শাকিলা ববি, হবিগঞ্জ

০১ মার্চ, ২০১৮ ১৮:২১

নামেই কেবল ‘বিরতিহীন’

যাত্রী ভোগান্তি, বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রী উঠানো-নামানো দিয়েই চলছে হবিগঞ্জ-সিলেট বিরতিহীন বাস। গাড়িতে বিরতিহীন লিখা থাকলেও এর কোন মিল নেই। হবিগঞ্জ থেকে সিলেট যাওয়া অথবা সিলেট থেকে হবিগঞ্জ আসার পথে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ৫ মিনিট থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত স্টপেজ দেয়া হয় এই বিরতিহীন বাসে।

সিলেট বা হবিগঞ্জে পৌঁছাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় নেয়া, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ছাড়াও এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বললে যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণে লিপ্ত হন গাড়িতে থাকা সুপারভাইজার, হেলপার এমনকি গাড়ির চালকও।

হবিগঞ্জ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জ থেকে সিলেটগামী ও সিলেট থেকে হবিগঞ্জগামী বাসকে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিয়ম রয়েছে। এছাড়াও ৭টি স্টপেজের মধ্যে শায়েস্তাগঞ্জ ও শেরপুরে শুধুমাত্র ৫ মিনিট স্টপেজ দেয়ার কথা আছে। এছাড়া বাকি ৫টি স্টপেজে শুধুমাত্র যাত্রী উঠানামার জন্য যত সময় লাগে তত সময় গাড়ি দাঁড়ানোর অনুমতি রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের পরে পৌঁছালে লেইট ফি হিসেবে প্রতি মিনিটে ৫০ টাকা করে জরিমানারও বিধান রয়েছে বলে জানান হবিগঞ্জ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কর্তৃপক্ষ।

টিকিটের গায়ে শেরপুর, সৈয়দপুর, আউশকান্দি, পানিউমদা, বাহুবল, মীরপুর, শায়েস্তাগঞ্জ স্টপেজ লেখা থাকলেও হুমায়ুন রশীদ চত্বর, চন্ডিপুল, পুটিজুরিতে নিয়মিত যাত্রী উঠানামা করানোর অভিযোগও রয়েছে।

সিলেট থেকে হবিগঞ্জে যাত্রার সময় বাস মালিক সমিতির বেধে দিয়েছে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। অথচ বাস চালকরা তার কোন তোয়াক্কা না করেই, কখনও ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট, আবার কখনও ৩ ঘণ্টারও অধিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছান। জানা যায়, দেড়িতে পৌঁছেও চেকারকে টাকা দিয়ে লেইট ফি এড়িয়ে চলেন চালকরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, গাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে ছাড়ার পর বিভিন্ন স্টপেজে অধিক সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। গাড়িতে যাত্রী ভরপুর থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি স্টপেজ থেকে যাত্রী নেয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় অধিক সময় স্টপেজ দেয়ার কারণে সিলেট বা হবিগঞ্জে প্রবেশ করার সময় দ্রুত গতিতে বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালানো শুরু করেন চালকরা। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। হবিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা গাড়ি শেরপুর এবং সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়ি শায়েস্তাগঞ্জ থেকে বেপরোয়া গতিতে চালানো হয়। আর এ ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই সুপারভাইজারের অসদাচরণের শিকার হতে হয় যাত্রীদের।

এসব অনিয়মে অতিষ্ঠ এ রোডে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীরা। সিলেটগামী যাত্রী রফিক আহমদ জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে হবিগঞ্জ-সিলেট এক্সপ্রেস চট্ট মেট্রো-১১০০৭৬ গাড়িটি বাস স্ট্যান্ড থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা গাড়িতে উঠেছিলাম। সিলেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে পৌঁছানোর কথা থাকলেও গাড়িটি নির্ধারিত সময় থেকে ২০ মিনিট দেড়িতে পৌছায়। দেরি হবার কারণ জানতে চাইলে গাড়ির দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজারের খারাপ আচরণের শিকার হতে হয় আমাকেও।

একই গাড়িতে থাকা শায়েস্তাগঞ্জের বাসিন্দা মো. হামিদুল হক জানান, শায়েস্তাগঞ্জ থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠেছিলাম। আউশকান্দি এসেই দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বসলেন গাড়িচালক। নিয়ম বহির্ভূতভাবে অযথা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার কারণ জানতে চাইলে চালক আমার সাথে খারাপ আচরণ করেন। ক্ষোভে তিনি বলেন, আমরা এ রোডের যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি। তা না হলে একটি গণপরিবহনের চালক এবং সুপারভাইজার কিভাবে যাত্রীদের সাথে এমন আচরণ করতে পারেন।

গাড়িতে থাকা অপর এক যাত্রী জানান, বিভিন্ন জায়গায় অধিক স্টপেজ দেয়ার জন্য গাড়ি সঠিক সময়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাবে না বলে বুঝতে পারেন চালক। তখনই চালক শেরপুর এসেই দ্রুত বেপরোয়া গাড়ি চালাতে শুরু করেন। এ সময় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে এক যাত্রী ভিডিও করতে চাইলে থাকেও সুপারভাইজারে অসদাচরণের শিকার হতে হয়। গাড়ির হেলপার তখন ধমক দিয়ে ভিডিও না করতে বাধ্য করে।

এছাড়াও ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ-সিলেট বিরতিহীন বাসে করে সিলেট থেকে হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন যমুনা টিভির হবিগঞ্জ প্রতিনিধি প্রদীপ দাশ। রাত ৮টা ৪ মিনিটে শায়েস্তাগঞ্জে এসে বিরক্ত হয়ে তিনি বাস থেকে নেমে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘সিলেট থেকে শায়েস্তাগঞ্জ মাত্র ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট!!! জ.ও.চ হবিগঞ্জ সিলেট বিরতিহীন সার্ভিস।’ এই স্ট্যাটাসের নিচে পরে অসংখ্য কমেন্ট। এই বাস সার্ভিস জনসাধারণকে কি পরিমাণ হয়রানি করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় কমেন্টগুলো পড়ে।

এ বিষয়ে প্রদীপ দাশ বলেন, তাদের এই অনিয়ম আর হয়রানি সহ্য করতে না পেরে শায়েস্তাগঞ্জ এসে বাস থেকে নেমে পরি। এই পরিবহন ব্যবস্থার কাছে আমরা যাত্রীরা জিম্মি হয়ে আছি। তাদের অন্যায় অনিয়মে কোন প্রতিবাদও করা যায় না। নিয়মিত এ ধরনের হয়রানি তাদের উপরমহলের দৃষ্টিগোচর হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

এ বিষয়ে হবিগঞ্জ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শঙ্খ শুভ্র রায় বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে এ ধরনের অভিযোগ আসছে আমাদের কাছেও। চালকরা যেন স্টপেজগুলোতে দেরী না করে এ জন্য গাড়ির মালিকদের নিয়ে আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে ডিউটি করছি। অতিসত্বর এসব অনিয়ম ঠিক করতে হবিগঞ্জ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির উদ্যোগ নিবে বলে জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, পরিবহন সেক্টরে শুধুমাত্র আমাদের তত্ত্বাবধানে না। এখানে শ্রমিক ইউনিয়নও জড়িত। তাই যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা চাইলেও হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তাই এসব বিষয়ের সমাধানের জন্য আমাদের সাথে শ্রমিক নেতাদের আরো এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে হবিগঞ্জ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সজিব আলী বলেন, সারা দেশের সব বাস সার্ভিসের চেয়ে আমাদের এই বিরতিহীন বাস সার্ভিস সবচেয়ে ভালো। ভালো-খারাপ সব জায়গায়ই আছে। এই বিরতিহীন সার্ভিসেও হয়তো কিছু অনিয়মকারী রয়েছে। তারা যদি যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করে আর আমাদের কাছে অভিযোগ আসে এবং তা প্রমাণিত হয় তাহলে ওই দোষীর বিরুদ্ধে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত