প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
খুরশীদ শাম্মী | ১৪ মার্চ, ২০১৮
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়া একটি বই “লজ্জা” পাঠ থেকেই তসলিমা নাসরিনের লেখার সাথে আমার পরিচয়। তা অবশ্য দীর্ঘদিন আগের কথা। এরপর, জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে কিছুটা হার মেনে নিজেই অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে হলেও সম্ভব হয়নি, যখন তখন বাংলা বইপড়া।
তবে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠক হলেও বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগটা রাখার চেষ্টা করেছি সবসময়। এখন অবশ্য অনলাইনে সবগুলো বাংলাসংবাদপত্রই পড়তে পারি। বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের বেশ কিছু কলাম পড়ার সুযোগও হয়েছে। তিনি মূলত দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন। তার লেখার সাথে আমার নিজস্ব মতামতের শতভাগ মিল নাহলেও অধিকাংশ সময়ই মতামত মিলে যেতে দেখেছি। কিন্তু কখনোই সংবাদপত্রের লিংকগুলোর মন্তব্যের ঘরে কিছুই লেখা হয়নি।
এবার বন্ধু সেরিন ফেরদৌস বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে হাতে তুলে দিলো তসলিমা নাসরিনের “সকল গৃহ হারালো যার” বইটি পড়ার জন্য। বইটি হাতে নিয়ে কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, ৬৬টি কলাম নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বইটি; যার বেশ কিছু কলাম আমি পড়েছি ইতিপূর্বেই। তারপরও আবার পড়তে ইচ্ছে হলো এবং আমি পড়লাম। হাতে নিয়ে বইটি পড়ার যে আনন্দটি ছিলো, তাহলো, প্রথমত কাগজের গন্ধ, দ্বিতীয়ত,অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখার নিচে মন্তব্যের ঘরের মতো বিশেষ কোনো স্থান নেই, যেখানে উদ্দেশ্য মূলক, অশ্লীল ভাষায় কোনো মন্তব্যও করানেই।
বইয়ের প্রতিটি কলামেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তিনি নারী স্বাধীনতা, অস্প্রদায়িকতা, বাক স্বাধীনতা, ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন; যা যেকোনো সচেতন মানুষ মাত্রই করে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের বাইরেও ভারত, চীন, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশের রাজনৈতিকও ধর্মীয় অবস্থানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন বিশ্বের অনেক দেশের নেতাদের দমননীতি মনোভাব ও মৌলবাদের প্রভাবে খসে যাওয়া বিশ্বের একাল ও সেকাল।
একটি নয়, দুইটি পর্বে তিনি চীন দেশে নিজের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে তিনি চীনের সাধারণ জনগণের সাধারণ জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। চীনে তিনি “গ্রেট ওয়াল” দেখতে গিয়ে, দেখে এসেছেন “ফারার ওয়াল”। অর্থাৎ সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোই তিনি উল্লেখ করেছেন।যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন এখন প্রথম সারির একটি দেশ, কিন্তু চীনের পুলিশের বর্বরতা, সাধারণ মানুষের মনে সর্বদা ভয়, সে এক ভিন্ন জগৎ।
“নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে” শিরোনামে লেখার একটি অংশ এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, “আমি জানি আমাকে নিষিদ্ধ করার মতো সহজ কিছু নেই। কারণ আমাকে নিষিদ্ধ করলে ডানপন্থী হোক বামপন্থী হোক, চরমপন্থি হোক, নরমপন্থী হোক, পুরুষ হোক নারী হোক – কেউ প্রতিবাদ করে না।”
এই অংশটুকুন আমাকেও বেশ ভাবিয়েছে। জীবন অভিজ্ঞতার মাঝ পথে এসে এইটুকুন অবশ্য বুঝতে পারছি, তসলিমা নাসরিন ভুল লেখেননি একদমই।অন্যায় ও মিথ্যার প্রভাব এতো বেড়েছে যে সত্যবাদীকে নিষিদ্ধ করা যায় খুব সহজেই। কারণ সত্যবাদীদের দল নেই। তারপর আবার তিনি একজন নারী।
সত্য বলার অপরাধে নির্বাসনে থেকেও তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, “আমি চাই, বাংলাদেশ বাংলাদেশ রয়ে যাক, দুটি তিনটি নয়, বাংলাদেশ একটিই থাকুক। একটি বাংলাদেশই দেশের মতো দেশ হোক। ধনী দরিদ্রের পার্থক্য ঘুচে যাক। সকলেই খেয়ে পরে বাঁচুক। শিক্ষা স্বাস্থ্য পেয়ে বাঁচুক। বদ্ধ বুদ্ধির মুক্তি আসুক।” আবার তিনি ধর্মের খারাপ দিকগুলোর সমালোচনার পাশাপাশি ধর্মের ভালোদিকও তুলে ধরেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, “ইসলামের যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তাহলো জাকাত। জাকাতের নিয়ম আছে বলে গরিব দুঃখীরা কিছুটা খেতে-পরতে পায়।”
নাহিদ সুলতানাকে উৎসর্গ করা এই বইটি প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী, প্রচ্ছদ করেছেন শ্রাবণ প্রকাশনী’র কর্ণধার রবীন আহসান।
বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, তসলিমা নাসরিন নিষিদ্ধ হওয়ার মতো এবং সকল গৃহ হারাবার মতো কোনো লেখক নন। তিনি একজন মুক্তচিন্তক এবং বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ।তাঁর লেখায় সামাজিক, রাজনৈতিক ছোট ও বড় বিভাজনের অভিযোগ আছে,ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহারের ব্যাখ্যা আছে,যা যেকোনো সচেতন মানুষের নজরেই আসে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাঁর লেখা অভিযোগগুলো বিবেচনা করা সভ্য সমাজের জন্য খুবই জরুরী। মুক্তচিন্তক লেখককে নিষিদ্ধ করে, গৃহহারা করে সমাজ আর যা-ই পারুক, সভ্য হতে পারে না। তাঁকে নিষিদ্ধ করার দায় ঘুরে ফিরে কিন্তু আমাদের দেশের, আমাদের সমাজের, এককথায় আমাদের ঘাড়ে এসেই পড়ে। আমরা চাই, লেখকদের নিষিদ্ধ করে নয় বরং লেখকদের লেখাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ভুল সংশোধন করে দেশকে, সমাজকে সন্মূখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হবে প্রশাসনের উদ্দেশ্য।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য