নিজস্ব প্রতিবেদক:

২৫ জুন, ২০২২ ১৯:৩৬

দিন যেমনতেমন, রাত কাটে আফাল, সাপ আর ডাকাত আতঙ্কে

বড়লেখায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত, আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ হাজার পরিবার

ঢেউ ঘরের ভিটার মাটি ভাসিয়ে নিয়েছে। মাটিশূন্য ভিটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ঘর। কোনোটার বেড়া ভেঙে পড়েছে। টিকে থাকতে না পেরে বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই ছুটে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কেউবা গেছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। জনহীন বাড়িঘর পড়ে আছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর পারের মুর্শিবাদকুরা, বড়ময়দান, দুর্গাই, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, শ্রীরামপুরসহ বেশিরভাগ গ্রামে এখন এরকম ঘরবাড়ির সংখ্যা অনেক।

তালিমপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজার থেকে নৌকা করে পশ্চিম গগড়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে পানিবন্দি বাড়িগুলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায়, অনেক বাড়িরই ভিটে বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে ঢেউ থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক ঘরের ভিটার মাটি হাওরের ঢেউয়ে ভেসে গেছে। মাটি ভেসে যাওয়ায় ঘরের তলা ফাঁকা হয়ে আছে।

গ্রামের আমিনা বেগমের ঘরসহ বেশকিছু ঘর দেখা গেল, ঢেউ ঘরের ভিটার মাটি ভাসিয়ে নিয়েছে। মাটিশূন্য ভিটের মধ্যে ঘর দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির লোকজন অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। আমিনা দিনের বেলায় বাড়িতে থাকেন। রাতে নানা বাড়ি চলে যান।

পশ্চিম গগড়া গ্রাম থেকে হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু আমিনা বেগমের পরিবার সেখানে আশ্রয় নেয়নি।

আমিনা বেগম বলেন, ‘বন্যার শুরুর দিকে আমরা ধান-চাল অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছি। এগুলো ক্ষতি হয়নি। মা-আমি নানা বাড়ি থাকি রাতে। ছোট ভাই রাতে বাড়িতে থাকে। রাতে ঢেউ আর সাপের আতঙ্ক থাকে।’

আমিনা জানালেন, বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা। তাদের একমাত্র টিউবওয়েল ডুবে গেছে। খুব কষ্ট করে তারা খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।

নৌকায় যেতে যেতে কথা হচ্ছিল পশ্চিম গগড়া গ্রামের অনন্ত দাসের সাথে। তিনি মূলত ভ্যান চালক। অনন্ত বলেন, ‘প্রায় ১৫ দিন থেকে রুজি বন্ধ। বাজারে পানি ওঠায় বুক সমান পানিতে তার ভ্যানগাড়িও ডুবে গেছে। কোথাও রুজি করতে পারছি না। কত কষ্টে আছি বুঝাতে পারব না। এমন একটা অবস্থায় আছি, কারো কাছে সাহায্যও চাইতে পারছি না। সাহায্য চাইলেও দিবেও না। বলবে সুস্থ সবল মানুষ। কিন্তু এক টাকাও রুজি করার পদ্ধতি নাই। পানি কবে নামবে আর আমাদের দুঃখ কষ্ট গুছবে।’

কথা বলতে বলতে চোখ পড়ল অনন্তের পায়ের দিকে। গুটি বসন্তের মতো তার দুই পায়ে দাগ পড়ে আছে। এটা কিসের দাগ জিজ্ঞেস করতেই অনন্ত আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমরার কষ্টের কোনো সীমানা নেই। পানিতে দুর্গন্ধ, মাইনষের (মানুষের) শরীরে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ দেখা দিছে। আমারও এইরকম। ওষুধ কিনতাম টাকা নাই। কপালে যা হয় হবে।’

শুধু অনন্ত দাসই নয় তার মতো আরও অনেকের শরীরে এরকম গুটি বসন্তের মতো দাগ দেখা গেছে। তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই রোগটা বন্যার পানি আসার পর থেকেই হয়েছে। বিশেষ করে পরিবারের নারী সদস্যদের বেশি হচ্ছে।

পশ্চিম গগড়া গ্রামের অপর্ণা রানী দাস বলেন, ‘চুলা-উলায় পানি। রান্দি-বাড়ি খাওয়ার উপায় নাই। পানির মধ্যে অনেক রোগ আইছে। আমরার হাত-পায়ের অবস্থা নাই। পচে গেছে।’

প্রমোধ রঞ্জন দাসের পরিবার পশ্চিম গগড়া গ্রামের স্বচ্ছল পরিবার হিসেবেই পরিচিত। বন্যায় তার বাড়ির উঠানে পানি ছিল। কিছুটা নেমেছে। তবে তার দুর্ভোগ কমেনি। তিনি বলেন, ‘কষ্ট করি থাকা যায় দিনে যেমন তেমন। রাত হলেও চিন্তা সাপ আর ডাকাতের। কারেন্ট নাই বন্যার শুরু থেকেই বলা যায়। একদিন দিছে মাত্র আর নাই। হাওরের মাঝে চারদিকে পানি আর পানি। রাতে কারেন্ট না থাকলে কিরকম লাগে। বুঝাইতাম পারতাম নায়। বৃহস্পতিবার রাতে ডাকাত এলাকায় আইছে কইয়া মাইকিং অইছে। কি ভয়ে রাইত গেছে আমরা জানি। অন্তত কারেন্টের ব্যবস্থা থাকলে কষ্ট দূর অইত।’

তালিমপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য গগড়া গ্রামের বাসিন্দা সুজিত দাস বলেন, ‘এ বন্যায় হাওরপারের মানুষ এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। হাওরপারের মানুষের দিন যেমনতেমন। রাত কাটে আফাল (ঢেউ), ডাকাত আর সাপ আতঙ্কে। এর মাঝে বিদ্যুৎ নাই প্রায় ১৫-২০ গ্রামে। মানুষের রান্নার কষ্ট। শৌচাগারের কষ্ট। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। টিউবওয়েল পানির নিচে। এখন ধনী-গরিব সব সমান। বাজার ঘাট পানির নিচে। কেউ বাজারও করতো পারের না। অনেকের ঘরে কোমর সমান পানি। রান্না করাই কষ্ট কর।’

হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক সপ্তাহ থেকে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর, তালিমপুর, বর্নি ও দাসেরবাজার ইউনিয়নে বন্যা দেখা দেয়। ওই সময় থেকে এসব গ্রামের বেশ কিছু পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করে। আর কিছু পরিবার রয়ে যায় তাদের বাড়িতে। গত মঙ্গলবার রাতের বৃষ্টিতে পানি আরও বাড়তে শুরু করলে যারা বাড়িতে রয়ে গিয়েছিল, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পানি আরও বাড়লে ঘর ছাড়ার আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তারা।

শনিবার (২৫ জুন পর্যন্ত) বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এই তিন ইউনিয়ন ছাড়াও নিজবাহাদুরপুর, উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণ শাহবাজপুর, বড়লেখা সদর ও দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।

বড়লেখা উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার পানি বিশুদ্ধ করণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রেসহ ১৫টি নলকূপের প্লাটফর্ম উচুকরণ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ২০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মওজুদ রয়েছে। যেখানে দরকার সেখানেই বিতরণ করা হচ্ছে।’

পল্লীবিদ্যুতের ডিজিএম এমাজ উদ্দিন সরদার শনিবার বিকেলে বলেন, ‘হাকালুকি হাওর এলাকায় লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। পল্লীবিদ্যুতের লোকজন লাইন মেরামতে কাজ করছেন।’

পানিবাহিত রোগব্যাধি বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রত্নদীপ বিশ্বাস বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে পানির কারণে চর্ম রোগের খবর পাচ্ছি। ওষুধের জন্য আমরা বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ আসলে আমরা মানুষের মাঝে ওষুধ বিতরণ করব। এছাড়া আমাদের মেডিকেল টিম বন্যা দুর্গত এলাকায় কাজ করছে।’

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী শনিবার বিকেলে বলেন, ‘৫০টি আশ্রয় কেন্দ্রে তিন হাজারেরও বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজ খবর রাখছি। শনিবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড়লেখায় ৫০০ মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত