জাহাঙ্গীর আলম খায়ের, বিশ্বনাথ

০৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:১৬

৮০ লাখ টাকা রাজস্বের জন্যে ১৩৪ কোটি টাকা ক্ষতি!

সুরমায় ড্রেজিংয়ে বিলিন হচ্ছে স্থাপনা ও ফসলি জমি

বালু উত্তোলনের জন্য সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে সুরমা নদীর 'তিলকপুর-শিবেরখলা বালু মহাল' বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন। প্রতিবছর ১৬ লাখ টাকা করে ইজারা দিয়ে গত পাঁচ বছরে এই বালু মহাল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। তবে ইজারা নেওয়ার পর ইজারাদাররা নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকেও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন শুরু করে। এতে নদীর দুই তীরে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙ্গন। ভাঙ্গনে ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে সরকার দুই ধাপে বরাদ্দ দিয়েছে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলেই নদীতে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে নদী তীরবর্তী জনপদ, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে বালু উত্তোলনের জন্য নদী ইজারা দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

ইজারা নিয়ে এই নদী থেকে গত দু'বছর ধরে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন এডভোকেট নাসিম আহমদ নামের এক ব্যক্তি। সিলেট নগরীর সুবিদবাজারের বাসিন্দা নাসিম তার বড়ভাই মশউদ আহমদের লাইসেন্স দিয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে ইজারা নিয়েছেন। এর আগে আরও তিন বছর বালু উত্তোলন করেছেন নুরুল হুদা নামের অন্য এক ব্যবসায়ী।

এদিকে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বিশ্বনাথের পরগনা বাজারের কিছু এলাকা, বাজারের মসজিদ, ২টি মাজার, লামাকাজি-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক, লামাকাজি-পরগণাবাজার-আকিলপুর সড়কসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এছাড়া বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের মহাতাবপুর, রাজাপুর, আকিলপুর, কলিম উল্লাহপুর, সুবলপুর, রসুলপুর, হাজারীগাঁও, তিলকপুরসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের বাসিন্দাদের ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

এই এলাকার নদী ভাঙন রোধে ২০১৮ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের থেকে ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় আর চলতি বছরের অক্টোবর মাসে একনেকের সভায় দ্বিতীয় ধাপে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আরও ১২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

সূত্র মতে, চলতি বছর ১৬ লাখ টাকায় মশউদ আহমদের লাইসেন্সে সিলেট সদর উপজেলার তিলকপুর-শিবেরখলা বালুমহাল এক বছরের ইজারা দেন সিলেটের জেলা প্রশাসক। সদর উপজেলার ইউএনও’র নির্দেশে সেখানকার সার্ভেয়াররা ইজারাদেরকে বালু উত্তোলনের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, তিলকপুর-শিবেরখলা মৌজায় (জেএল নং ৪১) ইজারা নিয়ে দিনের বেলা বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের আমিরুল্লাহাজ মৌজায় (জেএল নং ২০) আর রাতের বেলা একই ইউনিয়নের গৌরী শংকর (জেএল নং ৮) ও হাজরাই মৌজা (জেএল নং ১৯) থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দিনেরাতে ১০/১৫টি স্টিলের নৌকা দিয়ে সমান তালে করা হয় বালু উত্তোলন। জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পরও রাতভর মেশিনের বিকট শব্দে ঘুমাতেও পারেন না ওই এলাকার বাসিন্দারা। এতে বাধা দিলে তাদেরকে মিথ্যা মামলা ও পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয় বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন নদী ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর একপাড়ে একসঙ্গে ৪টি নৌকা দিয়ে সুরমা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর ওপর পাড়ে আরও দু’টি নৌকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে হাজরাই গ্রামে মজুদ করছেন ওই গ্রামের বাবুল মিয়া। অন্যদিকে সরকারি বরাদ্দের বালু ভর্তি বড় বড় বস্তা ফেলে নদী পাড়ের ভাঙা জায়গা ভরাট করছেন দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লামাকাজি-পরগণাবাজার-আকিলপুর ভাঙা সড়ক দিয়ে কোন উপায়ে অটোরিকশাযোগে যাতায়াত করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বালু ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া নিজেকে বৈধ ব্যবসায়ী দাবি করে বলেন, তার মতো একইভাবে ব্যবসা করছেন সাঙ্গিরাই গ্রামের বাসিন্দা লামাকাজী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, দিঘলী গ্রামের কয়েছ মিয়া, জাগিরালা গ্রামের জহির উদ্দিন ও সদর উপজেলার আলীনগর গ্রামের কয়েছ মিয়া।

ওই এলাকায় গিয়ে কথা হয় রাজাপুরের সজ্জাদ চৌধুরী লিলু, আকিলপুরের ইমন আহমদ বিজয়, সালা উদ্দিন ও চয়ন আচার্যের সঙ্গে। তারা বলেন, সরকার একদিকে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে, অন্যদিকে বালুমহাল ইজারা দিয়ে পাঁচ বছরে পেয়েছে মাত্র ৮০লাখ টাকা।

রাজাপুরের আবদুল লতিফ, নুরুল হক, হাজরাইর আশরাফ আলী, পরগণা বাজারের ব্যবসায়ী সাদ উদ্দিন বলেন, শিবেরখলা মৌজায় নয় আমিরুল্লাহাজ মৌজায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর রাতের বেলা ১০/১৫টি নৌকা দিয়ে হাজরাই ও গৌরী শংকর মৌজা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়।

তবে রাতে নয়, দিনে নিজ সীমানায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ইজারাদার এডভোকেট নাসিম আহমদ। পুলিশ দিয়ে কাউকে হয়রানি কিংবা হুমকি ধমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, বড়ভাই মশউদ আহমদের নামে তিলকপুর-শিবেরখলা মৌজার বালুমহাল ১৬লাখ টাকায় এবছর তিনি ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্ণালী পাল বলেন, বালু উত্তোলনের সীমানা নির্ধারণসহ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে এ বিষয়টি জানিয়েছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত