নিজস্ব প্রতিবেদক

১০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:২১

রাজন হত্যা: এখনো শেষ হয়নি তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত

সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে হত্যা মামলার রায় হয়েছে রবিবার। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের চার মাসের মধ্যেই রায় প্রদান করা হলো। তবে মামলায় রায় হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি রাজন হত্যাকারীদের সহায়তাকারী তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ।

দায়িত্বে অবহেলা, রাজনের বাবার সাথে দুর্ব্যবহার, অর্থের বিনিময়ে মামলা গ্রহণে গাফিলতি ও কামরুলকে পালিয়ে যেতে সহযোগীতায় দায়ে জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, রাজন হত্যা মামলার বাদী এসআই আমিনুল ইসলাম ও এসআই জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তবে মামলা হলেও চার মাসেও শেষ হয়নি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত।

এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের সহকারী উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) রহমতউল্লাহ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চলছে। শীঘ্রই তদন্ত কাজ শেষ হবে। তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিলেট মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা গত রবিবার রাজন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামী কামরুলসহ ৪ জনকে ফাঁসির দন্ড দেওয়া হয়।

গত ৮ জুলাই ১৩ বছরের রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার পর মামলা করতে গেলে শিশুটির বাবা শেখ আজিজুর রহমানের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে ওই তিন পুলিশের বিরুদ্ধে। মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলামের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে দেশ ত্যাগে সহায়তা করেন তারা। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর পরই মূল ঘাতক চিহ্নিত হলেও মাত্র ২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের এবং হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগও উঠে ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১৪ জুলাই সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোশফেকুর রহমান ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (সদর দক্ষিণ) জেদান আল মুসা। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হলেও ১৭ জুলাই কমিটির মেয়াদ আরও ৫ দিন বাড়ানো হয়। কমিটির ঘটনার পর পরই মোবাইল ফোনের কললিস্ট এবং পারিপার্শ্বিক অন্যান্য অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ২৩ জুলাই রাতে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করে।

রিপোর্ট দাখিলের পর পরই পুলিশ ২৪ জুলাই ওসি আলমগীরকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড এবং সেকেন্ড অফিসার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) জাকির হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে ২৭ জুলাই ওসি আলমগীরকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়।

তবে ঘটনার ৪ মাস অতিবাহিত হতে চললেও বিভাগীয় মামলার তদন্ত আজও শেষ হয়নি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাজন হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল, সেকেন্ড অফিসার জাকির হোসেন ও ওসি তদন্তের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর আলমগীর হোসেন ‘বিতর্কিত’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

জালালাবাদ থানার ওসি (প্রশাসন) আখতার হোসেন ঘটনার দিন একটি মামলার সাক্ষ্য দিতে চট্টগ্রামে ছিলেন। ঘটনার পর নিহত রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান আলম থানায় মামলা দিতে গেলেও পুলিশ তার মামলা নেয়নি। উল্টো এসআই আমিনুল রাজনের বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। মূল আসামি কামরুল সনাক্ত হলেও এস আই আমিনুল ইসলাম নিজে বাদী হয়ে কামরুলকে বাদ দিয়ে অন্য আরও ২ ব্যক্তিকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন।

ঘটনাটি জানাজানি হবার পর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুই ব্যক্তি আজমত উল্যাহ ও ফিরোজ আলী থানায় গিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু পুলিশ তাদের বক্তব্য আমলে না নিয়ে উল্টো তাদের ওই মামলায় আসামি করেন।

অবশ্য, এ দুজনকেই আদালত রবিবার প্রদত্ত রায়ে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মামলার প্রত্যক্ষদর্শী ইসমাইল আলী আবলুছ নামের এক ব্যক্তিকে ঘটনাস্থলের কয়েক কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি থেকে ধরে এনে নাটক সাজানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতার করে ঘটনায় জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালায়।

অভিযোগ রয়েছে, জালালাবাদ থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার এসআই জাকির হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলাম মামলার মূল আসামি কামরুলকে বিদেশ পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এর বিনিময়ে প্রায় ৬ লাখ টাকা নেন তারা।

এত সব অভিযোগের পরও পুলিশের এই ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ছাড়া কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনও।

জানা গেছে, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ঐ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনের ৭২৯ ধারা, পিআরবি’র ৪৩৪৮৫৭ নং নিয়ম অনুযায়ী চাকুরী থেকে অপসারণ, চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত করণ, বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ, সতর্কীকরণ, তিরষ্কার ইত্যাদি শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়া, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট-২০০৯ (২০০৯ সালের ২৩ নং আইন)-এর ১১০ ধারাতেও পুলিশ কর্মকতাদের কর্তব্যে অবহেলার বিরুদ্ধে একই ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

তবে এই ৩ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখনও তদন্ত শেষ না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এসএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিন।

তিনি জানান, পরিদর্শক আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এডিশনাল এসপি সমপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং দুই এস আই’র বিরুদ্ধে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষ হলেই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত