নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০১:২৮

শহীদ আলতাফ মাহমুদের জন্মদিন আজ

অমর একুশের গান হিসেবে খ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার আলতাফ মাহমুদের জন্মদিন আজ। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই গুণী। শহীদ আলতাফ মাহমুদ, অনেকের কাছেই ঝিলু নামে পরিচিত। একাধারে ছিলেন কবি, সুরকার এবং গীতিকার, সংগীত পরিচালক, নৃত্য পরিচালক, প্রযোজক।

পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় আলতাফ মাহমুদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। পরে আর ফেরেননি এ সংগীতজ্ঞ।

১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হন বিএম কলেজে। পরে তিনি চিত্রকলা শিখতে ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে যান। প্রসিদ্ধ ভায়োলিন বাদক সুরেন রায়ের কাছে প্রথম সংগীতে তালিম নিয়ে তিনি গণসংগীত গাইতে শুরু করেন এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

১৯৫০ সালের দিকে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসংগীত গাইতেন। গান গাওয়ার মাধ্যমে মাহমুদ এই আন্দোলনকে সর্বদাই সমর্থন যুগিয়েছেন।

১৯৫৩ সালের প্রভাত ফেরিতে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো শিরোনামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানটিতে প্রথম আলতাফ মাহমুদের সুরে একুশের গানটি গাওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় ১৯৫২ সালের শেষদিকে তিনি একুশের গানের সুর দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালে 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রের জন্য একুশের গানের শুরুতে হামিং সংযোজন করেন আলতাফ মাহমুদ।

১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ক্র্যাক প্লাটুনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তার ঢাকার রাজারবাগের আউটার সার্কুলার রোডের নিজ বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট বাসা থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিছু এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় তাকে। পরবর্তীতে আর খোঁজ মিলেনি তার।

আলতাফ মাহমুদকে হত্যার অভিযোগে যুদ্ধাপরাধী ও আল বদর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের শাস্তি ঘোষিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে। ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে মুজাহিদকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় আলতাফ মাহমুদ সহ অন্যান্যদের নির্যাতন ও হত্যার কারণে। অপর অভিযোগ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, এবং তা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে।

আলবদর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের বিপক্ষে এ সংক্রান্ত অভিযোগে বলা হয়- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ আগস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানবিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করেন।

১৯৭৭ সালে বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আলতাফ মাহমুদকে একুশে পদক দেওয়া হয় এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ২০০৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

পিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে তার কন্যা শাওন মাহমুদ বলেন, ‘‘একাত্তরের ২৩ ডিসেম্বর, তাঁর আটত্রিশতম জন্মদিন পালন করবার কথা ছিল। সারাদিনের কাজ শেষে পরিবারে সবাইকে নিয়ে গুলিস্তানের ইগলু আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে যার যত মন চায়, আইসক্রিম খাওয়ানোর কথা ছিল। প্রতিবারের জন্মদিনের নিয়ম অনুযায়ী। তিনি আসেননি, আসলে আসতে চাননি আর। বাবা জানতেন একজন মানুষ হিসেবে নিজ দেশের জন্য তাঁর দায় দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন তিনি।’’

শাওন মাহমুদ বলেন, ‘‘মাত্র একুশ বছর বয়সে একুশের গান সুর করেছিলেন। জনপ্রিয়তার জন্য নয়, ভাষা শহীদদের স্মরণে রাখবার জন্য। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ ছায়ানট, উদীচী বা অন্যান্য যেকোনো সংগঠনের প্রতিবাদ, মিছিলে, অনুষ্ঠানে থেকেছেন, গান বেঁধেছেন, শিখিয়েছেন, গাইতেন। আয়ুবী মোনাইম শাসনামলে বাংলাদেশের পক্ষে দেশাত্মবোধক বা গণসংগীত পরিবেশন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান ছিল। আলতাফ মাহমুদ কিছুতেই থেমে থাকতেন না। মুক্তিযুদ্ধ, সেখানেও থেমে থাকেননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, গানের সুর, রেকর্ডিং, স্পুল পারাপার, ক্র্যাকপ্লাটুন, দুই ট্রাংক অস্ত্র, জীবিত ক্র্যাক গেরিলাদের নামগুলো নিয়ে তিনি আর আসতে চাননি।’’

‘‘বাবার জন্মদিন আমি পালন করি না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, তিনি ফিরে আসবেন। তাঁর আটত্রিশতম জন্মদিনের কেক কেটে আবারও সবার সাথে পথ চলবেন। শেষ মুহূর্তেও আমি অপেক্ষা করবো, তাঁর জন্মদিনের রাতে একসাথে সবাই মিলে আইসক্রিম খেতে যাওয়ার জন্য। শুভ জন্মদিন বাবা; ভালোবাসা আর আদর।’’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত