০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১৬:৩৫
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট–কোম্পানীগঞ্জ–জৈন্তাপুর) আসন নিয়ে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ ও চাপা অসন্তোষ।
এই আসনে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। তবে অন্য মনোনয়ননপ্রত্যাশীরা তা মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষত আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল হাকিম চৌধুরীর সমর্থকরা প্রকাশ্যেই বিক্ষোভ করছেন।
আরিফকে সিলেট-৪ আসনে ‘বহিরাগত’ দাবি করে এই আসনে ‘লোকাল প্রার্থী’র দাবিতে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ। যারা হাকিম চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এ দাবিতে গত বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাত থেকে শুরু করে পরদিন শুক্রবার (৮ নভেম্বর) মধ্যরাত পর্যন্ত গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথক মিছিল ও মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাত ৯টা থেকে শুরু হয়ে মিছিল চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। সালুটিকর-গোয়াইনঘাট মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে জড়ো হয়।
মিছিলে অংশগ্রহণকারী কর্মীরা ‘লোকাল চাই হাকিম ভাই’, ‘আর নয় বিদেশি, এবারে স্বদেশি’, ‘হাকিম ছাড়া মানব না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাত দুইটার পর কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তত ১৩টি স্থানে দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’-এর মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুল হাকিম চৌধুরীর সমর্থনে খণ্ড মিছিল বের হয়। একই সময়ে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিন আহমদের সমর্থকরাও ‘লোকাল চাই, হেলাল ভাই চাই’ স্লোগান দেন।
এ ব্যাপারে আব্দুল হাকিম চৌধুরী বলেন, “দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমি তা মেনে নেব। তবে জামায়াতপন্থী বা বাইরে থেকে আনা প্রার্থী হলে এখানে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ভোটাররা স্থানীয় মুখ দেখতে চায়।”
একই দাবি জানিয়েছেন হেলাল উদ্দিন আহমদও। তিনি বলেন, “দলীয় হাই কমান্ড এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। আমি স্থানীয় প্রার্থী, এলাকার মানুষ আমাকে চায়। দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত আমি প্রচার চালিয়ে যাব।”
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী বলেন, “আমি এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। যাকে দল মনোনয়ন দেবে, আমরা সকলে মিলে তার পক্ষে কাজ করব।”
আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশে তিনি সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যদিও বিএনপি থেকে আনুষ্ঠানিকবভাবে এ আসনের ব্যাপারে কোন ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
গত ৬ নভেম্বর রাতে ঢাকা থেকে মনোনয়ন নিয়ে সিলেট ফেরার পর ৭ নভেম্বর শুক্রবার বাদ জুমা গোয়াইনঘাটের রাধানগর বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করে প্রয়াত এমপি দিলদার হোসেন সেলিমের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেন।
আরিফুল হক বলেন, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাকে আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন। খুব শীঘ্রই দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। “এই আসনের প্রতিটি অলিগলি আমার পরিচিত। আমি জনগণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত। দলের মনোনয়নে যদি নির্বাচিত হই, তাহলে প্রথম এক বছরের মধ্যেই স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করব। যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা সবাই আমাদের ত্যাগী ও সম্মানিত নেতা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব।
গত সোমবার (৩ নভেম্বর) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। সিলেটের ৬টি আসনের মধ্যে সিলেট-০৪ ও সিলেট-০৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা দেয়নি দলটি। এরপর থেকেই সিলেট-০৪ আসন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। কে ছিনিয়ে আনছেন পর্যটনখ্যাত এ আসনের মনোনয়ন?
সিলেট-০১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান বিএনপি চেয়ারপার্সনের অন্যতম উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। আরিফুল হক চৌধুরীও এ আসনের মনোনয়ন পেতে লবিং করেছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে তিনি পরদিনই চলে যান ঢাকায়। এরপর ৫ নভেম্বর রাতে গণমাধ্যমকে তিনি জানান, দলের পক্ষ থেকে তাকে প্রার্থী মনোনীত করা হয়েছে।তিনি দাবি করেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছেন। দু’দিন ঢাকায় অবস্থান করে সিলেটে ফিরে শুক্রবার থেকে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছেন। ঐদিন এ আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত দিলদার হোসেন সেলিমের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু করেন নির্বাচনী প্রচারণা।
এদিকে আরিফুল হক এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ায় তাঁর সমর্থকদের মধ্যে উল্লাস করতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, আরিফুল হক কাজের মানুষ। সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম.সাইফুর রহমানের হাত ধরে উন্নয়ন করতে শিখেছেন। যার কারণে সিলেট সিটি কর্পোরেশনে দুই বার মেয়র নির্বাচিত হয়ে উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছেন যা আগের মেয়র দ্বারা সম্ভব হয়নি। তিনি সিলেট-০৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে অবহেলিত এ জনপদে উন্নয়নে অতিথের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে যাবে।
কিন্তু সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক দুইবারের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান এবং সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আবদুল হাকিম চৌধুরীর অনুসারীরা কোনভাবেই আরিফকে মানতে নারাজ। তারা বলছেন, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে আমরা সবসময় হাকিম চৌধুরীকেই পেয়েছি। প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থানে থাকা হাকিম চৌধুরীর বাড়ি ওই নির্বাচনী এলাকায়। আরিফুল হক এখানকার বাসিন্দা নন। যে কারনে নির্বাচনী এলাকায় তারা ‘অতিথি প্রার্থী’ কাউকে চায় না। স্থানীয় প্রার্থী হিসেবে হাকিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য দলের হাই কমান্ডের প্রতি জোর দাবি তাদের।
এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সামসুজ্জামান জামান, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দীন ও সাবেক সাংসদ দিলদার হোসেন সেলিমের স্ত্রী এডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম।
সম্প্রতি আরিফুল হক চৌধুরী নিজেকে এ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করার পর তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অভ্যন্তরী কোন্দল ও টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয় বিএনপির নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকায়, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তবে কেন্দ্র থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা চূড়ান্ত হলে মাঠের বাস্তবতা সমর্থন জোগাবে, সেটি নির্ভর করবে দলের সাংগঠনিক শক্তি ও প্রার্থীর গণভিত্তির ওপর।
আপনার মন্তব্য