আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধের সেইসব দিনগুলি

মোনাজ হক  

একাত্তরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন হয় বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট ও তাজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধানমন্ত্রী করে, আর ১৭ এপ্রিল সেই প্রথম বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে- একথা সকলেই জানেন। কিন্তু খুব কম মানুষই জানে যে, আমি ঠিক সেই ঐতিহাসিক দুটি দিনের মাঝে ১৩ এপ্রিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জে প্রায় ১০০০ জন ছাত্র যুবকের সাথে ভারতীয় গেরিলা ট্রেনিংক্যাম্পে যোগ দেই। আজ সেই কাহিনী শোনাব, মুক্তিযুদ্ধর ৪৭ বছর পরে। এর আগে বলে নিই, সেই ২৬ মার্চ থেকেই বগুড়া শহরে আমরা ৩ সপ্তাহ ধরে কিভাবে অবরোধ তৈরি করি, ঢাকা থেকে ঢোকার পথ ধ্বংস করে, আর রংপুর থেকে ঢোকার পথের ব্রিজকে ডেমুলেট করে দিয়ে বগুড়া শহরটিকে মুক্ত রেখেছিলাম প্রায় তিন সপ্তাহ, শেয পর্যন্ত এপ্রিলের ৮ তারিখে আমাদেরকে শহর ছেড়ে ভারতীর বর্ডারে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন সে সময়ের আঞ্চলিক কম্যান্ডের একজন লেফটেন্যান্ট ইদ্রিস, যিনি আমাকে কদিন আগেই প্রচুর ডিনামাইট (এক্সপ্লোসিভ) সরবরাহ করেছিলেন বগুড়া- রংপুর রোডের কাটাখালি ব্রিজটি ধ্বংস করাতে। সাথী যোদ্ধারা অনেকেই জিপগাড়িতে রওয়ানা হলেন, আর আমাকে ছাড়লেন না বগুড়ার সদরের আওয়ামী লীগ নির্বাচিত এমএনএ ড. জাহেদুর রহমান। তিনি ছিলেন আমাদেরই প্রতিবেশী, আগেও তাঁর বাসায় বহুবার গেছি, সেই সুবাদেই আঙ্কেল বলেই ডাকতাম।

আঙ্কেল জাহেদুর রহমানের বেশ বড় পরিবার, ৯ টি মেয়ে সন্তান; তাঁর কোন ছেলে ছিলোনা। বড় মেয়ে এলিজা, দারুণ সুন্দরী, আমাদের সাথেই কলেজে পড়ত, ক্লাসফ্রেন্ড, কাজেই তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আয়োজন করা হল দুটি গরুর গাড়ি, অবশ্যই ছই তোলা গরুর গাড়ি, যেন বাইরে থেকে কারো নজরে না পড়ে ভেতরে কে আছে।

যথারীতি প্রচুর শুকনো খাবার, ফলমূল আর পানীয় বোঝাই করা হলো। রওনা দিলাম ভারতীয় বর্ডারের দিকে আমার হাতে "থ্রি নট থ্রি" রাইফেল কিছু গোলাবারুদ, আর এক সহযোদ্ধা ও ছিল আমার সাথে, বলা যায়না তো পথে কী হয়, তবে আমদের দুজনার এই সামান্য "প্রতিরক্ষার" আয়োজন আর কিছু না করতে পারলেও জাহেদ আঙ্কেলের পরিবারের মনে কিছুটা সাহস জুটিয়েছিল বটে। শহর ছেড়ে কিছুদূর গ্রামের পথে হাঁটতেই পেছনে দেখলাম অনেক লোকজন আর গরুর গাড়ি আমাদের পথ অনুসরণ করে বর্ডারের দিকে হাঁটছে। প্রায় তিন দিন হাঁটা ও মাঝে মধ্যে বিরতিযুক্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১২ এপ্রিল বালুরঘাট পৌছায়ে শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছেই খবর পেলাম নতুন বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়েছে, ভারত সরকার মুক্তিফৌজ ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

আমাদেরকে বলা হলো, যারা ১৮ বছরের উপরে বয়স তারা শরণার্থী ক্যাম্পে থাকতে পারবেনা, আগামীকাল ভারতীয় আর্মি আসবে সবাই যেন প্রস্তুত থাকি যুদ্ধের ট্রেনিং এ যেতে হবে। ড. জাহেদুর রহমানের পরিবারের জন্য একটা বাসার ব্যবস্থা করা হল, আর আমরা শত শত শরণার্থীদের সাথে একটি রাত ক্যাম্পেই কাটালাম। পরদিন খুব সকালেই শুরু হয়ে গেলো আমাদের সুশৃঙ্খল সৈনিক জীবন, সকাল ৮ টার মধ্যেই এসে গেলো জলপাই রঙের ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর গোটা দশেক ট্রাক কনভয়।

আনেকেই পরিবারের সাথে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এই শরণার্থী ক্যাম্পে এসেছে সপ্তাহ খানেক আগেই (আমরা একদিন আগে) সবাই আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে অশ্রু সজল নয়নে বিদায় নিলো, আমার কোন আত্মীয় স্বজন ছিলো না সেখানে, প্রতিবেশী আঙ্কেল ড. জাহেদুর রহমানের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি গত রাতেই। ক্লাসমেট এলিজা, গত তিনদিন লম্বা হাঁটা পথ পাড়ি দিতে অনেক গল্পেই কাটিয়েছি, যার বেশিভাগ ছিল যুদ্ধের বীরত্বগাঁথা কাহিনী। সকালে যখন জলপাই রঙের ট্রাকে উঠি তখন একবার আমিও কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম, জানিনা আর কোনদিন এই পরিচিত মানুষগুলোর সাথে আবার দেখা হবে কি না।

বালুরঘাট থেকে রায়গঞ্জ ১০০ কিলো মিটারের একটু বেশি পথ, দুপুরের দিকে পৌছুলাম রায়গঞ্জ এর এক বিশাল জঙল এলাকায়, যখন কনভয় থামিয়ে আমাদেরকে ট্রাক থেকে নামতে বলা হল, অনেকেই ভয় পেয়ে গেলো, এই ভেবে যে এই গহন জঙলে ট্রেনিং এবং বসবাস করতে হবে?

সবকিছু মিলিটারি কায়দায় শুরু হলো। প্রথমেই লাইন করে দাঁড় করানো হলো, এক একটি লাইনে ১০ জন করে দাঁড়ানো ছেলেদেরকে একটা করে বড় তাঁবু দেওয়া হলো সেগুলো কিভাবে খাটাতে হবে একজন ভারতীয় ট্রেনিং ইন্সট্রাকটর দেখিয়ে দিলেন, এবং আমাদেরকে এক এক জায়গায় তাঁবু খাটাতে বলা হল, এই নিয়েই ব্যস্ত থাকলাম পুরোটা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, এর মাঝেই দুপুরের খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে, ঠিক মিলিটারি কায়দায়। যা বলছিলাম প্রায় ১০০০ ছেলে, তাদের জন্যে সমস্ত আয়োজন আগে থেকেই প্রোগ্রাম মাফিক তৈরি। কোয়াটার মাস্টার এর দায়িত্ব এতগুলো মানুষের তিন বেলা খাবার জোগান, মেন্টেন্ডেন্স মাস্টার এর দায়িত্ব তাঁবুর প্লান করা, সকলের জন্য কম্বল, বালিশ, স্নানাগার তৈরি, টয়লেটের ব্যবস্থা ইত্যাদি। তারপর ট্রেনিং কর্মসূচি। প্রথম এই বিশাল অর্গানাইজেশনাল আয়োজন ২/৩ ঘণ্টার মধ্যেই যখন আমরা সকলেই শেষ করলাম তখন এলেন ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর চক্রবর্তী ও ক্যাপ্টেন ডোগরা। আমাদের কাজ দেখে আশ্বস্ত করলেন, এবং প্রশংসাও করলেন, ক্যাপ্টেন ডোগরা যে আমরা পারব, অতি তাড়াতাড়ি ট্রেনিং শেষ করে, শত্রুর মোকাবেলা করতে।

ট্রেনিং ক্যাম্পের সেদিনের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমাকে ও সাথী যোদ্ধা দের মনোবলকে এতোটাই দৃঢ় করেছিলো যে আমরা পুরো তিন মাসের গেরিলা ট্রেনিং কিভাবে পেরিয়ে গেলো তা বুঝতেই পারিনি। আজ দীর্ঘ ৪৭ বছর পরে আমার এই স্মৃতিচারণ এক নস্টালজিয়াই বটে, জানিনা, আঙ্কেল জাহেদুর রহমান বেঁচে আছেন কিনা, তাঁর বড় মেয়ে এলিজা, আমাদেরই ক্লাসমেট ছিল, সে এখন কী করছে?

আমার এই লেখাটি যদি বগুড়ার কেউ পড়েন আর ড. জাহেদুর রহমান এর পরিবারের খবর জানেন ও চেনেন, তাহলে তাদেরকে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাবেন।

মোনাজ হক, সম্পাদক, আজকের বাংলা, জার্মানি।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ