নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, মৌলভীবাজার

২২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ ১২:২০

মৌলভীবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্মচারীদের দুর্বিষহ জীবন

জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটিতে কাজ করছিলেন মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের তুলাপুর গ্রামের পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান অলক দাস (২৪)। কিন্তু কর্মরত অবস্থায় লাইনের বিদ্যুৎই কেড়ে নিল অলকের প্রাণ। সে হরিচরণ দাসের ছেলে। তিনি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। একই দিন নারায়নগঞ্জে লাইনে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যান লাইনম্যান জহির (২৮)। জহিরের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া থানায়। এভাবে একের পর এক জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও পল্লী বিদ্যুতে কর্মরত কর্মচারীদের নেই দুর্ঘটনা জনিত ক্ষতিপূরণের সুযোগ। নেই অভার টাইমের মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় নিয়োজিত কর্মচারীরা দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছেন।
    ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার পরও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা ঝুঁকি ভাতা পেতে আন্দোলন করে নামেমাত্র ঝুঁকি ভাতা পেলেও অভার টাইমের মজুরিসহ আনুষঙ্গিক সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এই পেশায় কাজ করতে গিয়ে লাইনম্যানরা বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেলে অথবা পঙ্গুত্ব বরন করলে দুর্ঘটনা জনিত পরিবার কোন ক্ষতিপুরণ পাচ্ছে না। গত বছরের ১১ অক্টোবর কর্মরত অবস্থায় ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে দুই লাইনম্যান বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেলেও সমিতির পক্ষ থেকে তাঁদের পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। এই পেশায় নিয়োজিত লাইনম্যানদের পরিবার পরিজন নিয়ে দুঃখ কষ্টে চলছে জীবন।   
    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সহ দেশের বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনস্থ কর্মচারী লাইনম্যানরা দিন রাত কাজ করলেও অভার টাইমের মজুরি পাচ্ছেন না। আন্তজার্তিক শ্রম আইন ও সরকারী আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টার বাইরে অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুন মজুরী প্রদানের কথা থাকলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত এই শ্রমিকদের বেলায় তার কিছুই জুটছে না বলে কর্মচারীরা অভিযোগ তোলেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাইনম্যানরা জানান, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এই দায়িত্ব খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের সরকার নির্ধারিত সময়সূচির পরেও ঝড়-বৃষ্টিতে রাতের অন্ধকারে বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন খুঁটিতে উঠে ৫/৬ ঘন্টা এমনকি বন্ধের দিনও কাজ, সবমিলিয়ে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। এই অতিরিক্ত সময়ের কোন পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। শনিবার দিবাগত মধ্য রাতে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আকষ্মিক ঘুর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই রাত থেকেই শ্রমিকরা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। লাইনম্যানরা অভিযোগ করে বলেন, সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ার পর কর্মকর্তাদের নির্দেশে আবারও তারা কাজে যেতে বাধ্য হন। বিদ্যুৎ লাইনে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, আবার কেউ কেউ পঙ্গুত্বও বরন করছেন। এ পর্যন্ত সারা দেশে কর্মরত অবস্থায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে ১১০ জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়। ১৯৯৭ সালে এই পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের অভার টাইমের মজুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে অভার টাইমের ভাতা হিসাবে মাসিক ৪ থেকে ৬শ’ টাকা হারে প্রদান করা হয়।
    লাইনম্যানরা জানান, এরশাদ সরকারের আমলে অর্ডিন্যান্স করে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বাতিল করা হয়। দীর্ঘদিন যাবত ট্রেড ইউনিয়ন না থাকায় বিধি মোতাবেক বদলি না করে কর্মকর্তাদের ইচ্ছেমতো সিন্ডিকেট অনুযায়ী বদলি করা হয়। এছাড়াও যেসব লাইনম্যানরা ট্রেনিং দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের পরবর্তী পদোন্নতি বন্ধ রেখে বাইরে থেকে এসব পদে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। সমিতির এসব কর্মচারীদের ৭/৮ বছর যাবত দক্ষতার প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে না এবং টাইমস্কেল থেকেও তারা বঞ্চিত রয়েছেন। ঝুঁকি ভাতা ও অভার টাইম ভাতা এসব বিষয়ে লাইনম্যানদের পক্ষে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ২০১২ সনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে বেঞ্চে একটি রিট করেন। এটি এখন শুনানীর পর্যায়ে রয়েছে। তারা আরো বলেন, তাদের কোন ঝুঁকি ভাতাই ছিলনা। আন্দোলনের ফলে ১৫শ’ টাকা ঝুঁকি ভাতা পাচ্ছেন। যা একেবারে নগন্য। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তাদেরও ঝুঁকি ভাতা এবং ওভারটাইম ভাতা প্রয়োজন। পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যানরা নিজেদের উদ্যোগে কর্মীদের সহায়াতার জন্য একটি ফান্ড সৃষ্টি করেছেন। কর্মরত কোন কর্মী মারা গেলে ওই ফান্ড থেকে এককালীন কিছু সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ একেবারেই নিরব।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী এএসএম হাসনাত হাসান বলেন, তাদের ঝুঁকি ভাতা দেয়া হচ্ছে। মারা গেলে কিছু সহায়তা দেয়া হয়। সরকারের নিয়মাবলীতে যা আছে তাই দেয়া হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত