কমলগঞ্জ প্রতিনিধি

২২ নভেম্বর, ২০১৮ ২৩:৩১

কমলগঞ্জে মনিপুরী মহারাসলীলা আজ

সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম মনিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা ২৩ নভেম্বর শুক্রবার শুরু হচ্ছে। এবারে মনিপুরী মহারাসলীলার ১৭৬তম উৎসব। রাসোৎসবকে কেন্দ্র করে মনিপুরী সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা।

অপর দিকে আদমপুর ইউনিয়নের মনিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মনিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবার ৩৩ তম রাসোৎসব ও মনিপুরী সাংস্কৃতিক পরিষদের আয়োজনে ৩য় বারের মতো নয়াপত্তন যাদুঠাকুরের মণ্ডপ প্রাঙ্গণে পালিত হবে। উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসবে বিরাট মেলা। নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আয়োজন দুই জায়গাতে হলেও বার্তা একই বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও মানবপ্রেম। রাসোৎসবকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জের মনিপুরী অধ্যুষিত গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ চলছে। পাড়ায় পাড়ায় গত কয়েক দিন ধরে চলে রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্যের মহড়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কমলগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মনিপুরী মহারাসলীলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা উৎসবে পরিণত হয়। বিভিন্ন শ্রেণি ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় লক্ষাধিক লোক সমবেত হন। তাদের পদচারণায় দিনরাত অপূর্ব এক মিলনমেলায় পরিণত হবে মাধবপুরের জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণ এবং আদমপুর নয়াপত্তন এলাকার দুটি স্থানে। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে এই এক দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে।  

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেন। আর মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে শুরু হয় রাসমেলা; যা এখনো চলছে। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ‘রাস’ শব্দটা এসেছে শ্রীকৃষ্ণের ১২ ধরনের রস থেকে। তবে ১২টি রসের মধ্যে রাসলীলায় সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই তিনটি রসের উপস্থাপনই হয়ে থাকে। রাস উৎসব সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে পাড়ায় পাড়ায় রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলে। মাধবপুরে তিনটি জোড়ামন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মণ্ডপের পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধানমতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধানমতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। এই গোপীদের বয়স ১৬ থেকে ২০ বা ২২ বছর। শুধু রাধার বয়স ৫ থেকে ৬ বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে নূন্যতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকে।

একইভাবে রাখালনৃত্যেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনটি অংশে চলে এই রাখালনৃত্য। প্রতিটি দলে ২০ থেকে ২২ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে। এই পুরো বিষয়টি সমন্বয় করে মনিপুরী মহারাসলীলা সেবাসংঘ। মাধবপুরেই বড় অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। এ বছর মাধবপুর ও আদমপুর মনিপুরী কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে আয়োজিত রাসোৎসবের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাবেক চিফ হুইপ ও সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি।

আয়োজকেরা জানিয়েছেন, শুক্রবার মাধবপুর শিববাজারস্থ উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে বেলা ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে শুরু হবে মূল উপস্থাপনা। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে তুলে ধরা হবে। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ; চলবে ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুরলীলা গানে, সুরে ও কথায় প্রকাশ করা হয়। উৎসব ঘিরে বসবে মেলা।

মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে একদিনের এই আনন্দে। শনিবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের পুরসমাপ্তি ঘটবে। শুক্রবার মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী  পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে মনিপুরী পল্লী। রাসোৎসবের জন্য তৈরি সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মণ্ডপগুলো একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠে মানুষের মিলনতীর্থ। মনিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোছনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কণ পরিহীতা রাধা ও গোপিনী রূপের মনিপুরী তরুণীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে কমলগঞ্জের প্রকৃতি ও মানুষ।

মনিপুরী মহারাসলীলা সেবাসংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, বাংলাদেশে মনিপুরীদের এক গৌরবময় দিন মহারাসলীলা। ‘হেমন্তকাল মানেই রাসপূর্ণিমা, রাস উৎসব। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আমরা তেমন ভাবছি না। আমাদের এখানে উৎসব চলাকালে কোনো গণ্ডগোল বা অঘটন ঘটেনি।’

আদমপুর মনিপুরী মহারাস উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব এ হেমন্ত সিংহ জানান, মনিপুরী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আভিজাত্যে মহিমান্বিত। মনিপুরী নৃত্যশৈলী আন্তর্জাতিক মানের ও বিশ্বজনীন। ‘আমাদের প্রস্তুতি ভালোই। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই।’

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক ও কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার জন্য দুই জায়গাতেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে নিরাপত্তায় পুলিশের তিন স্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত