সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

১২ অক্টোবর, ২০২১ ০১:৩৩

পূজায়ও আনন্দে নেই ঝুমন, আছে শঙ্কা

‘পূজায় সবাই আনন্দ করলেও আমার মনে আনন্দ নেই। মাথায় সব সময়ই দুশ্চিন্তা কাজ করে। কী করব, কীভাবে পরিবার চালাব- এসব ভেবেই কোনো কূলকিনারা পাই না।’

-বলছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা ঝুমন দাস। হেফাজতের বিতর্কিত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যিনি সাড়ে ছয় মাস কারাগারে ছিলেন। সম্প্রতি মুক্তি পেলেও দীর্ঘ কারাবাসে নিজের ছোট্ট ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। ফলে জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই তরুণ।

সোমবার থেকে শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। তবে ঝুমনের মনে নেই পূজার আনন্দ।

দুর্গাপূজায় নতুন পোশাক কেনেন সকলে। তবে ঝুমন এবার নিজের আট মাস বয়সী ছেলেকেও নতুন পোশাক কিনে দিতে পারেননি।

সোমবার আলাপকালে ঝুমন দাস বলেন, ‘কাজকর্ম নাই। আই রোজগার নাই। সারা দিন ঘরে বসে থাকিব। এমন অবস্থায় আর পূজার আনন্দ কোথায়। পূজায় মা-স্ত্রীর জন্য কিছু কিনতে পারিনি। এমনকি ছোট্ট ছেলেটার জন্যও কিছু কিনে দিতে পারিনি। এজন্য খুব খারাপ লাগছে।

‘মামলায় জামিনে থাকলেও আমি কোথাও যেতে পারি না, আমাকে কর্মসংস্থান দেয়া হলে ভালো হতো। চাকরি ইন্টারভিউ দিতে গেলেও আমাকে হয় যেতে হবে ঢাকা না হয় সিলেট। কিন্তু আমি তো যেতে পারব না। আদালত শর্ত দিয়েছে সুনামগঞ্জের বাইরে না যেতে।’

পরিবারের ছোট ছেলে ঝুমন দাস। জামিন পেয়ে বর্তমানে গ্রামের বাড়িতেই রয়েছেন তিনি। পূজায় বড় ভাই নূপুর চন্দ্র দাস একটি নীল পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছেন তাকে।

এ তথ্য জানিয়ে ঝুমন বলেন, ‘সেই পাঞ্জাবি দিয়েই এবারের পূজা করব। আর বউ বাচ্চা আমার দুই বোনকে একটি সংগঠন থেকে পূজার কাপড় দিয়ে গিয়েছে, তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।’

তিনি বলেন, ‘আগে আমি একটি কাপড়ের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতাম। এ ছাড়া বড় ভাইয়ের দেয়া টাকা দিয়ে সুনামগঞ্জ শহরে একটি প্রসাধনীর ব্যবসা দিয়েছিলাম। যা এখন আর নেই। জেলে গিয়ে আমার সব শেষ।’

শর্ত সাপেক্ষে জামিনে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে বলেন, ‘স্থায়ী জামিন পাওয়া গেলে আমি কাজকর্ম করে নিজের সংসারের হাল ধরতে পারব।’

পূজায় এলাকার পাশের মণ্ডপে যাবেন ঝুমন। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে এলাকার বাইরে কোথাও প্রতিমা দেখতে যাবেন না বলে জানান তিনি।

দীর্ঘ ছয় মাস জেলে থাকার পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক বছরের জন্য ঝুমন দাসকে জামিন দেয় হাইকোর্ট। এ সময় হাইকোর্ট জামিনের মধ্যে আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে বা সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে পারবেন না এমন নির্দেশনা দেয়। পরে ২৮ সেপ্টম্বর রাতে সুনামগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি হয় তার।

এর আগে গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলন’ নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন। এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের ঝুমন দাস। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন।

মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচার চালাতে থাকেন তার অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

পরদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি, মন্দিরে। ঝুমনের স্ত্রী সুইটিকে পিটিয়ে আহত করা হয়।

এরপর ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল করিম।

শাল্লায় হামলার ঘটনায় শাল্লা থানার এসআই আব্দুল করিম, স্থানীয় হাবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ও ঝুমন দাসের মা নিভা রানী তিনটি মামলা করেন। তিন মামলায় প্রায় ৩ হাজার আসামি। পুলিশ নানা সময়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তারা সবাই এখন জামিনে।

শুধু জামিন পাচ্ছিলেন না ঝুমন দাস। বিচারিক আদালতে পাঁচ দফা তার জামিন আবেদন নাকচ হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা চলছিল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত