প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৩ এপ্রিল, ২০১৮
ইন্টারনেট যুগে কোন একটি দেশ বা অঞ্চল বা মহল্লার মানুষের বিশ্ববাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। দ্রুত তথ্য সঞ্চালনের কারণে বিশ্বের খবর; জীবন প্রবাহ সম্পর্কে জানার সুযোগ প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে। ইন্টারনেট শিক্ষিতের হার প্রতিদিনই বাড়ছে। আর ইন্টারনেট যেহেতু অভ্যাসের ব্যাপার; তাই যারা একবার ইন্টারনেট-এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েন; তাদের পক্ষে টিভি দেখা বা খবরের কাগজ পড়া খুব ব্যতিক্রমী ব্যাপার।
তথ্য-শিক্ষা-বিনোদনের যে সমৃদ্ধ সম্ভার ইন্টারনেটে; তাতে যে বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রচলিত টিভি ও খবরের কাগজের ক্রম বিদায় ঘটছে। এফএম রেডিও-র কারণে রেডিও-র উপযোগ এখনো কিছু আছে। মোবাইল ফোনে এফএম রেডিও শোনার অভ্যাসটা হয়তো আরও কিছুকাল থাকবে। তবে রেডিও হোক-টিভি হোক-খবরের কাগজ হোক; তাদের প্রত্যেককেই ইন্টারনেট মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে। আর যে কোন গণমাধ্যমকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকতে হবে। ইন্টারনেট মাধ্যম যদি একটি জাহাজ হয়; গণমাধ্যমগুলো তাতে বেঁধে রাখা কিছু ডিঙি নৌকার মতো।
যাদের বয়স তিরিশ বছরের নীচে তারা ইন্টারনেট শিক্ষিত। ফলে তারা বিশ্বনাগরিক। ইন্টারনেট সুবিধা মেট্রোপলিস (কেন্দ্র) ও স্যাটেলাইট (প্রান্তিক) মানুষের মাঝের তথ্যের বিভাজন মুছে দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশী উপকৃত হচ্ছে তিরিশের নীচের তরুণ-তরুণীরা।
জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্র বাকস্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে, প্রতিটি নাগরিকের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার দায়িত্ব নেয়। নেদারল্যান্ডস পরিবেশ রক্ষার সর্বোচ্চ অঙ্গীকারে সবুজ ব্যবস্থাপনা (গ্রিন গভর্ন্যান্স) প্রতিষ্ঠা করেছে; সমাজের অপরাধীদের সংশোধনের মাধ্যমে কারাগার বন্ধ করে দিচ্ছে। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়েছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো। সম্পদের বৈষম্য হ্রাসের চেষ্টা; প্রতিটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ বৈষম্যের ভিত্তিতে বিভাজিত না করে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা দেখানোর চর্চা ক্যানাডার গণতন্ত্রে দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের যে কোন অবহেলাজনিত বিপর্যয়ে নাগরিকের সামনে মাথা ঝুঁকে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি জাপানের রাজনৈতিক অনুশীলনে দৃশ্যমান। সুতরাং সভ্য দেশ,গণতন্ত্র, সভ্য মানুষ দেখতে পিছিয়ে থাকা সমাজের তরুণকে সে দেশে যেতে হচ্ছে না। হাতের মুঠোতে পৃথিবীর আয়না হচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি।
ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এই তরুণদের চোখে অনেক শিক্ষককে পিছিয়ে পড়া মানুষ মনে হচ্ছে; পাড়ার মোল্লার ফতোয়া তাকে বিরক্ত করছে; রাজনীতিকের ফতোয়া তার কাছে সময়ের অপচয় মনে হচ্ছে; প্রশাসন-পুলিশের কর্কশ আচরণ তার কাছে বর্বর মনে হচ্ছে। কারণ সভ্য মানুষের খবর সে প্রতিদিনই রাখছে।
এই তরুণেরা আরও দেখছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স সভ্য জগতে বসে আদিম চিন্তায় সিরিয়ায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়োজন করছে। ঐসব দেশের তরুণেরা পথে নেমে রাষ্ট্রের দানবীয় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
এই তরুণেরা আরও দেখছে জাতিসংঘের লোক দেখানো পরিবেশ সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে পরিবেশ কর্মীরা বিক্ষোভ করছে; পরিবেশ বাঁচাতে কার্যকর কিছু করার দাবিতে। রুটিন নারী উন্নয়ন সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে নারী-অধিকার বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে নারী-কর্মীরা। কিংবা ডাভোসে ধনীদের সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়ছে তরুণেরা।
তারমানে পুরো পৃথিবী জুড়ে প্রতিষ্ঠান ও তার দুর্নীতিবাজ কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। সামাজিক সুবিচারের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন ও দাবি আদায়ই সভ্যতার ইতিহাসে মানব জাগরণের চিহ্ন। এটা তরুণেরা উপলব্ধি করছে।
সুতরাং তিরিশের নীচের তরুণ-তরুণীদের কাছে তার নিজের অনুন্নত সমাজের ধর্ম-রাজনীতির ভণ্ডামিগুলো স্পষ্ট। গাজোয়ারি ধর্মীয় বা লিপ-সার্ভিসের রাজনৈতিক ধমকগুলো তাদের বিস্মিত করে। এইসব চিন্তার পাতকুয়ায় আটকে থাকা ধর্ম-মামা ও সংস্কৃতি মামাদের দেখে তরুণেরা বিরক্ত হয়। যে তরুণ নানাবিষয়ে গোটাবিশ্বের সেরা বক্তাদের তথ্য সমৃদ্ধ বক্তৃতা ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেখে নিতে পারে; তার মনের গভীরে মহল্লার ধর্ম-রাজনীতির একই কথা নানান প্যাঁচ দিয়ে বলা ভিলেজ পলিটিশানদের প্রতি তীব্র বিবমিষা জাগা খুবই স্বাভাবিক। এই প্রত্যাখ্যানের চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে।
তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়েসি প্রজন্ম কিংবা তারও আগের প্রজন্মের জন্য জ্ঞানের উৎস ছিলো গ্রন্থ-পরিবার-শিক্ষক-ধর্মীয় নেতা-রাজনৈতিক নেতা বা প্রবীণেরা। জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিলো নিম্নমুখী। সিনিয়ার ডেকে জুনিয়ারকে
ধমক দিয়ে বা মাথায় হাত বুলিয়ে যা বলতো ঐটিই ছিলো ধ্রুব সত্য। জুনিয়ারের কাছ থেকে সিনিয়ারের শেখার কিছু নেই এটাই ছিলো প্রচলিত বিশ্বাস। আগের এই প্রজন্মের জন্য পরিতাপের বিষয় হলো এরা প্রবীণদের কাছেও ধমক খেয়েছে; এখন নবীনদের কাছেও অপাংক্তেয় বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। আগে পিতা-মাতা তার সন্তানকে বকাঝকা করতেন; আর একালে সন্তানকে রীতিমত বুঝে চলতে হয় অভিভাবকদের। এই বাস্তবতাটি সময়ের বিবর্তনে সমাজের উত্তরণ নির্দেশ করে। কারণ শিশু-কিশোর-তরুণের মতো আদরণীয় মানুষ তো পৃথিবীতে নেই। ওদের জন্য এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলাটাই তাদের চেয়ে বয়সে বড়দের কাজ।
এ লেখার শেষে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখতে চাই। শৈশবে আমার কোন বন্ধু আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করলে আমার অভিভাবকেরা আমাকেই শাসন করতেন। বুঝিয়ে বলতেন। আমার বন্ধুদের অভিভাবকেরাও ঠিক সেটাই করতেন। তারা শাসন করতেন তাদের সন্তানদের। অল্প কিছু অভিভাবক দেখেছি, যারা নিজের সন্তানের কোন দোষ খুঁজে পেতেন না।
যাদের অভিভাবক সবাইকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন; যারা বলতেন, আমাদের সবার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে; তাদের সন্তানরা সবাই ভালোই আছে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা হয়।
আর যে অভিভাবক নিজের সন্তানের কোন দোষ খুঁজে পেতেন না; হয়তো বলতেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে; তাদের সন্তানেরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লার লালসালু উপন্যাসের মতো হয় ধর্মের মজিদ হয়ে কিংবা ভিলেজ পলিটিক্সের মাতবর হয়ে সামান্য দুধভাতের জন্য-নিজেকে তরুণদের কাছে ক্ষমতাবান হিসেবে দেখাতে কত কষ্ট-কসরতই না করছে!
ব্যাপারটা শৈশবের শিক্ষণের কারণে কীনা জানিনা; এ কালের ধর্মের মজিদরা তাদের অনুসারী সন্তানদের দোষ খুঁজে পাননা। দোষ খোঁজেন অন্যের সন্তানের মাঝে; আর কাউকে তাদের অপছন্দ হলেই 'নাস্তিক' বলে দেন। আবার এ কালের ভিলেজ পলিটিক্সের মাতবরেরা তাদের অনুসারী সন্তানদের দোষ খুঁজে পাননা। কাউকে তাদের অপছন্দ হলেই 'রাজাকার' বলে দেন।
এ আর কিছুই নয়; তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে না পারা; নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে সমসাময়িক চিন্তাকে অনুধাবন করতে না পারা। শুধু নিজের সন্তানকেই দুধে-ভাতে দেখতে চাওয়ার আত্মকেন্দ্রিকতা। বিশ্বায়ন বা গোলকায়নের যুগে তারুণ্যের চিন্তাকে অনুসরণ করতে না পারা মানেই পিছিয়ে পড়া। কারণ তারুণ্যই সমসাময়িকতার সমার্থক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য