শাহআলম সজীব

২০ মার্চ, ২০১৮ ১৯:৩২

১৯-২০ মার্চ ১৯৭১

১৯ মার্চ, ১৯৭১
একাত্তরের এদিন বিকেল বেলা উত্তালমুখর বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল “জয়দেব পুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

অগ্নিঝরা ১৯ শে মার্চ ১৯৭১ সালের দিনটি ছিল শুক্রবার, এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের প্রথম কোনও সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় গাজীপুরের জয়দেবপুরে। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টের ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার সৈনিক। একদিকে চলছিল স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও বাঙালিদের চিরতরে দাবিয়ে রাখার জন্য এঁটে যাচ্ছিল ষড়যন্ত্রের নীলনকশা।

এ ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি অফিসার সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ এলো, ১৫ মার্চের মধ্যে রাইফেলগুলো গুলিসহ ব্রিগেড সদর দপ্তরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক। ওই সময় ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পাকিস্তানি এক ব্রিগেডিয়ার নিজেই ১৯ মার্চ দুপুরের জয়দেবপুর সেনানিবাসে উপস্থিত হলেন।

বাঙালি সৈন্যদের পাঞ্জাবিরা নিরস্ত্র করতে এসেছে এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে পাল্টে যায় চিত্র ১০ হাজারের ও বেশি মুক্তিকামী জনতা জড়ো হয়েছিল জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১৫০ টির মত ব্যারিকেড দিয়ে। জনতার হাতে ছিল হাতে লাঠিসোটা। পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার সেনানিবাসে বসেই এ খবর পান। তিনি ব্যারিকেড অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেন। জনতা ক্ষোভে ফেটে উঠে, পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার কে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ব্যারিকেড সরানো হবে না। এরপর পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার সামনে বাঙালি সৈন্য ও পেছনে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। কিন্তু ব্যারিকেডের জন্য এগোতে না পেরে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।

ওইদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। চান্দনা চৌরাস্তায় প্রতিরোধকালে হুরমত আলী নামে এক যুবক একজন পাকিস্তানী সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করতে চেষ্টা করেন। সে সময় অপর একজন পাকিস্তানী সৈন্যের গুলিতে হুরমত আলী শহীদ হন। এ ছাড়া গুলিতে আহত হন ইউসুফ, সন্তোষ ও শাহজাহানসহ আরও অনেকে।


২০ মার্চ, ১৯৭১
এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের নির্ধারিত স্থান ছিল রমনার প্রেসিডেন্ট ভবন। এই প্রথম প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় ৬ শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে বঙ্গবন্ধু সঙ্গে রাখলেন। ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট স্থায়ী এ বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু যখন প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বাইরে এলেন, তখন শতশত কণ্ঠের 'জয় বাংলা' স্লোগান তাকে আচ্ছন্ন করে।

এ দিনের আলোচনা প্রসঙ্গে পরের দিন দৈনিক পাকিস্তান সংবাদ শিরোনাম করে, 'মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক সঙ্কট নিরসনের পথে এগোচ্ছে।' সংবাদে বলা হয় 'রাষ্ট্রীয় নীতির বর্তমান সঙ্কট নিরসনের পথে মুজিব ইয়াহিয়া আলোচনায় গতকাল (শনিবার) অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

সংগ্রামী বাংলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল তার দলের শীর্ষস্থানীয় অপর ৬ সহকর্মীকে নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ১৩০ মিনিট আলোচনা শেষে তিনি ও তার সহকর্মীরা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।

পরে তার বাসভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের পথে তারা এগোচ্ছেন।'

২০ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠঠাসহ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি গোপন বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে তিনি সামরিক প্রস্তুতির পর্যালোচনা করেন। এ বৈঠকে শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক ব্যর্থ হলে কী করণীয় হবে, তা আলোচিত হয় এবং 'অপারেশন সার্চলাইট' অনুমোদন করা হয়। এ সময় প্রতিদিন সিংহল হয়ে একের পর এক ফ্লাইট বোয়িং-৭০৭ বিমানে করে সৈন্য ও রসদ ঢাকায় আনা হচ্ছিল এবং কয়েকটি জলজাহাজ পূর্ণ করে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হচ্ছিল। অসহযোগ আন্দোলন শুরুর দিকে বাংলাদেশে স্থলবাহিনীর শক্তি ছিল এক ডিভিশন, ২০ মার্চ তা এসে দাঁড়ায় দুই ডিভিশনের অধিক।

২০ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ও সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহি ঢাকায় আসেন।

তিনি সন্ধ্যায় হোটেল কন্টিনেন্টালে কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভাপতি মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ দৌলতানা, ন্যাপপ্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ, পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান সরদার শওকত হায়াত খান, বেলুচিস্তানের ন্যাপ নেতা গাউস বঙ্ বেজেঞ্জা প্রমুখ নেতার সঙ্গে আলোচনা করেন। ২০ মার্চ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত