নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ এপ্রিল, ২০১৭ ১৭:৪২

ফিরে পাওয়ার আনন্দ, সব হারানোর আর্তনাদ

ঘরে ফিরে আতিয়া মহলের ভাড়াটিয়াদের মিশ্র অনুভূতি

একদিকে স্বস্তি-আনন্দ, অন্যদিকে কান্না-আর্তনাদ। স্বস্তি দীর্ঘ উৎকণ্ঠা শেষে নিজেদের ঘরের আসবাবসহ মূল্যবান জিনিস ফিরে পাওয়ার। আর্তনাদ এই সবকিছু হারিয়ে ফেলার।

মঙ্গলবার সকালে সিলেট নগরীর শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলে গিয়ে দেখা মিলে এমন বিপরীতমুখী দৃশ্যের। দীর্ঘ ১৬ দিন পর মঙ্গলবার সকালে আতিয়া মহলের ভাড়াটিয়াদের কাছে নিজেদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয় পুলিশ। ফ্ল্যাটে ঢুকে অনেকে ফিরে পান নিজেদের সবকিছু, আবার অনেকে দেখেন কিছুই নেই। সব ছারখার হয়ে গেছে।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কর্মকর্তা সাহানা বেগম। আতিয়া মহলের ৩য় তলায় ভাড়া থাকতেন। স্বর্ণালঙ্কার রাখা ছিলো তার ঘরের মধ্যে। ১৬ দিন পর মঙ্গলবার নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখেন স্বর্ণালঙ্কার নেই। নেই মূল্যবান কোনো জিনিসপত্রই।

নিজের ফ্ল্যাটের নিঃস্ব অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাহানা। বলেন, আমি একেবারে শেষ হয়ে গেলাম। আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় তলায় গিয়েও শোনা যায় এমন আর্তনাদ। এই তলার একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা গৃহিণী শিরীন আক্তার। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, আমার কোনো জিনিস পাইনি। ফ্রিজ টিভি সব সব ধ্বংস হয়ে গেছে। বিছানার তোষকের তলা থেকে টাকা নিয়ে গেছে। মাটির ব্যাংক ছিলো সেটা কেটেও টাকা নিয়ে গেছে। মানিব্যাগ ফ্লোরে পড়ে আছে, কিন্তু ভেতরে কোনো টাকা নেই। প্রায় তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিলো এগুলোও নেই। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি।

২৩ মার্চ রাতে পুলিশ এই বাসায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর গত ২৫ মার্চ সকালে সেনাবাহিনীর ভবনটির ২৮ টি ফ্ল্যাটে থাকা ৭৮ বাসিন্দাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেসময় এক কাপড়ে আসা এই বাসিন্দারা নিজেদের সব মালপত্র ফেলে আসেন বাসার ভেতরে।


জঙ্গি অভিযান ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ অভিযান শেষে মঙ্গলবার সকালে আতিয়া মহলের ভাড়াটিয়াদের মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো নিজেদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। তবে ১৬ দিন পর নিজ বাসায় ঢুকে অনেকেই খুঁজে পাননি নিজেদের আসবাবপত্র, টাকাপয়সা আর স্বর্ণালঙ্কার।

পুরো ভবনটি যেনো একটি পুড়া বাড়ি। পুড়ে কালচে হয়ে গেছে বেশিরভাগ দেওয়াল। অনেক দেওয়ালই ভাঙ্গা। দেওয়ালজুড়ে গুলি-বিস্ফোরণের ক্ষত, পুড়ে গেছে বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ, টিভির মতো বৈদ্যুতিক সামগ্রী।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভবনটির নিচ তলার বাসিন্দারা। নিজ তলার একটি ফ্ল্যাটেই ছিলো জঙ্গিরা। এই তলার অন্য পাঁচ ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ারা মঙ্গলবার নিজেদের বাসায় ঢুকে প্রায় কিছুই পাননি। সবকিছু ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

নিচ তলার ভাড়াটিয়া পিয়ালী চৌধুরী বলেন, আমার বাসায় তো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেবল ছাই আর আসবাবপত্রের পুড়ে যাওয়া অংশ বিশেষ পড়ে রয়েছে।

নিচ তলায়ই পরিবার নিয়ে থাকতেন পশু চিকিৎসক শ্যামসুন্দর ঘোষ। তিনি বলেন, সারাজীবন রোজগার করে যা কিছু গড়েছিলাম তার সব শেষ হয়ে গেছে। কিছুই পাইনি। বাকী জীবন রোজগার করেও আর এগুলো গড়া যাবে না।

তবে উপরের তলার ফ্ল্যাটগুলোতে থাকা বাসিন্দারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকেই নিজের আসবাবপত্রসহ মূল্যবান জিনিস ফিরে পেয়েছেন। দীর্ঘদিন পর অনেক শঙ্কা শেষে এগুলো ফিরে পেয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তারা।

৪র্থ তলার ভাড়াটিয়া রবিউল ইসলাম বলেন, আমি আমার বাসায় সবকিছু পেয়েছি। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি খুবই খুশি, সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

মঙ্গলবার সকালে নিজ ফ্ল্যাটে ঢুকে বৈদ্যুতিক সামগ্রী ছাড়া বাকীসব জিনিসপত্র ফিরে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ৪র্থ তলার বাসিন্দা অঞ্জু দেব। তিনি বলেন, আমরা তো অনেকটা আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। এতো কাহিনীর পর এগুলো ফিরে পাবো বুঝিনি। এখন সব ফিরে পাওয়ায় খুব ভালো লাগছে।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই ভাড়াটিয়ারা নিজেদের আসবাবপত্র আতিয়া মহল থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া শুরু করেন। অনেকেই এরমধ্যে খুঁজে নিয়েছেন নতুন বাসা।

সিলেট নগরীর মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল বলেন, সোমবার র‌্যাব অভিযান শেষে ভবনটিকে ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণার পর আজ আমরা তালিকা দেখে সকল ভাড়াটিয়াদের ভেতরে পাঠিয়েছি। তাদের নিজেদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, ভবনটি বিধ্বস্ত থাকায় এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এখনই কেউ এখানে থাকতে পারবেন না। তা নিজেদের মালপত্র নিয়ে যেতে পারবেন।

অনেকের টাকাপয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার খোয়া যাওয়া প্রসঙ্গে খায়রুল ফজল বলেন, নিচ তলায় তো আর কিছু পাওয়ার কথা নয়। তবে উপরের তলাগুলো থেকে কিছু খোয়া যাওয়ার সুযোগ নেই। এমন প্রশ্ন উঠতে পারে ভেবে আমি এখন পর্যন্ত ভবনের ভেতরে কোনো পুলিশ ঢুকতে দেইনি। র‌্যাব ভবনটি বুঝিয়ে দেওয়ার পরই ভাড়াটিয়াদের ডেকে এনেছি। তারা মালামাল সরিয়ে নেওয়ার পর আমরা ঢুকবো।

তিনি বলেন, তারপরও কারো কিছু হারিয়ে গেলে আমাদের জানাতে পারেন। আমরা খুঁজে দেখবো।

ভবনের সত্ত্বাধিকারী উস্তার মিয়া বলেন, অনেকে আমার কাছেও ঘরে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কি করার আছে? আমি নিজে তো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত