শাকিলা ববি

১৮ জুন, ২০২১ ২৩:৫৮

সিলেটে হঠাৎ বেড়ে গেছে খুনোখুনি

বুধবার (১৬ জুন) সিলেটের গোয়াইনঘাটে দুই শিশুসহ আলেমা বেগম (৩৫) নামে এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। বুধবার (১৭ জুন) রাতে নিহত নারীর বাবা আয়ুব আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে গোয়াইনঘাট থানায় মামলাটি করেন।

পুলিশ ধারণা করছে পারিবারিক বিরোধের জেরে আলেমা বেগমের স্বামী হিজবুর রহমান এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারেন।

এরআগে গত ২৮ মে দুপুরে বালাগঞ্জের গহরপুর এলাকার রতনপুর ইটভাটার ব্যবস্থাপক ধীরাজ পালকে তার কর্মস্থলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয়রা ধীরাজ পালকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই হত্যা মামলায় ৬ আসামিকে রিমান্ড নেওয়ার পরও চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

কেবল এই দুটিই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি। হঠাৎ করেই যেনো সিলেটে বেড়ে গেছে খুনোখুনি।

সিলেট জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ১৮ জুন ২০১৯ থেকে ১৭ জুন ২০২০ পর্যন্ত ৫৩টি হত্যা মামলা হয়েছে সিলেটে। অপরদিকে ১৮ জুন ২০২০ থেকে ১৭ জুন ২০২১ পর্যন্ত ৬১টি হত্যা মামলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে গৃহবন্দি থেকে দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন, অনৈতিক সম্পর্ক যাওয়ার কারণে পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি করোনার কারণে আদালতের অনেক সীমাবদ্ধতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও ছোটখাটো সমস্যা থেকে মানুষজন হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ৩০ এপ্রিল রহস্যজনকভাবে মারা যান সিলেটের আইনজীবী আনোয়ার হোসেন। পরকীয়া প্রেমের জেরে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আনোয়ারকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তার স্ত্রী শিপা বেগম। ১৩ জুন বিকেলে শিপা বেগম সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুর রহমানের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

এদিকে, গত ৭ জুন সিলেট নগরের কাজীটুলা এলাকার যুবক রাবিদ আহমদ নাজিম (২৭) রহস্যজনকভাবে মারা যান।

সোমবার সকালে ওই এলাকার একটি ভবনের নিচ থেকে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধারের কথা জানানো হয়। দুপুরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।

এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করে নাজিমের পরিবার। এরপর নাজিমের সাথে কাজীটুলা উঁচা সড়কের একটি ফ্ল্যাটে একসাথে থাকা খালাতো ভাই-বোন পরিচয়দানকারী তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে শাহনিয়া বেগম ও  তার ভাই আকবরকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

সিলেট জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩১৬টি হত্যা মামলা হয়েছে।  এর মধ্যে ১ জুন ২০১৭ থেকে ১৭ জুন ২০১৮ পর্যন্ত ১১৭টি হত্যা মামলা, ১৮ জুন ২০১৮ থেকে ১৭ জুন ২০১৯ পর্যন্ত ৮৫টি হত্যা মামলা, ১৮ জুন ২০১৯ থেকে ১৭ জুন ২০২০ পর্যন্ত ৫৩টি হত্যা মামলা,  ১৮ জুন ২০২০ থেকে ১৭ জুন ২০২১ পর্যন্ত ৬১টি হত্যা মামলা হয়েছে।

সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মো. লুৎফর রহমান বলেন, সিলেটে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে বিভিন্ন কারণে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক কলহ ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে। মানুষজন এখন তুচ্ছ কারণেও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে।

এ ব্যাপারে সিলেট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক সেলিম বলেন, শুধু সিলেট নয় সারা দেশে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। তবে সিলেটে ইদানীং অবস্থা খুব খারাপ। গত দুইমাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সিলেটে। এই হত্যা থেকে বাদ পড়েননি আমাদের পেশার মানুষও। আমার মনে হয় এই করোনাকালে দীর্ঘ সময় মানুষজন ঘরে থেকে, আর্থিক অভাব অনটনে মানুষের মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। স্বামী স্ত্রী পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়ছেন। তুচ্ছ ঘটনায় যে কেউ অন্যের উপর চড়াও হন। যার পরিণতি হয় হত্যা। ইদানীং হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলেও প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু তদন্তে ঠিকই বেরিয়ে আসে এটা হত্যাকাণ্ড।

ফজলুল হক সেলিম আরও বলেন, এই করোনাকালে আদালতে গিয়ে মামলা করা যায় না। আদালতের অনেক সীমাবদ্ধতা বেড়ে গেছে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে ঘরে বসে জামিন নেওয়া যায়। এসব সুযোগ থাকার কারণেও মনে হয় মানুষজন হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করতে উৎসাহী হচ্ছেন।

সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (এমএন্ডসিএ) জেদান আল মুসা বলেন, আমার দীর্ঘ দিনের কাজে অভিজ্ঞতায় এটা বলতে পারি সিলেটে অনেক তুচ্ছ কারণে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে পারস্পরিক বিরোধ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে হত্যাকাণ্ডতো আছেই। এছাড়াও মানুষজন এখন অতি তুচ্ছ কারণে আরেকজনকে হত্যা করে ফেলে।

তিনি বলেন, আসলে আমাদের মধ্যে এখন আর আগের মত পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন নেই। আপনজনের প্রতি আস্তা, মূল্যবোধ নেই। কেউ কাউকে সাহায্য করতে চান না। তাই স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করছে। স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করছে। ছেলে মাকে হত্যা করছে। আর মা ছেলেকে হত্যা করছে।  

জেদান আল মুসা বলেন, এই করেনাকালে সামাজিক অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। মানুষজন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার এটাও একটা কারণ।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র আইনি ভাবে শাস্তি দিয়ে এই অপরাধমূলক কাজ থেকে মানুষকে ফেরানো যাবে না। মানুষের এই নৃশংস মনোভাব থেকে উত্তরণের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব জায়গা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই সমাজের প্রতি সবার দায়িত্ব আছে। পরিবারের মা বাবা কিংবা বড়দের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি পাড়ার মুরব্বি, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পূজারী, স্কুলের শিক্ষক সবার দায়িত্ব আছে। যখন মানুষজন সমাজের একটি সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা মনে করে সেটা সমাধানের চেষ্টা করবেন তখন কিছুটা পরিবর্তন আসবে। হত্যাকাণ্ডের মত এমন নৃশংস কাজ থেকে মানুষের ধ্যান ধারনা সরিয়ে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত