নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:৫২

সিলেটে শিবিরের যত হত্যাকাণ্ড

গত ৭ আগস্ট সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে কুপিয়ে আহত করেছে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা। শিবিরের হামলায় আহত শাহীন আহমদ (২২) ও আবুল কালাম আসিফ (১৮) এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন।

তবে তারা প্রাণে বেঁচে গেলো বিভিন্ন সময়ে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারাতে হয়েছে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের। সিলেটে শিবিরের এই খুনে রাজনীতির সূচনা হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। ওইদিন প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের তিন কর্মী মুনির, তপন ও জুয়েল শিবিরের হামলায় প্রাণ হারান। এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে স্বাধীনতার পর সিলেটে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে নেয় শিবির।

আলোচিত ওই ট্রিপল মার্ডারের ২৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। তিন তরুণকে হত্যার তিন যুগ পেরিয়ে গেলোও এখনো শাস্তির মুখোমুখি হয়নি হত্যাকারীদের। বরং খুনিরা পার পেয়ে যাওয়ায় এরপর ১৯৯৮ সালের ২৪ মে শিবির ক্যাডাররা খুন করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ডা. সৌমিত্র বিশ্বাসকে। ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর খুন করে মদন মোহন কলেজের ছাত্রদল নেতা হামিদ খান দোয়েলকে। ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট শিবির ক্যাডাররা খুন করে সিলেট ভেটেরিনারি কলেজ (বর্তমান সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর ছাত্রদল নেতা রফিকুল হাসান সোহাগকে। এইসময়ে শিবিরের হামলায় আহত হন প্রায় শতাধিক ছাত্রনেতা। তবে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত একটি মামলায়ও সাজা ভোগ করতে হয় নি কোন কাউকে। উপরন্তু অনেক খুনের ঘটনায় ঘটেছে রাজনৈতিক আপোসকামীতায় বিচারের মুখোমুখিও হতে হয়নি অভিযুক্তদের। শিবির ক্যাডারদের হাতে ছাত্রদল নেতা দোয়েল খুন হওয়ার পর দোয়েলের লাশ দাফনের পূর্বেই আপোষ করে বসে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা।

জানা যায়, সিলেটে জামায়াত শিবিরেরই আগ্রাসনের শুরু স্বৈরাচার এরশাদ শাসনামলে। নব্বইয়ের দশকে। আরও স্পষ্ট করে বললে ১৯৮৭-৮৮ সালে। এসময় তিন ছাত্র নেতাকে খুন করে শিবির। এরপর নিয়মিতই শিবিরের খুনে রাজনীতির বলি হতে হয়েছে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীকে। এমনকি বিএনপির সাথে জোট করে ক্ষমতায় থাকাকালে খোদ ছাত্রদলের দুই নেতাকে খুন করে শিবির ক্যাডাররা।

ফিরে দেখা : ১৯৮৮
১৯৮৭-৮৮ সালেই প্রথম সিলেটের রাজপথে প্রশাসনের সহযোগিতায় জামায়াত-শিবির প্রথম প্রকাশ্যে আসে। জামায়াত-শিবিরের এই আবির্ভাব সম্পর্কে সিলেট জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক লোকমান আহমদ বলেন, তখন প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতায় জামায়াত-শিবির প্রকাশ্যে আসে। তখন শিবিরের সশস্ত্র মিছিলের আগে ও পিছে পুলিশ প্রটেকশন থাকতো।

সিলেট মহানগর জাসদের সভাপতি এডভোকেট জাকির আহমদ বলেন, সেইসময়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই তখন পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের মাঠে নামানো হয়।

প্রশাসনের মদদ পেয়ে ১৯৮৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেটে তাণ্ডব চালায় শিবির ক্যাডাররা। ৭ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ও আওয়ামী ছাত্রলীগ নেতা খসরুজ্জ্বামানের উপর হামলা চালায় শিবির ক্যাডাররা। সেদিন শিবির ক্যাডাররা খসরুজ্জামানকে ছাত্রী কমনরুমের বাথরুমের ভেতর আটকিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। একপর্যায়ে  মৃত ভেবে খসরুজ্জামানকে ফেলে রেখে যায় ক্যাডাররা। এদিন শিবির ক্যাডাররা কলেজ শিক্ষিকা ও ছাত্রীদেরও লাঞ্ছিত করে।  এরপর ৮, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে শহরময় আতংক সৃষ্টি করে শিবির। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে অস্ত্র হাতে শহরময় দাপিয়ে বেড়ায় শিবির ক্যাডাররা।  ১৮ সেপ্টেম্বর এমসি কলেজে শিবির ক্যাডাররা আবার হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উপর। ১৯ ও ২০ তারিখে এমসি কলেজে ছাত্রলীগকে ঢুকতেই দেয় নি শিবির। সিলেট সরকারী কলেজ ও মদন মোহন কলেজেও এ কয়দিনে তাণ্ডব চালায় শিবির ক্যাডাররা। বন্ধ করে দেয়া হয় সিলেটের সবগুলো কলেজ।

এ পরিস্থিতিতে সিলেট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেয়। মৌলবাদ ও স্বৈরশাসন প্রতিরোধ দিবস। জাসদ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মৌলবাদীদের প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় প্রচারণা চালাতে থাকে। এদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিরোধ দিবসের কথা শুনে শিবির দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্যাডার ও অস্ত্রশস্ত্র এনে সিলেটে জড়ো করতে থাকে।

খুনিদের আস্ফালনের সেই ভয়াল দিন
২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন নিজস্ব ব্যানারে মিছিল করে নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পৃথক পৃথক ভাবে এমসি কলেজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়ো হন নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায়। এসময় শিবির ক্যাডাররাও জড়ো হতে থাকে নগরীর আলীয়া মাদ্রাসায়। সকাল সাড়ে ৯ টায় আচমকা টেম্পোতে করে এসে জাসদের নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালায় সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা। এসময় জাসদ ছাত্রলীগের নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী মুনির-ই কিবরিয়া চৌধুরীকে বল্লম ও ছুঁড়ি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে শিবির ক্যাডাররা। মুনির সিলেটের নাট্য সংগঠন লিটল থিয়েটারের নাট্যকর্মী ছিলেন। ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ছিলেন সিলেটের দ্রুততম মানব। আশংকাজনক অবস্থায় মুনিরকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আলীয়া মাদ্রাসার সামনে তপন জ্যোতি দে-কে পাথর ছুঁড়ে মারাত্মক আহত করে শিবির ক্যাডাররা। সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে মুনিরের আগেই প্রাণ হারান তপন। ঘটনার দিনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তপন জ্যোতি দে। তপন নগরীর মদন মোহন কলেজের ছাত্র ছিলেন।

এসময় শিবির ক্যাডারদের তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষার্থে নগরীর আম্বরখানাস্থ একটি একটি বহুতল বিপণি বিতানের ছাদে আশ্রয় নেন জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী এনামুল কবির জুয়েল। সেখানেও তাকে তাড়া করে হায়েনারা। তাড়া খেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন এনামুল কবির জুয়েল। জুয়েল সিলেটের গোলাপগঞ্জের এমসি একাডেমির দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পূর্বে তিনি জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ সেপ্টেম্বর প্রাণ হারান মুনির-ই কিবরিয়া চৌধুরী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটিই সিলেটের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।

তবু মামলায় খালাস পেয়ে গেলো সবাই
মুনির-তপন-জুয়েল খুনের অভিযোগে শিবিরের ৫ শতাধিক জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন তৎকালীন জেলা জাসদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন আহমদ। তবে এই মামলায় সব আসামীই খালাস পেয়ে যায়। শাস্তি হয় নি কোন খুনিরই। দিনদুপুরে প্রকাশ্য রাজপথে খুন হলেও খুনিদের সনাক্ত করাও যায় নি। আদালতের রায়ে সব আসামীদের খালাস পেয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কারা খুন করেছে মুনির-তপন-জুয়েল কে?

মামলায় সকল আসামী খালাস পেয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও মুনির-তপন-জুয়েল হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘সে সময় বাদীর পক্ষ নিয়ে মামলা লড়ার মতো কোন আইনজীবীকেই পাওয়া যায় নি। জামায়াত-শিবিরের বিপক্ষে গিয়ে মামলা চালাতে কোন আইনজীবীই রাজি হননি।’

সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন এপিপি মাহমুদ হোসেন। আর কোন বিকল্প না পেয়ে বাদীর পক্ষের আইনজীবীর দায়িত্ব নেন সেসময়কার তরুণ আইনজীবী এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন।

জানা যায়, মামলা চলাকালে একদিন আচমকা বাদীর পক্ষ নিয়ে আদালতে উঠেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী আব্দুল লতিফ সরদার। পরদিন তিনিই জাসদের শীর্ষ নেতাদের ডেকে নিয়ে আপোষ প্রস্তাব দেন। মামলা তুলে নিয়ে জামায়াতের সাথে আপোষ করে নেওয়ার কথা বলেন। সেসময় জামায়াতের শীর্ষ নেতারা জাসদসহ সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি বাড়ি আপোষ প্রস্তাব নিয়ে যায়। অর্থের প্রলোভন দেখায় অনেককে আবার হুমকিও প্রদান করে অনেককে।
এভাবে জামায়াতের কূটচাল, ক্ষমতাসীন স্বৈর সরকারের অনাগ্রহ ও বিরোধিতা, কিছুসংখ্যক প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের নির্লজ্জ আপোষ ও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের বিরুদ্ধাচারণে মামলায় খালাস পেয়ে যায় আসামীরা।

এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলো না কেন? -এই প্রশ্নের জবাবে এডভোকেট শাহিন বলেন, এসব মামলায় রাষ্ট্র বাদী হয়ে আপিল করতে হয়। আপিলের জন্য সবধরনের কাগজপত্র এটর্নি জেনারেল অফিসে প্রেরণ করা হলেও সেখান থেকে তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।  

সেইসব আসামীদের নিয়ন্ত্রণেই এখন সিলেট
সেসময়কার প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, মামলা পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গের ভাষ্য থেকে জানা যায়, মুনির-তপন হত্যা মামলার প্রধান আসামী ছিলেন তৎকালীন শিবির নেতা জিয়াউদ্দিন নাদের। যদিও মামলার রায়ে তিনি সহ সব আসামীরাই খালাস পেয়ে যান। এছাড়া অন্যান্য আসামীদের মধ্যে ছিলেন- তৎকালীন শিবিরের শীর্ষ নেতা ও বর্তমানে জেলা জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা ডা. সায়েফ আহমদ, ফারুক আহমদ, ফখর উদ্দিন, জিয়াউল হক, সুহেল আহমদ চৌধুরী, আব্দুল করিম জলিল, আব্দুর রহমান প্রমুখ। এদের মধ্যে ফারুক আহমদ ও সুহেল আহমদ চৌধুরী মারা গেছেন। নাদেরের মালিকানায় রয়েছে নগরীতে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। এছাড়া তার যৌথ মালিকানায় রয়েছে একাধিক আবাসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা। অন্যান্য আসামীরাও সিলেটের ব্যবসা বাণিজ্য ও রাজনীতির মোড়ল হয়ে উঠেছেন। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত