
১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৯:১৭
সিলেটের সদর উপজেলার ২নং হাটখোলা ইউনিয়নের পাগইল গ্রামের একটি ক্ষেতের পাশে ৫ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করছেন কৃষক রমজান আলী। এত কমদামে কেন বিক্রি করছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, 'রাজা জাতের টমেটোর বীজ কিনে চাষ করেছি। কিন্তু ফসল ফলার পর দেখি এটা ইপক জাত। এই সিজনে এই জাতের টমেটো দাম কম। তাই এত কমদামে বিক্রি করতে হচ্ছে। টমেটোর বীজে জালিয়াতি করেছে কুশিয়ারা বীজঘর কোম্পানি। প্যাকেটে গায়ে মঙ্গলরাজা লিখে ভিতরে ইপকের বীজ দিয়ে দিছে। এখন যা লোকসান সব আমার।
রমজান আলীর মত সিলেটের সদর উপজেলার ২নং হাটখোলা ইউনিয়নের নোয়ারগাও, ফকিরেরগাও, দুখড়ি, উমাইরগাও, পাগইল, কালারুকা, নন্দিরগাও, বাবুরাগাও, দিঘিরপাড়, বাঘজুর, রায়েরগাও, নোয়াপাড়া গ্রামের শতাধিক কৃষক কুশিয়ারা বীজঘরের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগী কৃষক ও সিলেট সদর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কুশিয়ারা বীজঘরের এই বীজ প্রতারণা উপজেলা প্রশাসনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে এই অভিযোগের ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কক্ষে বসা হয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসকের সামনে কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটু স্বীকার করেন তার ২১ শত প্যাকেট বীজ ভেজাল এসেছিল। এবং সে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। বরং এই বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সব অস্বীকার করছেন কুশিয়ারা বীজঘরের মালিক লিটু।
ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাস চারেক আগে তারা কুশিয়ারা বীজঘর থেকে মঙ্গল রাজা জাতের টমেটোর বীজ ক্রয় করে প্রায় ২৫০ হেক্টর জমি চাষ করেন শতাধিক কৃষক। কুশিয়ারা কোম্পানি তাদেরকে রাজা জাতের টমেটো বলে বীজ দিলে তা চাষ করে দেখেন ফলন এসেছে ইপক জাতের টমেটো। প্রায় একশো কৃষকের ৫০ হেক্টর জমিতে রাজার জায়গায় ইপক জাতের টমেটো ফলন হয়েছে। এতে করে এই কৃষকরা মূল রাজা জাতের টমেটোর ফলন থেকে বঞ্চিত হন। ফলে তাদেরর এক এক জনের বিঘা প্রতি প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উপরে ক্ষতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী কৃষক খিজির উদ্দিন বলেন, আমরা দরিদ্র ক্ষুদ্র কৃষক। আমি বীজ নিয়ে চারা করে কৃষক পর্যায়ে বিক্রি করি। এলাকার মানুষ বেশিরভাগ বাকীতে চারা নেন। ফসল বিক্রি করে টাকা দেন। কিন্তু কুশিয়ারা বীজঘরের কারণে এবার কেউ আমাকে টাকা দিচ্ছেন না। কারণ যে জাতের টমেটোর চারা আমি দিয়েছি সেটা ফলন হয়নি। এই শীতের সিজনে সামান্য লাভের আশায় রাজা জাতের টমেটো চাষ করেন কৃষকরা। কিন্তু কুশিয়ারা বীজঘরের এই বীজ প্রতারণার কারণে আমিসহ মাঠপর্যায়ের কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটুর সাথে কথা বলে কোনো সমাধান না পেয়ে আমরা ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক সহ যখন বসা হয় তখন কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটু স্বীকার করেন তার ২১ শত প্যাকেট বীজ ভেজাল আসছে। এবং সে ক্ষতিপূরণ দেবে। এখন কি ক্ষতি পূরণ দেবে সেটা আমাদেরকে এখনো জানানো হয়নি।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. আজমল আলী বলেন, আমি ৯০শতক জমিতে টমেটো চাষ করেছে। রাজা টমেটোর বীজ বলে কুশিয়ারা বীজঘর ইপক টমেটোর বীজ দিয়েছে প্যাকেটে। এখন এই সিজন পুরোটাই আমার লস। এই টমেটো চাষ করতে যে টাকা খরচ হয়েছে সেটাই উঠেনি। আমরা শুনেছি যে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদেরকে আগামী বছর ফ্রি বীজ দেবে। কিন্তু বীজ দিয়ে ক্ষতিপূরণ কিভাবে হয়। আমাদের জনপ্রতি জমিতে চাষ করতে সব মিলিয়ে খরচই হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। রাজা টমেটোর ফলন আসলে আমরা প্রায় এক থেকে দুই লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারতাম। এখন ৬৫০ টাকার বীজের প্যাকেট দিয়ে এই লাখ টাকার ক্ষতি কিভাবে পূরণ হবে। লিটু আমাদেরকে ক্ষুদ্র কৃষক মনে করে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। অথচ সে নিজে ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারও মাঠ পরিদর্শন করে এই বীজ প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু সে বড় ব্যবসায়ী তাই তার প্রোরণা প্রমাণ হওয়ার পরও তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি এবং আমাদের কোনো ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়নি।
কৃষক পর্যায়ে বীজ বিক্রয়কারী শিবের বাজার এলাকার রিটেলার শামছুল বলেন, আমার দোকান থেকে টমেটোর বীজ যারা কিনে নিয়ে চাষ করে প্রতারিত হয়েছেন তারা সবাই ফসল ফলার পরই আমার দোকানে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমি এ ব্যাপারে কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটুকে জানিয়েছি। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমি রিটেলার। তাদের কাছ থেকে বীজ কিনে এনে বিক্রি করি। কিন্তু তাদের ভুলের খেসারত আমাদের মত রিটেলারদের দিতে হয়।
কুশিয়ারা বীজঘরের বীজ প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে সিলেট সদর উপজেলা কৃষি অফিসার অপূর্ব লাল সরকার বলেন, টমেটো বীজের এই প্রতারণার বিষয়টির অভিযোগ কৃষকরা আমাদের কাছে করেন। এরপর আমরা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। এবং যখন এই অভিযোগের বিষয় নিয়ে বসা হয় তখন কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটু স্বীকার করেন তার ২১ শত প্যাকেট বীজ ভেজাল এসেছিল। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।
এ ব্যাপারে কুশিয়ারার বীজঘরের সত্ত্বাধিকারী লিটু এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের কিছু হয়নি। আমরা কেন ক্ষতিপূরণ দেব।
আপনার মন্তব্য