আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

দুটি চোখ: একটি ছবি

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

ছবি তো নিজেরই প্রতিচ্ছায়া-প্রতিচ্ছবি। ছবিতে মানুষের হুবহু অবয়বই ফুটে ওঠে, আর চোখের ছবিও অবিকল তার স্বরূপেই প্রকাশিত হয়। চোখ মানুষের অবয়বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এবং সংবেদনশীল অঙ্গ। চোখের মাঝেই লুকিয়ে থাকে না বলা হাজার কথা, যতনে রাখা অশ্রুবারি আর বেদনার বারতা। চোখের ভাষায়ই লেখা থাকে প্রিয়জনের মনের কথা। মা যেমন সন্তানের চোখ দেখেই মনের কথা পড়ে ফেলতে পারেন, প্রেমিক পারেন প্রেমিকাকে পড়ে নিতে। তেমনি অপরাধবিজ্ঞানেও অপরাধী নির্ণায়ক হিসেবে চোখের সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কবির ভাষায়, ‘চোখ মনের আয়না’; চোখের শব্দহীন ভাষায় মনের ছবি পুরোপুরিই বিম্বিত হয়। সেই চোখ কখনও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনেরও আয়না, সমাজের দর্পণ সে! যার ওপরে বিম্বিত হয় গোটা সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।

সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে তেমনই একজোড়া চোখ দেখলাম। যে চোখ সেই ভদ্রমহিলার মনের কথাই বলেছে! প্রকৃত অর্থে আমাদের সমাজ মানসে পুষে রাখা শ্রেণিবিভেদ, ক্ষমতার দম্ভ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা, অপরের সুবিধা অসুবিধার প্রতি অসংবেদনশীলতা এবং সর্বোপরি অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চার সম্মিলিত ফসলই প্রতিফলিত হয়েছিল সেই দুটি চোখে! যে কারণে ভিডিওটি একবার নয় বার বার দেখতে বাধ্য হয়েছিলাম।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভিডিওতে ধারণকৃত ঘটনাটি আদতেই বহুল আলোচনার দাবি রাখে না। অপরাধের মাত্রা ও এর গভীরতার নিরিখে অবৈধ পার্কিং খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ও রাষ্ট্রীয় পুকুরচুরির তুলনায় নস্যিমাত্র! আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে যে সকল অন্যায়-অনাচার আর দুঃশাসন আমরা অবলোকন করি তাতে এই ঘটনা জনসাধারণের জীবনে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলে না।

তথাপিও গত কয়েকদিন যাবত এই ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যম যে হারে সরগরম হয়েছে তাতে করে আবারও আমাদের ‘কথা বেশি-কাজ কম’ জাতীয় চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা মনে পড়ে গেল। সুতরাং আমিও বসে গেলাম বাসি কাসুন্দি ঘেঁটে দিতে!

প্রথম দেখার সাথে সাথেই আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল ভদ্রমহিলার চোখে, আমি দেখলাম, একজন শাসককে, একজন সামন্তপ্রভূকে! তাঁর বাচনভঙ্গি, মুখাবয়ব, চোখের ভাষায় যে বক্তব্য অনুক্ত ছিল তাতে তিনি যে ক্ষমতার প্রতিভূ, শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সেকারণেই তিনি প্রবল প্রতাপে যাচ্ছে তাই করতে এবং বলতেও পারেন। তাঁর চোখজুড়ে ছিল প্রতিহিংসার আগুন, ক্ষমতার দর্প, আত্মম্ভরিতা, আর পাহাড়ের মত বিশাল উচ্চতায় থাকা দলীয় ছাতার বেষ্টনি। এই সবকিছুকে পাশাপাশি সাজালে একটি সুনিপুণ ছবি তৈরি হয়; রাজনীতির জুলুমবাজি,অন্যায়-অবিচারের সেই চিত্রই যেনো অঙ্কিত হয়ে গেলো সেই দুটি চোখে! আর মুহূর্তেই সেই চোখ হয়ে উঠল বাংলাদেশের প্রতীকী! যে ক্রোধাগ্নি ছিল তাঁর চোখে তা ব্যক্তিগত ক্ষোভের ঊর্ধ্বে উঠে ভয়ানক এক বৃত্ত তৈরি করেছে, যে বৃত্তে বন্দি হয়ে আপামর জনতা ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রমাগত, সেই বৃত্তেই খাবি খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর যে রক্ত, তা নীল আভিজাত্যে মোড়ানো। আর সেই জাত্যভিমানেই তিনি পারেন পুলিশকে একচোট দেখে নিতে, পারেন অন্যায় করেও উচ্চস্বরে কথা বলতে। কারণ, নীল রক্তের মানুষেরা চিরদিনই দেশসেবার নামে নিজেদের সেবা করে থাকেন জনগণের রোজগারে। তাতে ন্যায্যতা অন্যায্যতা বলে কোনো কথা থাকতে নেই! বাবা এমপি এবং ওনার গাড়িটি সরকারি একথা বলেই পরিচয় দিচ্ছিলেন তিনি। এর অর্থ হচ্ছে, সরকারি দলের লোকদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে অন্যায় করার, আইন লঙ্ঘন করার, রাস্তায় অহেতুক জ্যাম তৈরি করার, কিংবা অন্যের চলার পথের বাধা হওয়ার!

ধরা যাক, রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যামের কারণে ভিডিওর ভদ্রমহিলার গাড়িই আটকে থাকল একদিন, যখন তাঁরই কোনো প্রিয়জনকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করতে হল! সেই দায় কে নেবে সেদিন? কার দায়িত্ব রাস্তার জ্যাম নিরসনের? তখন কি ট্রাফিক সার্জেন্টকেই দায়ী করবেন তিনি নাকি আমজনতাদের? পুলিশ ঘুষখোর একথা যেমন মিথ্যে নয়, তেমনি কোনও কোনও পুলিশ কাজ করতে চেয়েও যে রাজনীতির উচ্চচাপের(!) ফলে করতে পারেন না তা এই ছোট্ট ঘটনায়ই দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে যায়।

ভদ্রমহিলার চোখদুটো দেখতে দেখতে কিছু দৃশ্যকল্প চলছিল আমারও ভেতর ঘরে। চলুন তবে, দেখে আসি সেই দৃশ্যকল্প, কেমন থাকে এমপি সন্তানদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ এবং প্রতিবেশ? একজন রাজনীতিক তথা শাসকদলের এমপির সন্তান শৈশব থেকেই দেখছেন শ’য়ে শ’য়ে মেরুদণ্ডহীন লোক বাবা নামক মহান মানুষটির পেছনে ঘুরঘুর করে, বাবার কথায় ওঠ-বস করে। বাবার হাতে থাকে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ! বাবা ‘হও’ বললেই অন্যের জমি-বাড়ি-ভিটা সব নিজের হয়ে যায়; বাবার ইশারায় সুন্দরী যুবতী মেয়ের সর্বনাশ হয়; গরীবের বাড়ন্ত ছেলেটির ধড় থেকে মাথাও নেমে যায়! মহতি এই বাবার ছায়ার স্পর্শে জীবনের কোথাও, কোনোকিছুতেই এমপি সন্তানেরা ‘না’ শুনে অভ্যস্ত নন। সুতরাং, দুই টাকার পুলিশ(?) যখন এমপি তনয়াকে হুকুম দিলেন রাস্তা থেকে গাড়িটি সরিয়ে নিতে তখন তাঁর শরীরে আগুন জ্বলবে সেটাই স্বাভাবিক!

অথচ, এই সামান্য বিষয়টি তিনি খুব ছোট্ট একটি শব্দ ব্যয় করেই মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। ‘সরি’ হ্যাঁ, ইংরেজি ছোট্ট একটি শব্দ উচ্চারণ করেই তিনি তাঁর গন্তব্যে চলে যেতে পারতেন। এতো ঘটনার অবতারণাই হত না হয়তো। কিন্তু সে যে হবার নয়! তাঁদের জীবনে আইন-কানুন, ন্যায়-অন্যায়, ভব্যতা-সভ্যতার কোনো ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজনই বোধ করেননি। যদিও,অন্যায় করে দোষ স্বীকার করা আমাদের রাজনৈতিক তথা জাতীয় সংস্কৃতিতে নেই!

মায়ের চোখের পাশাপাশি আরও একজোড়া ছোট্ট অবোধ চোখ দেখেছিলাম, সে চোখে ছিল বিস্ময়, ভয়, কিংবা দুর্ভাবনা! মায়ের চোখের ভাষা, মুখভঙ্গি, এবং পুলিশের উদ্দেশে শব্দচয়ন শুনে-দেখে শিশুটি আজ কিছু না বুঝলেও একদিন সে তার নানাজান এবং এমপি তনয়া আম্মাজানকে নিয়ে গর্ব করবে সে আমি নিশ্চিত। অদূর ভবিষ্যতে একদিন সেও এই সমাজের আইনের চাক্কা ঘোরাবে। ইতিহাস নতুন করেই পুনরায় আবর্তিত হবে। কেবল সময় আর আরোপিত চরিত্রের মুখ বদল হবে! এই শিশুটিও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এমনই স্বার্থের দালালি করবে এমন দুর্ভাবনা কি খুবই অমূলক?

বেচারা পুলিশ কেনো এই ভিডিও বাজারে ছেড়েছে? কেউ কেউ বলেছেন, এতে অপরাধীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমিও বলি, পুলিশের শাস্তি হওয়া উচিত। তার আগে একটি প্রশ্ন, সহৃদয় পাঠক, একবারও কি পুলিশের অসহায়ত্ব ভেবে দেখেছেন? যে দেশের পুলিশকে ধরে আনতে বললে বেঁধে নিয়ে আসে, সেই পুলিশের আদেশ অমান্য করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল! পুলিশের কি এক-আধটু ক্ষোভও থাকতে নেই!

কেউ কেউ বলেছেন, ভিডিও করে অপরাধ বন্ধ করা যায় না। পুলিশ মামলা দিয়েছে, বিচার হবে। যে দেশে ‘এমপি তনয়ে’র কৃত খুন মাটি হয়, ধর্ষণ চাপা পড়ে যায়, সেই দেশের মাটিতে ‘এমপি তনয়া’র অবৈধ পার্কিং নিয়ে মামলা হবে আর তাঁর বিচারও হবে? দিব্যজ্ঞানে সেও বিশ্বাস করতে বলছেন!

পরিশেষে বলব, ভিডিও করে যিনি তাঁর ক্ষোভ মেটাতে চেয়েছিলেন, তিনি কিছুটা হলেও সফল হয়েছেন। যারা কমেন্টে মন্দ কথা লিখেছেন তারাও প্রমাণ করেছেন তাঁদের স্বরূপ! তবে সকল আলোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে এটাই প্রমাণিত, অপরাধ যত না বড়, তাঁর চেয়েও ভয়ঙ্কর আমাদের সমাজ মানস। লড়াইটা দরকার সেখানেই। সেই প্রতিচ্ছবিটাই বিষময়,ভয়ঙ্কর! যে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে যত্রতত্র, সমাজের অলিগলিতে, নাসারন্ধ্রে। ঘন তমসায় ছেয়ে গেছে চারিধার। মুক্তি নেই সহসা এ আঁধার থেকে!

আসুন সকলে মিলে সমাজ মানসের সেই বিষময় অশ্লীলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। জাগ্রত হই আলোর সন্ধানে! জাগতেই হবে......আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে...!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ