নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ মার্চ, ২০২০ ১৬:৩২

বনের সুরক্ষার চেয়ে পর্যটন বিকাশেই ঝোঁক বন বিভাগের

আজ বিশ্ব বন দিবস

২০১৮ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের জন্য ‘ট্রি অ্যাক্টিভিটি’ বা ‘দড়িপথ’ চালু করে বনবিভাগ। এরপর এ উদ্যানে টিকিটের মাধ্যমে দর্শনার্থী প্রবেশ শুরু হয়। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি সংরক্ষিত বনসহ কয়েকটি বনে অনেক দিন ধরেই টিকিটের মাধ্যমে পর্যটক প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে পর্যটকদের অবাধ বিচরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব বনের পরিবেশ। তবে এখানেই থেমে নেই বন বিভাগের উদ্যোগ। সম্প্রতি লাউয়াছড়াসহ সিলেটের তিন বনে পর্যটন বিকাশে প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বন বিভাগ। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিনটি বনেই গড়ে ওঠবে পর্যটকদের জন্য একাধিক স্থাপনা।

অথচ লোকবল সংকটের কারণে প্রায় তিন বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে লাউয়াছড়ার একমাত্র ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারটি। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে গেছে সড়ক ও রেলপথ। এসব সড়কে গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রায়ই হতাহত হয় বণ্যপ্রাণী। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় রেসকিউ সেন্টারে চিকিত্সা পাচ্ছে না আহত বন্যপ্রাণী। সেন্টারটি চালুর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই।

অন্যদিকে সিলেটে বনবিভাগের প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৪ একর জমির মধ্যে প্রায় ৫৮ হাজার একরই বেদখলে রয়েছে। নতুন করেও বেদখল হচ্ছে অনেক জমি। প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমি বেদখলে থাকলেও তা উদ্ধারে বনবিভাগের তত্পরতা সামান্যই। বন ও বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় বনবিভাগের উদাসীনতার বিপরীতে বনের মধ্যে পর্যটনের বিকাশে তাদের তত্পরতা লক্ষণীয়। বনে পর্যটক আকর্ষণে নেওয়া হচ্ছে একের পর এক প্রকল্প।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, বন ও বণ্যপ্রাণীর সুরক্ষার জন্য বনবিভাগ গঠন করা হয়েছে। পর্যটনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে।  অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি বনবিভাগই পর্যটন বিকাশের দায়িত্ব নিয়েছে। তাও বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস করে।

তিনি বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সারাদেশের সম্পদ। কিন্তু বনবিভাগের উদাসীনতায় দিনদিন এ বন সংকুচিত হয়ে আসছে। গাছ কাটা হচ্ছে। পর্যটকদের অবাধ বিচরণের কারণে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে পর্যটকদের বিচরণ। এ অবস্থায় যখন বনের ভেতরে পর্যটকদের প্রবেশ সীমিত করা প্রয়োজন তখন বনবিভাগ পর্যটন শিল্পের বিকাশের নামে এই বনের ভেতরে স্থাপনা নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যা বন ও বন্যপ্রাণীকে হুমকিতে ফেলবে।

তবে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না। বরং বনের সুরক্ষায় পর্যটকদের যাতে একস্থানে আটকে রাখা যায় সে পরিকল্পনা থেকেই এসব করা হচ্ছে।

বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন বিভাগের পক্ষ থেকে  ‘লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকো-পার্কে বনায়ন ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন’ নামে ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।  এরই মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়েও জমা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের জন্য ৩ কোটি টাকা ও বাকি প্রায় ৩৬ কোটি টাকা লাউয়াছড়া উদ্যানের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় করা হবে।  এ প্রকল্পে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের বসার জন্য ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি আরসিসি বসার ব্রেঞ্চ, ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পর্যটকদের চলাচলের জন্য ব্রিজ, ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সভা-সমাবেশের জন্য কনভেনশন হল, ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর, ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে কালভার্ট, ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বনের ভেতরে সড়কের উভয় পাশে আরসিসি খুঁটিসহ প্লাস্টিক কোটেড ফেন্সিং, ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাহাড়ের উপর যাওয়ার জন্য আরসিসি সিঁড়ি, ১ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রেস্ট হাউজ, ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রেস্তোরাঁ ও শিশুদের খেলার জায়গা, ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে লেকের উপর ঝুলন্ত সেতু, ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া নির্মিত হবে গার্ডওয়াল, ৪টি টয়লেট, প্রবেশ গেইট, টিকিট কাউন্টার, লেইক ও পুকুরের সিঁড়ি, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণসহ রয়েছে অনেক কিছু। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের সংরক্ষিত বন লাউয়াছড়ার গাছপালা ও জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা পরিবেশকর্মীদের।

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক জলি পাল বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অনেকটা পার্কে পরিণত হবে। একমাত্র যে লেক রয়েছে, সেখানে বন্যপ্রাণীরা পানি খায় ও মেছোবাঘ মাছ খায়। এ লেকের উপর ঝুলন্ত সেতু ও ওয়াকয়ে নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে প্রকল্প প্রস্তবনায়। এমনটি হলে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে ফলে বণ্যপ্রাণীরা পানি সঙ্কটে পড়বে।

লাউয়াছড়াসহ তিন বনের এই প্রকল্প সম্পর্কে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. আনিসুর রহমান বলেন, আমরা যা করছি সেটা বনের ভালোর জন্য করছি। মূলত লাউয়াছড়ার ভেতর থেকে পর্যটকদের চাপ কমাতে আমরা এক পাশে নিয়ে যাচ্ছি। কাজ শুরুর আগে জীববৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করা হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করেই উন্নয়নকাজ করা হবে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত