এস আলম সুমন, কুলাউড়া

০৫ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ০০:৫৪

বাড়ি বিক্রি করে ওমান গিয়েছিলেন সবুর, সন্তানদের নিয়ে বিপাকে স্ত্রী

ওমানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সঞ্জরপুর গ্রামের সবুর আলী ও তাঁর পরিবারের স্বপ্ন ছিলো সুন্দর ভবিষ্যতের। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চার বছর আগে নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে ফ্রি ভিসায় পাড়ি জমান মধ্যেপাচ্যর দেশ ওমানে।

নিজের মা, স্ত্রী ও সন্তানদের থাকার জায়গা না থাকায় পার্শ্ববর্তী শ্যালিকার বাড়িতে রেখে যান। সেখানে গিয়েও কাজ না থাকায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি। তবুও হাল ছাড়েননি। অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রবাসে আয় রোজগারের মাধ্যমে সন্তানদের জন্য বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ করতে প্রবাসের দুর্বিষহ জীবন আঁকড়ে ধরেন সবুর। কিন্তু একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সেই স্বপ্ন এখন আর্তনাদের অশ্রুজলে পরিণত হয়েছে। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বৃদ্ধা মা আনোয়ারা বেগম, স্ত্রী আছিয়া বেগম ও সন্তানদের চোখেমুখে এখন শুধু হাহাকার। জমাট বাধা কষ্ট গুমরে কেঁদে উঠছে।

এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ওমান প্রবাসী সবুর আলীর সহায়সম্বলহীন পরিবারে। সবুর কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুরের সঞ্জরপুর গ্রামের মৃত শহীদ আলী পুত্র। সবুরের স্বজনদের অপেক্ষা কবে কিভাবে আসবে তাঁর লাশ।

এদিকে একই দুর্ঘটনায় নিহত আরেক প্রবাসী উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের বিলেরপার গ্রামের মৃত মুসলিম আলীর পুত্র লিয়াকতের বাড়িতে গেলেও মা, সন্তান ও স্ত্রীর আহাজারী এলাকায় শোকের মাতম বইছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত লিয়াকত ও সবুরের বাড়িতে মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়।

জানা যায়, গত রোববার ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ওমানে কাজ শেষে বাইসাইকেলযোগে বাসায় ফেরার পথে আদম এলাকায় সালালাহ মহাসড়কে গাড়িচাপায় প্রাণ হারান মৌলভীবাজারের ৩ জনসহ ৪ বাংলাদেশি শ্রমিক। তাঁরা হলেন- কুলাউড়ার সবুর আলী (৩৬), লিয়াকত আলী(৩৫), কমলগঞ্জের আলীনগরের আলম আহমদ (৩৫)। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অন্যজনের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি।

নিহত সবুরের ৪ ভাই ও ৪ বোন। তাঁরা পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। সাদিয়া আক্তার (১৩) নাদিয়া আক্তার (৪) এবং বিল্লাল মিয়া (৯) নামে তিন সন্তানের জনক সবুর। জীবিকা নির্বাহের জন্য ৪ বছর আগে নিজের শেষ সম্বল পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে ওমানে পাড়ি জমান তিনি। থাকার জায়গা না থাকায় মাসহ স্ত্রী সন্তানদের একই এলাকায় অবস্থিত শ্যালিকার বাড়িতে রেখে যান। তখন ছোট মেয়ে নাদিয়ার জন্ম হয়নি। সেখানে থেকে সবুরের বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার (১৩) স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। ৯ বছরের ছেলে বিল্লাল মিয়াও একটি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবুর আলীর চার বছরের ছোট মেয়ে নাদিয়া ও ছেলে বিল্লাল বাড়ির আঙ্গিনায় বসে আছে। পাশে থাকা আরো শিশুরা যখন খেলা করছে তখন তারা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারা এখনো বুঝতে পারেনি তাদের পিতা আর নেই।

সবুরের স্ত্রী আছিয়া বেগম স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন। বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন স্বামী হারানোর শোক ও সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে। তিনি বলেন, এখন আমার সন্তানদের মাথা গুজার ঠাঁই কোথায় হবে? আমার সন্তানদের বাবার লাশ কিভাবে আনবো। কেউ আমার সন্তানদেরকে তাদের বাবাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য সুযোগটা করে দেন।

সবুর আলীর বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার বলে, ‘রোববার সকালে কাজে যাওয়ার আগে আব্বুর সাথে ফোনে কথা হয়। তখন তাঁকে দেশে ফিরে আসার কথা বলি। আব্বু আমাকে বলেন মা আরতো মাত্র কিছুদিন। দেশে এসে তোমাদের জন্য ঘর বানাবো। এখন আমি কাজে যাবো। কাজ থেকে এসে কথা বলবো।'

কান্নাজড়িত কন্ঠে সাদিয়া বলে, আর কোনদিনতো আব্বুর সাথে কথা হবে না। এখন আমার আব্বুর লাশ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন করছি।শেষবারের মতো আব্বুকে একটিবার দেখতে চাই।

সবুর আলীর বৃদ্ধা মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমার ছেলের সাথে শেষ বারের মতো কথা হয়েছিলো। তখন সে জানায় মা আমি কিছুদিনের মধ্যে দেশে চলে আসবো। কিছু জিনিসপত্র কিনেছি সবার জন্য। ওমানে ভালো কোন কাজ পাচ্ছি না। আমার সন্তানদের দেখে রাখবে। আমি দেশে এসে তাদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে দিবো।
বৃদ্ধা মায়ের শেষ আকুতি তাঁর ছেলের লাশ যেন তাড়াতাড়ি দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এবং এতিম বাচ্চাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মাথা গুজার ঠাঁই একটি ঘরের ব্যবস্থা যেন করে দেয়া হয়।

নিহত সবুরের ভগ্নিপতি মবশ্বির আলী জানান, সবুর ওমানে খুবই কষ্টে দিনযাপন করছিলেন। কোন মাসে ৪ হাজার কোন মাসে ৫ হাজার টাকা পাঠাতেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। সন্তানদের মানুষ করার জন্য নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রবাসে পাড়ি জমান। কিন্তু এখন তিনি লাশ হয়ে আমাদের কাছে ফিরবেন।

এদিকে লিয়াকতের বাড়িতে গেলে দেখা যায় তাঁর মা বানেছা বেগম, স্ত্রী শিরীন বেগম ও একমাত্র ছেলে তায়েফ ইসলাম (৯) তাঁকে (লিয়াকত) হারিয়ে আহাজারি করছেন। ছেলে তায়েফ স্থানীয় পীরের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ৬ বছর আগে লিয়াকত দুবাইতে পাড়ি জমান। এরপর ওমানে যান। সেখানে ৪ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।

নিহত লিয়াকত আলীর চাচা মাসুদুর রহমান জানান, পাসপোর্ট নবায়ন করে দু’মাস পরে দেশে আসার কথা ছিল লিয়াকতের। তার স্ত্রী ও ৯ বছর বয়সের এক ছেলে সন্তানের পড়ালেখা এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী মোবাইল ফোনে বলেন, নিহতদের মরদেহ দেশের আনার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের পাশে সার্বিক সহযোগিতার প্রয়াস থাকবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত