাপতি মো. আব্দুল আলী ও প্রত্যুষ কান্তি দাস।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত