নিজস্ব প্রতিবেদক

০৪ এপ্রিল, ২০২০ ২১:১৫

সিসিকের ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা, অনিয়মের অভিযোগ

করোনাভাইরাসের কারণে সঙ্কটে পড়া নগরীর বাসিন্দাদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। 'খাদ্য ফান্ড' গঠন করে নগরীর প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে এ সহায়তা প্রদানের কথা জানিয়েছে সিসিক। যা গত মঙ্গলবার (৩১) মার্চ থেকে শুরু হয়েছে।

তবে বিতরণ কার্যক্রমের শুরুতেই ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ওঠেছে। কাউন্সিলররাও একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন। কাউন্সিলরা কেবল নিজ নিজ ভোটারদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে খোদ মেয়রকে আদেশ জারি করতে হয়- ভোটারভিত্তিক ত্রাণ বিতরণ করা যাবে না।

এমন নানা অভিযোগের কারণে প্রশ্নের মুখে পড়েছে দুর্দিনে মানুষকে সহায়তার এই শুভ উদ্যোগ।

ত্রাণ নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন ৩ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর এ কে এ লায়েক। শুক্রবার রাতে তার বাসা থেকে ত্রাণের ১২৫ বস্তা চাল উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন সিসিক মেয়র। যদিও লায়েকের দাবি, তাকে সিসিক কর্তৃপক্ষই এই চাল বিতরণের জন্য প্রদান করেছিলো। কিন্তু চালের সাথে অন্য খাদ্যসামগ্রী না থাকায় তিনি চালগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন।

কাউন্সিলর লায়েকের এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনও। শনিবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে এক ভিডিওবার্তায় সিলেট-১ আসনের এই সাংসদ কাউন্সিলর লায়েকের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, 'সিলেটের একটি দুর্ঘটনার কথা আমি শুনেছি। মেয়র সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন। আমাদের দলের এক ভদ্রলোক প্রায় ১২৫ বেগ চাল রাতের সময়ে জোর করে নিয়ে যান। এটি খুবই দুঃখজনক এবং বাজে কাজ। আমি এ বিষয়ে ডিসি সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম রুখতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।'

লায়েকের বাসার ১২৫ বস্তা চাল নিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তার এলাকার দরিদ্রদের যে তথ্য দিয়েছিলেন সেটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কাউন্সিলর ৬ হাজার ২০০ পরিবারের তালিকা দিয়েছেন। অথচ আমাদের কাছে তালিকা আছে ১৫৪৫ জনের। তারপরও আমরা তাকে ২৫০০ পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী প্রদান করি। কিন্তু তিনি ত্রাণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জোর করে ১২৫ বস্তা চাল নিয়ে যান। সেটা আমরা শুক্রবার রাতে উদ্ধার করেছি।

তবে মেয়রের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর এ কে এ লায়েক। তিনি বলেন, বুধবার (১ এপ্রিল) রাতে ৩নং ওয়ার্ডে বিতরণের জন্য ১২৫ বস্তা চাল আমার বাসায় পাঠায় সিসিক কর্তৃপক্ষ। পরেরদিন ডাল, তেল, লবণ ও পিঁয়াজ প্যাকেট করার জন্য আমার ওয়ার্ডে পাঠানোর কথা। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) সিটি করপোরেশন থেকে আমাকে জানানো হয় আমার ওয়ার্ডে ২৫০০ প্যাকেট ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং পূর্বে পাঠানো ১২৫ চাল ফেরত দিয়ে প্যাকেট করা ত্রাণ গ্রহণ করার জন্য। এর প্রেক্ষিতে আমি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ১২৫ বস্তা চাল ফিরিয়ে দেই এবং পরবর্তীতে আমার ওয়ার্ডে পাঠানো ২৫০০ প্যাকেট ত্রাণ গ্রহণ করি। বাসা থেকে চাল উদ্ধারের বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে, ২৫ নং ওয়ার্ডে ত্রাণ বিতরণের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওই এলাকারই নারী কাউন্সিলর।

২৫, ২৬, ২৭ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রোকসানা বেগম শাহনাজ অভিযোগ করে বলেন, ৩টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হলেও আমি ২৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। অন্য সব ওয়ার্ডের মত এই ওয়ার্ডের মানুষজন আমাকে ভোট দিয়েছেন। তাই এই এলাকার জনগণের কাছে আমার দায়বদ্ধতা আছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর একা একা ত্রাণ বিতরণ করছেন। কাউকে সাথে নিচ্ছেন না। খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার ও তদারকির জন্য ট্যাগ অফিসার সাথে থাকার কথা থাকলেও ত্রাণ বিতরণের সময় তিনি সাথে থাকেন না। এ বিষয়ে আমি মেয়রকেও বলেছি। কেউ যদি ত্রাণ বিতরণ নিয়ে স্বচ্ছ থাকে, আত্মসাতের মানসিকতা না থাকে তাহলে তো একা একা ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন পড়ে না।

তিনি আরও বলেন, এই ওয়ার্ডে কেউ ২ বার, কেউ ৫ বার ত্রাণ পাচ্ছে। আবার কেউ পাচ্ছেই না। এর দায়ভার তো আমাকেও নিতে হবে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ২৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাকবির ইসলাম পিন্টু বলেন, এই ত্রাণের ট্রাক আসার পর থেকে রাতের পর রাত জেগে কাজ করছি। আমি নিজে ৫০ বস্তা চাল প্যাকিং করেছি। আশপাশের ছোটছোট ছেলেরা এসে প্যাকিংয়ে সাহায্য করেছে। অথচ আমার ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর একবারও কোনো খোঁজ নেননি। এখন তিনি আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছেন। তাকে ডেকে এনে কেন ফটোসেশন করাইনি সেজন্য তিনি আমার উপর খেপেছেন। যে ত্রাণ সিটি থেকে দেওয়া হয়েছে সেটা আমার ওয়ার্ডের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে এখানে আরও ত্রাণসামগ্রী যুক্ত করেছি। সিটি থেকে তো শুধু খাবার পাঠানো হয়েছে। এগুলো প্যাকিংয়ের জন্য পলি কেনা, যারা প্যাকিং করছে তাদের খরচও আমি ব্যক্তিগত ভাবে বহন করছি। এসবে তার কোনো সহযোগিতা নেই।

তিনি বলেন, আমি তার (রোকসানা বেগম) কাছে দায়বদ্ধ নই। আমি আমার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এই মুহূর্তে আমি কাউকে ডেকে এনে ফটোসেশন করাতে পারবো না। আমি মেয়র সাহেবকেও ফোন করিনি। ত্রাণ প্যাকিং হয়েছে আমি বিতরণ শুরু করেছি। নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে রাতভর মানুষে ঘরে ঘরে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে আসছি। মেয়র নিজে কল দিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন কোথায় কিভাবে ত্রাণ দিচ্ছি। তিনি নিজে এসেছেন। ত্রাণ বিতরণ করেছেন। আমিতো কাউকে আসতে মানা করিনি। নারী কাউন্সিলর যদি তার দায়িত্ববোধ থেকে না আসেন তাহলে কি কারার আছে। তার উচিত ছিল এই ক্রাইসিস মুহূর্তে দাওয়াতের চিন্তা না করে মাঠে এসে জনগণের পাশে দাঁড়ানো।

এদিকে ত্রাণ বিতরণের সময় শুক্রবার রাতে স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়েন ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ইলিয়াছুর রহমানের লোকজন। এ ব্যাপারে কথা বলতে কাউন্সিলর মো. ইলিয়াছুর রহমানের সাথে কথা বলতে তার মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

ত্রাণ বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ৩ নং ওয়ার্ড ছাড়া আর কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। সব কাউন্সিলরাই মাঠে থেকে সুষ্ঠু কাজ করছেন।

সিসিক মেয়র বলেন, আমাদের কাছে নিম্ন আয়ের মানুষজন ছাড়াও কর্মজীবী মানুষদের অনেকেও যোগাযোগ করছেন। যারা জীবনে হাত পাতেন নি তারাও বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটে আছেন। সেক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকে সহায়তা দিতে হচ্ছে। একারণে ত্রাণের চাহিদা অনেকটা বেড়ে গেছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত