রিপন দে, মৌলভীবাজার

০৮ মার্চ, ২০২১ ১৫:০২

এই নারীদের কথা ভাববে কে?

বঞ্চিতদের মধ্যে বঞ্চিত চা বাগানের নারী শ্রমিকরা

দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির অন্যতম চা শ্রমিকরা। নূন্যতম মুজরিতেই চলতে হয় জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে থাকা চা বাগানের শ্রমিকদের। এই বঞ্চিতদের মধ্যে আরও বঞ্চিত নারী চা শ্রমিকরা। অপ্রাপ্তি, হতাশা আর অসুখই তাদের সঙ্গী।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্রমতে, দেশে মোট নিবন্ধিত চাবাগান ১৬৭টি। তাতে বসবাস করেন প্রায় ১০ লাখ চা জনগোষ্ঠী। এসব বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ১ লাখ, অনিয়মিত শ্রমিক আরো প্রায় ৪০ হাজার। চা শ্রমিকদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে তারা প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ ঘন্টা কাজ করেন। ১২০ টাকা মজুরি আর সপ্তাহে ৩ কেজি ২৭০ চাল বা আটা রেসনে চলে তাদের সংসার।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভোজন কৈরী বলেন,  প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ কেজি চা–পাতা তুলতে হয় নারী শ্রমিকদের। বাড়তি চা-পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশির ভাগ নারী। কাজের স্থানে নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো শৌচাগার নেই। নেই বিশুদ্ধ পানি, বিশ্রামাগার কিংবা টয়লেট ব্যবস্থা। প্রতিটি  বাগানে  ডিসপেনসারি থাকার কথা এবং তাতে সার্বক্ষনিক চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও ৯০ শতাংশ বাগানে সেই সুবিধা নেই। ৭০/৮০ শতাংশ বাগানে নাম মাত্র থাকলে সেখানে প্যারাসিটামল আর নাপা ছাড়া কোন চিকিৎসা মিলে না। সর্ব রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল।
 
প্রতিটি বাগানে শিশু সদন থাকার কথা থাকলে তা আছে মাত্র ৪০% বাগানে ফলে ২ মাসের ছোট একটি বাচ্চাকে আরেকটি ৭/৮ বছরের বাচ্চার অধিনে রেখে কাজে যেতে হচ্ছে।

চা বাগানের নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্টানের তথ্য অনুসারে চা বাগানে নারীদের মধ্যে জরায়ূ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের প্রার্দুভাব বেশী।

নারী চা শ্রমীকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্বেচ্ছায় কাজ করছে “নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম”। সেই ফোরামের আহবায়ক মারজিয়া প্রভা জানান, বিভিন্ন সময়ে ভায়া টেষ্টের ফলে যে তথ্য আমরা পেয়েছি তাতে বলা যায়, বাগান ভেদে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন। প্রজনন স্বাস্থ্যের অবস্থা ভয়াবহ। দীর্ঘ আটঘন্টা প্রস্রাব চাপিয়ে কাজ করতে হয়। পাতা তোলার সেকশনগুলোতে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা নেই দেখে এই প্রস্রাব চাপিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয় তারা। এতে জরায়ুমুখ নেমে আসে। অধিকাংশ নারী এই সমস্যায় ভুগছে। মাসিকের অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা, যৌনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অজ্ঞতা তাদেরকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

চা বাগানে নারীদের গর্ভধারণের সংখ্যা অধিক। গর্ভাবস্থায় থাকা অবস্থায় একদিকে যেমন পরিমিত পুষ্টির অভাব, অন্যদিকে চা বাগানের কমিউনিটি ক্লিনিকে উন্নত ডেলিভারি ব্যবস্থা নেই।

“বাগান মায়ের জন্য” নামের প্রজেক্ট নিয়ে চা বাগানে কাজ করছে সেন্টার ফর ইনঞ্জুরি প্রিবেনশন এন্ড রিসার্জ বাংলাদেশ । প্রজেক্টেও কো অর্ডিনেটর আলতাফুর রহমান জনান, বর্তমান প্রজেক্টের মোট ডাটা এখনো আমারা তৈরী করতে পারিনি তবে আমরা কাজ করতে গিয়ে যা দেখেছি তাতে চা বাগানে মাতৃমৃত্যুর হার অস্বাভাবিক। আমাদের সর্বশেষ আরেকটি প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে মৌলভীবাজার জেলার মোট মাতৃ মৃত্যুর ৪৯ শতাংশ  চাবাগানে।

শ্রীমঙ্গল শ্রম দপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম এসব অভিযোগ মেনে নিয়ে বলেন, চা চাষের গোড়াপত্তন থেকে এই জনগোষ্টির কপালে জুটেছে শুধু অবহেলা-নির্যাতন। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। মাত্র কয়েকটি বাগানে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দেয়া হলেও বেশিরভাগ বাগানে তা নেই। তবে বর্তমান সরকার তাদের জন্য অনেক কিছু করেছে এবং প্রয়োজীয় সব কিছু করতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির চেয়ারম্যান জি এম শিবলি জানান, গত কয়েক বছরে চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু কাজ করা হয়েছে এবং তা অব্যহত আছে। প্রতিটি বাগানে স্কুল এবং চিকিৎসার  ব্যাবস্থা আমরা নিশ্চিত করেছি। কিছু সমস্যা আছে তাও সমাধান হয়ে যাবে।

মৌলভীবাজার পরিবার পরিকল্পনার উপ পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, জাতীয় পর্যায়ে মাতৃমৃত্যুও হার ১৭৩ কিন্তু মৌলভীবাজার ২১৬। কিন্তু চাবাগানের হিসেব বাদ দিলে আমাদের অবস্থান জাতীয় পর্যায় থেকেও অনেক কম হবে। চাবাগানের মাতৃ মৃত্যুও হার সাধারণ বসতি থেকে প্রায় দ্বিগুণ যার কারণে আমরা এই জেলার মাতৃমৃত্যু হার কমাতে পারছি না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত