তপন কুমার দাস, বড়লেখা

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ২৩:৫৮

প্রিয় নাগেশ্বরী গাছের তলায় সমাহিত নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা

তখন দুপুর আড়াইটা। গান বাজছে ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান’...। নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার প্রিয় একটি গান ছিলো এই রবীন্দ্রসঙ্গীত।

এই গান গেয়েই স্বজনেরা চোখের জলে প্রয়াতের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর (কাঁঠালতলী) ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের বাড়িতে (নিসর্গ) নাগেশ্বরী গাছের তলায় দিজেন শর্মার চিতাভস্ম সমাহিত করেন। এরপর ফুল দিয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান নিকটজন।

রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ছিল দ্বিজেন শর্মার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। দুপুরে কাঁঠালতলী বাজার থেকে রিকশাযোগে দিজেন শর্মার বাড়িতে যেতে যেতে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিয়াজ উদ্দীন বলছিলেন- ‘দ্বিজেন শর্মার সাথে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। বড়লেখার সন্তান হিসেবে আমরা তাঁকে যেভাবে সম্মান দেওয়ার কথা ছিল, তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। এরজন্য মনে একটা কষ্ট আজীবন থেকেই যাবে। আমি ২০০৯ সালে দ্বিজেন শর্মার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। সেদিন আমার লেখা একটি বই নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমার ডায়রিতে একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।’

দ্বিজেন শর্মার বাড়ির মূল ফটকেই শে্বতপাথরে লেখা রয়েছে বাড়ির নাম- 'নিসর্গ'।  দ্বিজেন শর্মা নিজেই এ নামকরণ করেছিলেন। তবে এই বাড়িটিকে এলাকার লোকজন ‘কবিরাজ বাড়ি’ নামেই চেনেন। দ্বিজেন শর্মার বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মাকে এলাকার লোকজন কবিরাজ নামেই চিনতেন। চন্দ্রকান্ত শর্মার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ভাইদের মধ্যে দ্বিজেন শর্মা সবার ছোট।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে- কয়েকজন লোক অতিথিদের জন্য রান্নার কাজ করছেন। অতিথিদের বসার কক্ষে দ্বিজেন শর্মার বিভিন্ন সময়ে ধারণকৃত ছবি স্লাইডে প্রদর্শন করা হচ্ছে। বাড়ির উঠানে চলছে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। একপাশে বসে আছেন দ্বিজেন শর্মার ছেলে সুমিত্র শর্মা। তিনি শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন করেন। এসময় দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী দেবী শর্মা, মেয়ে শ্রেয়সী শর্মাসহ আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

দ্বিজেন শর্মার বাড়িটিই যেন একটি উদ্যান। বাড়ির চারপাশ ঘুরতেই চোখে পড়ে কৃষ্ণচুড়া, আমলকি, জামরুল, টগর, গোলাপ, নীলকণ্ঠ, খেজুর, অর্জুনসহ নাম জানা-অজানা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।

আলাপচারিতায় ভাতিজা সমর অর্জুন বললেন, এ গাছগুলো সব কাকার (দ্বিজেন শর্মার) লাগানো। সমর অর্জুন জানান, কাকু বাড়ি এলেই তাকে সঙ্গে নিয়ে গাছগুলো ঘুরে দেখতেন। ব্যস্ত থাকতেন গাছের পরিচর্যা নিয়ে। কাউকে গাছ কাটতে দিতেন না। সবাইকে গাছ পরিচর্যার জন্য বলতেন। সর্বশেষ প্রায় আড়াই বছর আগে বাড়ি এসেছিলেন। সেবার প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। অনেক গাছগাছালি ঝড়ে উপড়ে পড়েছিল। সড়কের পাশে ঝড়ে উপড়ে পড়া একটি গাছের সাথে লতার মতো ফুলের গাছ দেখে তিনি আক্ষেপ করছিলেন। ফুলটি তিনি নিতে চেয়েছিলেন।

দ্বিজেন শর্মা আর কখনো তাঁর প্রিয় বাড়িটিতে পা রাখবেন না। তবু সমস্ত বাড়ি জুড়েই রয়েছে তাঁর অস্তিত্ব। সবুজ হয়ে বেড়ে ওঠা গাছগুলো বারবার তাঁর উপস্থিতি ঘোষণা করছে।

শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, শুভাকাক্সক্ষীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, প্রকৃতিবিদ ও বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা গত শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের (কাঁঠালতলী) শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত