রাফী শামস

২৭ অক্টোবর, ২০১৭ ২০:২০

ঢাবিতে হুমায়ুন আজাদের নামে দৃশ্যমান কিছু না থাকা লজ্জার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. হুমায়ুন আজাদের নামে কোন ভাস্কর্য, ম্যুরাল, ছবি, সড়ক, ভবন বা নিদেনপক্ষে একটা কক্ষও নেই। জানিনা ‘বাংলা বিভাগে’ কিছু আছে কিনা, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যমান এমন কিছুই নেই, যা হুমায়ুন আজাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে। অথচ এই কিছুদিন আগেও একজন রাজাকারের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের সেমিনার-লাইব্রেরির নামাঙ্কিত ছিল। খুঁজলে পাওয়া যাবে হয়তো এমন আরও অনেকগুলো। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এমন অনেকের নামেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সড়ক, ভবন বা কক্ষের নাম আছে বা আছে ম্যুরাল-ভাস্কর্য।

একটা কক্ষ বা ভবন হুমায়ুন আজাদকে ধারণ করতে পারবে না কিংবা তাঁর নাম কোথাও ব্যবহৃত না হলেও তাঁর বিন্দুমাত্র কোন ক্ষতি হবে না। তিনি নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল। তবে এটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই লজ্জা যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতি শিক্ষক ও স্বনামধন্য গবেষককে সে ধারণ করতে পারে নি।

হুমায়ুন আজাদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, প্রাবন্ধিক বা ঔপন্যাসিকই শুধু নন, তিনি একজন খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী। তাঁর ভাষা বিষয়ক গ্রন্থ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে ভাষাবিজ্ঞানের রেফারেন্স হিসেবে পড়ানো হয়।

১৯৬০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তখন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত 'সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ' তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য হুমায়ুন আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে তিনিই প্রথম বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। তাঁর 'বাক্যতত্ত্ব' এবং দু খণ্ডের 'বাঙলা ভাষা' বইগুলো বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় অমূল্য সংযোজন।

প্রথাবিরোধী, উদার, সেক্যুলার সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকা যদি বাদও দেই, কেবল ভাষাবিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর যে অবদান-সেটুকু বিবেচনায় নিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব হিসেবে পরিগণিত হবেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই তাঁকে মৌলবাদীরা হত্যার চেষ্টা করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে স্মরণে রাখে নি। তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং ভাষাবিজ্ঞানী, কিন্তু তাঁকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান না দেখিয়ে। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা প্রকাশ করেছে তাঁর 'বাক্যতত্ত্ব' বইটি- এছাড়া উল্লেখ করার মত কিছু আমার জানা নেই।

তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে পেতেও তাঁকে রাজনীতির শিকার হতে হয়েছিল সবথেকে যোগ্য প্রার্থী হয়েও (তিনি তাঁর ব্যাচে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছিলেন), অধ্যাপক আহমদ শরীফ থাকাতে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। হয়তো এসব কারণে, অথবা তাঁর ঐ সেক্যুলার ভূমিকার কারণেই তাঁকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহ নেই।

২০১২ সালে কোন এক সভায় শিক্ষকরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন যেন তাঁর স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাস্কর্য বা কিছু একটা নির্মিত হয়। এরপর আর কোন উচ্চবাচ্য শুনিনি। বাংলা একাডেমির সামনের সড়কটিও তাঁর নামে হতে পারতো। কিন্তু প্রশাসনের এ নিয়ে কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রশাসন আগ্রহ প্রকাশ করুক না করুক, আমরা, শিক্ষার্থীরা কি নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারি না?

টিএসসিতে একটি স্বতঃস্ফূর্ত মুভমেন্টের অংশ হিসেবে টিএসসি'র দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন মনিষী এবং মানবতাবাদীদের ছবি-গ্রাফিতি আঁকার একটি কর্মসূচির কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে একটি দেয়ালে হুমায়ুন আজাদের প্রতিকৃতি শোভা না পেলে কি এই মুভমেন্ট সম্পূর্ণ হবে?

আমাদের মানস গঠনে তাঁর ভূমিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অবস্থান বিবেচনায়- আয়োজকগণ এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন বলে বিশ্বাস করি। প্রশাসন তো বরাবরই অকৃতজ্ঞ, আমরাও কি প্রশাসনের মত অকৃতজ্ঞ হব? আশা করছি হব না।

হুমায়ুন আজাদের ভাষা সংক্রান্ত কাজগুলো হয়তো আমাদের সবার জন্য নয়, কিন্তু তাঁর থেকে আমরা মাথা উঁচু করে আপোষহীনভাবে চলার যে শিক্ষাটুকু পেয়েছি সেটা সার্বজনীন। আমরা সেই শিক্ষার অমর্যাদা করব না বলেই বিশ্বাস।

  • রাফী শামস: অনলাইন এক্টিভিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত