আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কেউই হতে চায়নি সংখ্যালঘু কিন্তু হতে হলো

রণেশ মৈত্র  

মাত্র দিন কয়েক আগে তাঁর সরকারী বাসভবনে একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আমন্ত্রিত হিন্দু নেতাদেরকে বলেছেন, “বাংলাদেশে কেউই সংখ্যালঘু নন। তেমন চিন্তা কেউ করে থাকলে মন থেকে তা ঝেড়ে ফেলুন”। সাক্ষাতকারটি ছিল সৌজন্যমূলক-সৌজন্যের খাতিরেই হয়তো সেদিন বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনা করেন নি বা কোন মতামতও প্রকাশ করে নি বলে অনুমান করি।

আসলে এমন কথা আমরা বহুকাল যাবত অসংখ্য নেতা-নেত্রীর মুখ থেকে শুনে আসছি। থেকেছি সৌজন্যবোধের খাতিরেই নিশ্চুপ। জন্মাষ্টমীর দিনে দুর্গোৎসব উপলক্ষে অথবা অপর কোন ধর্মীয় উৎসব যেমন বড়দিন বৌদ্ধ পূর্ণিমা প্রভৃতি উপলক্ষে নেতা-নেত্রীরা আমন্ত্রিত হয়ে যখন মন্দির, গির্জা বা বৌদ্ধ বিহারে যান তখনও সকলকেই বলতে শুনি “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ”। না, এ বক্তব্যকে কেউ কোন দিন চ্যালেঞ্জ করেন নি তাৎক্ষণিকভাবে। তাই বেলে সকলে ঐ বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন এমন কিন্তু নয়। আলোচনা কিছু বলতে ইচ্ছুক না হওয়ার কারণেই হোক বা সাহসের অভাবের কারণেই হোক, সকলে চুপচাপ থেকেছেন এবং নীরবে নিঃশব্দে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। এই নীরবতা, নিঃশব্দতা বড়ই বাস্তব-বড়ই করুন।

বর্তমান নিয়ে আলোচনা এ বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না-তা সঙ্গতও হবে না। তাই আলোচনা করবো এবং করবো বলেই কলম তুলে নিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি লেখাটি তাঁর নজরে পড়ে যায়, কি মনে করবেন তা আমার অজানা তবে এবিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কখনও কথা হলো তিনি পুরোপুরি ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন এবং সাধ্যমত তখন ক্ষমতায় না থেকেও সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে ঢাকার রাজপথে মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ন্যাপ সিপিবির নেতাদের সাথে।

বঙ্গবন্ধুর দল আজ অনেক বড় সেদিনের তুলনায়। দীর্ঘদিন যাবত একটানা ক্ষমতায়ও। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলেছেই পরিণত হয়েছে প্রায় দৈনন্দিন ঘটনায় কিন্তু ঐ মিছিল আর হয় না। আসেন না কোন প্রতিরোধ গড়তেও। আইন আ়দালত? না, পুলিশ তৎপর না হওয়ায় সে মাধ্যমগুলিও সক্রিয় হতে পারে না। এ এক করুণ, দুঃসহ পরিস্থিতি বাংলাদেশে বিরাজমান।

স্বচক্ষে দেখেছি ইংরেজ আমলের শেষ দিকটা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট সেদিন মুসলিম লীগের ডাকে একটি দিবস পালনের নামে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী এবং বাঙালি সভ্যতা-সংস্কৃতির আদি পীঠস্থান ও সাম্প্রদায়িক বিরোধী আন্দোলনের সর্বজন স্বীকৃত তীর্থটি কলকাতা শহর মানুষের (না, তখন হিংস্রতা জর্জরিত মুহূর্তে কেউ হয়ে গিয়েছিল হিন্দু-কেউ বা মুসলমান) রক্তস্রোতে ভারত জুড়ে পাল্টাপাল্টি রক্ত বন্যার সৃষ্টি করেছিল। এর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সহ সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

আর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠলো, আত্মপ্রকাশ ঘটলো পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রের যার মৌলিক আদর্শই ছিলো সাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম নিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা-সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী ক্রিয়াকলাপ, বক্তৃতা-ভাষণ-সাহিত্য রচনা-অলিখিতভাবে হেলও সবই ছিলো নিষিদ্ধ ঘোষিত। বাংলাভাষা? কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান মিলে গড়ে তোলা সমগ্র বাঙালি জাতির মুখের ভাষা মায়ের ভাষা, আপন ভাষা, মাতৃভাষা হওয়া সত্বেও, তাকে হিন্দুর ভাষা, ইসলাম-বিরোধী ভাষা বলে অভিহিত করতে আজ্ঞা করতে, অপমানিত করতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বিন্দুমাত্র সংকোচ দেখায় নি। সর্বপ্রথম বাঙালি সন্তান বাঙালির গৌরব পাকিস্তানের তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য শহীদ ধীরেন দত্ত একক কণ্ঠে যখন দাবী উত্থাপন করলেন ১৯৪৮ সালে গণপরিষদের করাচী অধিবেশনে তখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, বাংলার কুলাঙ্গার খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ ধীরেন দত্তকে “হিন্দুদের দালাল, ভারতের দালাল, পাকিস্তানের দুশমন বলে উল্লেখ করে তাঁকে প্রস্তাবের বিরোধিতা করলে প্রতিবাদ স্বরূপ তৎক্ষণাৎ ধীরেন দত্ত অধিবেশন ত্যাগ করে প্রতিবাদ স্বরূপ বেরিয়ে এসে প্রথম ফ্লাইটেই ঢাকা চলে এসে বাঙালির বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেন।

যা হোক সেই পাকিস্তানে অজস্র সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে বিচার হয় নি তবে সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতি দফায়ই তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছে। গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই তেমন প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছিল এলোই না আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ নতুন দেশের কথা তুলতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ এ এসে তেমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করতে কোটি কোটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসব্যাপী অসীম বীরত্বের সাথে পরিচালিত করতে এবং তাতে গৌরবময় বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে। যথার্থই রাষ্ট্রটিকে “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান” রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল-লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল তার সংবিধানে। কিন্তু তারও জোর প্রতিবাদ হয়েছিল মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।

দীর্ঘ ২৩ বছরব্যাপী পাকিস্তান আমলে ধারাবাহিক ভাবে যে তীব্র গণসংগ্রাম বিস্ময়কর সাহসিকতার সাথে পরিচালিত হয়েছিল তার প্রধান দুটি দাবী ছিল গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এর জন্যেই বাঙালিকে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অনীহার কারণে।

ভাবলাম ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে অবসান সূচিত হলো সাম্প্রদায়িকতার-সাম্প্রদায়িক বিভাজনের। এ ভাবনা, এ চিন্তা ঘনীভূত হলো যখন দেখলাম ১৯৭২ এর ৪ নভেম্বরে তৎকালীন জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে রচিত সংবিধানে পর মৌলনীতি হিসেবে গৃহীত হলো গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। ভাবা গেল, পাকিস্তান আমলের তাবৎ অন্ধকার, তাবৎ দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটলো এবং বাহাত্তরের ঐ সংবিধানে সূচিত হলো ধর্মের ভিন্নতা জনিত কারণে, বর্ণের ভিন্নতা জনিত কারণে বা লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে রাষ্ট্র বিন্দুমাত্র বৈষম্য সহ্য করবে না-আইন সম্মতভাবে সকলের প্রতি প্রযোজ্য হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বৈষম্যমূলক যত আইন পাকিস্তান সরকার রচনা করেছিল তারও অস্তিত্ব আর বজায় রাখা হবে না।

বেশ ভালই চলছিল কয়েকটি বছর। যদিও তার মধ্যেও, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও, কোন কোন স্থানে মন্দির ভাংচুর, সম্পত্তি দখল, নারী অপহরণের কবলে পড়েছে দেশের হিন্দু সমাজ-তবুও পাকিস্তানী ভয়াবহতা দূর হয়েছিল সন্দেহ নেই। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় এবং তাঁর দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও, সাম্প্রদায়িকতার পূজারী, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী খোন্দকার মোশতাক ও তার কতিপয় অনুসারী স্থান পেয়েছিলেন এবং ক্ষেত্র-বিশেষে তাঁরাও প্রভাব খাটাতে পারতেন তারই পরিণতিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতামূলক কিছু ঘটনা ঐ আমলেও ঘটেছিল।

ঐ আমলের সর্বাধিক দুঃখজনক ঘটনা ছিল ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জারীকৃত “চরম বৈষম্যমূলক এবং বর্বরতম আইন” “শত্রু সম্পত্তি আইন” বাতিল করতে না করতেই, অর্থাৎ বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই “অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি আইন নামে একই আইন জারী রাখা। এর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে বছরের পর বছর ব্যাপী সর্বদলীয় ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আমলে এবং পুনরায় বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার পর অর্থাৎ ১৫ আগস্টের কিছুকাল পর থেকে। সে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের এবং হালের সংসদ ও মন্ত্রীদের মধ্যেও কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ইতিবাচক বিষয়টি হলো ২০০১ সালে “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১” নামে একটি আইন করে সে মোতাবেক অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের সুযোগ তৈরি করা হলো। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো সুযোগ সৃষ্টি করা হলেও , দীর্ঘ ১৮ বছর যদিও চলে গেল এবং তার মধ্যে ১১ বছর যাবত একটানাভাবে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেলও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করা হচ্ছে না-আইনটি বহাল রাখা হচ্ছে এবং তার অবৈধ দখলও অব্যাহত থাকছে। এ আইনের দাপটে ১৯৬৫ সাল থেকে অদ্যাবধি কয়েক লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। দেশত্যাগের প্রক্রিয়াও দিব্যি অব্যাহত আছে।
অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার স্বৈরাচারী শাসনামলে সংবিধানের শুরুতে “বিসমিল্লাহ”, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম সহ সকল ধর্মভিত্তিক দল সংবিধানের বে-আইনি সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ দলে পরিণত করা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেও বৈধতা দেওয়ার ফলে সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রীয় ভাবে পুনর্বাসিত হয়। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে আরও একধাপ এগিয়ে সংবিধানে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” লিপিবদ্ধ করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পাকিস্তানী করণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়ার আরও অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশের মৌলিক কাঠামোকেই আমূল বদলে দেওয়া হয়।

এর বিরুদ্ধেও আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, সিপিবি, জাসদ, বাসদ প্রভৃতি দলগুলি মিলে একটি আন্দোলনের মোর্চা গঠন করে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুদ্ধার ও জিয়ার পঞ্চম এবং এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের দাবীতে দেশটাকে কাঁপিয়ে তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট ও অন্য একটি মামলার রায়ে জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর “বিসমিল্লাহ ও ধর্মাশ্রয়ী দল বৈধকরণ” এবং এরশাদের অপর সংশোধনী মারফত “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” প্রবর্তনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়।

কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখতে হলো সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগটির অপব্যবহার করে ঐ সরকার সেগুলি নতুন করে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে “বিসমিল্লাহ” জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে পুনঅন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করা হলো রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে।

তদুপরি ২০০১ থেকে আজতক সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতামূলক ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হলো না আজ পর্যন্ত। এভাবেই ৭৫ এর পর থেকে সকল অমুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়, যেমন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ধর্মীয় বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হলো কাগজে-কলমে, আচার-আচরণে সর্বেবভাবেই।

একটি মসজিদ আক্রমণ করা দূর থাকুক, একটা ঢিল মারলেই অনেক সংখ্যালঘু গ্রেফতার করা হয় তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু হাজারটা মন্দির, হাজার হাজার প্রতিমা, গির্জা প্রবৃত্তিতে আগুন দিলে বা সেগুলি ভাঙ্গলে কি ঐ সম্প্রদায়গুলির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে না? হাজার হাজার এমন ঘটনা ঘটলেও মামলা একটিও হয় না কাউকে গ্রেফতারও করা হয় না ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে। সে কারণে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে যেহেতু তারা সংখ্যালঘু তাই তাঁদের প্রতি এই বৈষম্য। এমন কি মিথ্যা অভিযোগেও মসজিদের মাইক থেকে কোরান অবমাননা বা তদ্রূপ কোন অভিযোগে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কিছু প্রচার করা মাত্রই হাজার হাজার মানুষ দলবদ্ধ হয়ে অভিযুক্ত লোকটির ঘর বাড়ী জালিয়ে দেওয়া তাকে পেলে হত্যা করার মত ঘটনা ঘটতে তো কম দেখি নি। পরে তাকেই আবার গ্রেফতার করা অপরাধীদের নয় এমন ঘটনাও বিরল নয়।
দেশের অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করে বলছেন, গড়ে প্রতিদিন ছয় শতাধিক হিন্দু নরনারী বহুদিন যাবত নানা নির্যাতনের মুখে পড়ে দেশত্যাগ করছেন। এই হারে দেশত্যাগের অব্যাহত থাকলো, তাঁদের মতে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য দেশে পরিণত হবে।

এ ব্যাপারে সরকারের কাছেই তো প্রামাণিক তথ্য উপাত্ত সংরক্ষিত আছে। ১৯৫১ সালের জনগণনায় দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত ছিল ১৯৭২-৭৩ এ তা কত এবং এখন সর্বশেষ আদম শুমারিতে তা কত এ তথ্য সরকার প্রকাশ করলে বিষয়টির স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠবে। তেমনই আবার প্রতিটি নির্বাচনের আগে যে ভোটার তালিকা প্রণীত হয় তাতেও বিষয়টি পরিস্কার ভাবে জানা সম্ভব হতে পারে।

এখন প্রশ্ন তোলা যায়, এই দেশত্যাগ কেন? কেউই বিনা কারণে মাতৃভূমি ছেড়ে অজানা উদ্দেশ্যে বিদেশ ভূমিতে পাড়ি জমায় না। এই দেশত্যাগের পশ্চাতে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতন, অত্যাচার, বিভাজন ও বৈষম্যমূলক আচরণ রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে। আর সে কারণেই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসীরা ১৯৭৫ এর আগস্ট পরবর্তী কাল থেকেই নিজেদেরকে সেই যে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে ভাবতে সুরু করেছেন-দিন দিন তাই দৃঢ়মূল হয়েছে। সেই সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবতে বিরত করতে হলে-

এক. সংবিধান দ্রুত সংশোধন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধান অবিকল পুন:স্থাপন করতে হবে, “বিসমিল্লাহ”, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধকরণ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” বিলুপ্ত করতে হবে;

দুই. অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি আইন মোতাবেক এই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সকল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করতে হবে;

তিন. অন্তত: ২০০১ থেকে সংঘটিত ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতামূলক ঘটনাগুলির বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সরকারী উদ্যোগে মামলা দায়ের করতে হবে বিচারক শাহাবুদ্দিন কমিশন প্রদত্ত অভিমত অনুযায়ী;

চার. যাতে আর একজনও ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু দেশত্যাগে প্রবৃত্ত না হন তার উপযোগিতা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে;

পাঁচ. সিএস খতিয়ান অনুযায়ী সকল দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রয় বা জবরদখল কারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে;

ছয়. সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে খুলতে হবে ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে এবং

সাত. অবিলম্বে পার্বত্য সীমান্তচুক্তি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করতে হবে এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার ও তাদের ভূমির অধিকার স্বীকার করতে হবে।

এগুলির মাধ্যমে সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবনা বন্ধ হতে পারে।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ