বড়লেখা প্রতিনিধি

১৩ জুন, ২০২১ ১৭:০৮

পরিবেশমন্ত্রীর কাছে নানা সমস্যা তুলে ধরলেন খাসি পুঞ্জিপ্রধানরা

বড়লেখায় মতবিনিময়

ভূমি ও বিদ্যুতের সমস্যা, উচ্ছেদ আতঙ্ক, বিশুদ্ধ পানির সংকট, পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পুঞ্জি এলাকার বিদ্যালয় মেরামতের মতো নানা সমস্যার কথা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. শাহাব উদ্দিনের কাছে তুলে ধরেছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখার ১৯টি খাসি পুঞ্জি প্রধানরা।  

শনিবার (১২ জুন) রাতে বড়লেখা উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে বড়লেখার ১৯টি খাসি পুঞ্জির মান্ত্রীদের (পুঞ্জি প্রধান) সাথে মতবিনিময় করেন পরিবেশমন্ত্রী।

বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন সম্প্রতি আগারপুঞ্জিতে দুর্বৃত্তের পান গাছ কর্তন এবং বনাখলাপুঞ্জি দখলের পরিপ্রেক্ষিতে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। এতে ১৯টি খাসি পুঞ্জির মান্ত্রী (প্রধানরা) তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো তুলে ধরে মন্ত্রীর কাছে সমাধানের দাবি জানান। পরিবেশমন্ত্রী পর্যায়ক্রমে সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। রাত ৮টা থেকে ১০টায় পর্যন্ত এই মতবিনিময় হয়।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, বড়লেখা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সিরাজ উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফাদার যোসেফ গমেজ (ওএমআই) ও কুলাউড়া লক্ষীপুর মিশনের পুরোহিত ফাদার সুমির গমেজ।

এসময় ডিমাই মিশনের প্রধান শিক্ষক ফাদার দিপক কস্তা, আগারপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) সুখমন আমসে, বনাখালাপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার, সাংবাদিক লিটন শরীফ ও মাইকেল নংরুম, মাধবকুণ্ডপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) ওয়ানবর এলগিরি, সাত নম্বর পুঞ্জির সাবেক মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) প্রধান এলিয়াস বারেঃ, সেক্রেটারি পাইলট মারলিয়া, গান্দাই পুঞ্জির প্রধান রাজেস পঃস্না ছাড়াও বিভিন্ন খাসি পুঞ্জি প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।

আগারপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) সুখমন আমসে বলেন, ‘গত কয়েক মাস আগে আমাদের পুঞ্জিতে দিন-দুপুরে ৩টি গাছ বাগান কর্তৃপক্ষ কেটেছে। তারা ৪৫-৫০ টি গাছে চিহ্ন দিয়েছে গাছগুলো কেটে নিয়ে যাবে। গত (২৯ মে) আমাদের পানজুমে ঢুকে দুর্বৃত্তরা সহস্রাধিক পান গাছ কেটে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত দুস্কৃতিকারীদের কাউকে সনাক্ত করা হয়নি। আমরা সব সময় উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকি। সরকার যদি বাগানকে বন্দোবস্ত দিতে পারে, আমাদেরকে কেনো দিবে না? আমাদের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি করছি। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন দাবি করছি।’

বনাখালাপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার বলেন, ‘গত ২৮ মে স্থানীয় লোকজন দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের পুঞ্জির জুম দখল করে। এরপর ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। জুম দখল করে সেখানে তারা কয়েকটি ঘরও নির্মাণ কর। পরিবেশমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত ৪ জুন উপজেলা প্রশাসন, জেলা ও থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে জুমগুলো উদ্ধার করে দেয়। আমরা মন্ত্রী ও প্রশাসনের কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও আমাদের মাঝে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। দখলদারা পান জুম দখলের পর পান তুলে নিয়ে গেছে, বেশিরভাগ নষ্ট করে দিয়েছে। এমনকি পান জুমের কাঁটাতার কেটে ফেলেছে। দখলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি পরিবার অসহায়ত্বে দিন কাটছে। পুঞ্জিগুলো দাঁড় করাতে আরো অনেক দিন লাগবে তাদের।’



বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফাদার যোসেফ গমেজ (ওএমআই) বলেন, ‘কুলাউড়ার কাকড়া পুঞ্জিতে বাগান কর্তৃপক্ষ খাসিপুঞ্জির গাছ কেটে নিধন করেছে। খাসিয়াদের (খাসি) আয়ের উৎস পান। গাছের সাথে পানের লতা বেয়ে উঠে পান পাতা গজাতে থাকে। খাসিয়ারা সে পান পাতা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আর গাছ না থাকলে খাসিয়ারা চলবে কিভাবে। সেখানে তারা প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করে আসছে। আর এখন বাগান বলছে এটা তাদের জায়গা। এদিকে সাহেবটিলা পুঞ্জিতে বন বিভাগ দ্বারা আদিবাসি গারোরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। বন বিভাগ স্থানীয় বাঙালিদের পারিশ্রমিক দিয়ে গারোদের সহস্রাধিক পান গাছ কেটে ফেলেছে।’

বড়লেখার গান্দাই পুঞ্জির প্রধান রাজেশ পঃস্না বলেন, ‘আমাদের পুঞ্জিতে পানির অভাবে খাওয়া-দাওয়া, রান্না-বান্না ও গোসল করা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বোবারথলের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। হাঁটার অনুপযোগী, পা রাখার কোনো জায়গা নেই। কোনো মুমূর্ষু রোগী হলে রাস্তায় মারা যাবে। আমাদের রাস্তার সমস্যা সমাধানের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া সকল পুঞ্জিতে উঁচু সিঁড়ি দরকার। সিঁড়ি হলে আমাদের উঠা-নামায় কষ্ট কমবে।’

সভায় বিভিন্ন পুঞ্জির প্রধানরা তাদের বক্তব্যে আরো বলেন, ‘আমাদের বাগান থেক সাব লিজ (উপ-ইজারা) নিতে হয়। এতে অনেক ঝামেলা হয়। আমরা টাকা দেই ঠিকই কিন্তু যে কোনো সময় উচ্ছেদের আতঙ্ক থেকে যায়। সরকার থেকে আমরা সরাসারি লিজ নিতে চাই। অনেক পুঞ্জিতে বাগান কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ নিতে দেয় না। হুমকি দেয়। এছাড়া নানা সময় স্থানীয় বাঙালিরা জায়গা দখল করে। দুর্বৃত্তরা পানগাছ কেটে ফেলে। আমরা শান্তিতে জুম করে জীবিকা নির্বাহ করতে চাই। এই নিশ্চয়তাটুকু দরকার।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার আপনাদের পাশে আছে। কোনো অপশক্তি আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না। পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার খবর পেয়ে ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি দ্রুত দখলদারদের যেন উচ্ছেদ করা হয় এবং জায়গাগুলো যেনো খাসিয়াদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তারা যৌথ অভিযান চালিয়ে জায়গাগুলো দখলমুক্ত করেছেন।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের সকল সমস্যা পর্যায়ক্রমে সমাধান করে দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত যে সকল পুঞ্জি সিঁড়ি পাননি সেগুলোতে সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হবে। যে সকল পুঞ্জিতে বিদুৎ এখনও পৌঁছে নাই, বিদুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। রাস্তার কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো রাস্তা পাকাকরণ করে দেওয়া হবে। ভূমির সমস্যা সমাধানে ইউএনও এবং সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশনা দেওয়া আছে। সমস্যা সমাধানে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত