শাকিলা ববি, হবিগঞ্জ

২১ অক্টোবর, ২০১৬ ১৩:০৫

কেন অশান্ত হল বাহুবল

বাহুবলে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার ঘুষ-দুর্নীতির প্রতিবাদে ছাত্রদের স্মারকলিপি প্রদানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কেন অশান্ত হয়ে উঠল? যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষক নিগৃহীত হলেন, ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হলো? এ প্রশ্ন বৃহস্পতিবার ছিল মানুষের মুখে মুখে। উপজেলা সদরের ঐহিত্যবাহী দীননাথ ইন্সটিটিউশন মডেল হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা বুধবার বেলা ১১টায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে থানা ভবনের গ্লাস ভাংচুর এবং ৫ জন গুলিবিদ্ধ সহ অন্তত: ৩০ জন ছাত্র-জনতা আহত হয়।


ঘটনার পরদিন  বৃহস্পতিবার সকালে দীননাথ ইন্সটিটিউশন মডেল হাইস্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাঝে একটি শোকাবহ পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে দেখা যায় সবাই ঘিরে ধরেছেন সিনিয়র শিক্ষক অশোক আচার্য ও মহীউদ্দিনকে। তারা বর্ণনা করছেন তাদের সাথে পুলিশের বর্বর আচরণের। বুধবার মিছিল থেকে তাদের ধরে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন চালিয়েছিল পুলিশ।

শিক্ষক অশোক আচার্য বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়কে স্মারকলিপি প্রদান শেষে আমরা সারিবদ্ধ ভাবে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিদ্যালয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। আমি সহ কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রীদের সারির সামনে ছিলাম। থানার সামনে আসার সাথে সাথে লক্ষ্য করলাম আমাদের মাইক বহনের রিক্সায় থাকা ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ফেরদৌস আহমেদ হৃদয়কে বেধড়ক লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। আমি কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাওয়ার সাথে সাথে থানার ওসি (তদন্ত) বিশ্বজিৎ ও এসআই দেলোয়ার আমার শার্টের কলার ধরে আমাকে মারতে মারতে টেনে হেছড়ে থানায় নিয়ে যায়। এ অবস্থায় আমার সহকর্মী শিক্ষক মহীউদ্দিন এগিয়ে এলে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঝাপটে ধরে মারধোর শুরু করে। পুলিশ সদস্যরা প্রথমে আমাকে থানা কমপ্লেক্সের মাঠে ফেলে লাঠিপেটা করে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতরে ডিউটি অফিসারের রুমে নিয়ে আটক করে রাখে। সেখানে সদর ইউপি মেম্বার আলফা বেগমের সামনেই পুলিশ সদস্যরা আমাদের মারধোর করে। এ সময় ইউপি মেম্বার বাঁধা দিলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশায় এসেছিলাম সম্মানের জন্য। ২১ বছর শিক্ষকতা করার পর যে ‘সম্মান’ পেলাম তা কোন দিন ভুলতে পারব না। নির্যাতিত শিক্ষক অশোক আচার্য বলেন, বিকেলে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র থানায় আসেন। এ সময় তিনি উভয় পক্ষে বক্তব্য শুনে পুলিশ সদস্যদের আচরণে উষ্মা প্রকাশ করেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেন। তার সময়োপযোগী পদক্ষেপে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি।

শিক্ষক মহীউদ্দিন বলেন, আমরা বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথে সিনিয়র শিক্ষক আশোক আচার্যকে পুলিশ মারধোর করতে করতে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি এগিয়ে গেলে পুলিশ সদস্যরা আমাকেও ঝাপটে ধরে। এ সময় তারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তারা আমাদের মারধোর করতে করতে থানায় নিয়ে যায়। তিনি পুলিশের এমন নির্দয় আচরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, যারা আমাদের নির্যাতন করেছে তাদের অনেকের সন্তানরা আমাদের স্কুলে পড়ে। তাদের সন্তানদের মানুষ করার বিনিময়ে আজ এই পুরষ্কার পেলাম। এ সময় তিনি তার পা ও পিঠে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখান। তিনি বলেন, আমি ও শিক্ষক অশোক আচার্য বাহুবল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি অলিউর রহমান অলি বলেন, দু’শিক্ষক সহ কয়েকজন ছাত্রকে আটক করে পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি, উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল হাই, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রেজ্জাক, উপজেলা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল আহমেদ কুটি, আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক ইলিয়াছ আখঞ্জী থানার ডিউটি অফিসারের রুমে যাই। এ সময় আমাদের সামনেই এসআই দেলোয়ার শিক্ষক ও ছাত্রদের লাঠিপেটা করে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।

বিদ্যালয়ের আহত ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষকরা বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে সামনে এসআই কাজী জিয়ার এক ছাত্রকে চড়-থাপ্পড় মারেন। বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল হাই সহ অন্যান্যরা নিষ্পত্তি করে দেন। এরপর ফিরে আসার পথে থানার সামনে পুলিশ শিক্ষক, শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বিচারে লাঠিচার্জ করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ২ শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে মারধোর করতে থাকে। থানা থেকে ৪০০ গজ দূরে অবস্থিত বিদ্যালয়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ছাত্ররা পুনরায় এসে থানা ঘেরাও করে। এ সময় পুলিশ ভিতর থেকে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করলে ছাত্ররা পাল্টা জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ ৩০ ছাত্র-জনতা আহত হয়।

 বিকেলে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র থানায় এসে আটককৃতদের ছেড়ে দেন এবং আগামী ২৬ অক্টোবর দীননাথ ইন্সটিটিউশন মডেল হাইস্কুল পরিদর্শন করবেন বলে জানান। তার নির্দেশে থানার এসআই দেলোয়ারকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। অন্যান্যদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারা বলেন, পুলিশ সুপার মহোদয়ের এ পদক্ষেপে আমরা সন্তুষ্ট। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার পুলিশ সুপারের মতো দায়িত্বশীল আচরণ করলে এ কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হতো না।

এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, স্মারকলিপি দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ছাত্ররা থানায় ঢুকে উশৃঙ্খল আচরণ করে। তাদের ঠেকাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে মৃদু লাঠিচার্জ করা হয়। তাতেও পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে পুলিশ দু’শিক্ষক ও কয়েক ছাত্রকে আটক করে। কিন্তু তাদেরকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করা হয়নি। পরবর্তীতে ছাত্ররা থানায় প্রবেশ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাবার বুলেট ও টিআর সেল ক্ষিপ্ত  করা হয়। এ সময় ছাত্রদের হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হন।


আপনার মন্তব্য

আলোচিত