আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

নিহতের কাঁধে যখন নিজের মৃত্যুর দায়

সুকান্ত পার্থিব  

মানুষের মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেরই একটি অংশ। তবে মৃত্যুটি দুর্ঘটনাজনিত কিংবা হত্যাঘটিত হলে তা অপমৃত্যুতে রূপ নেয়। যদি দুর্ঘটনার কারণে কারো মৃত্যুর স্বপক্ষে কেউ মৃত ব্যক্তিকে দায়ি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তখন এরচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? এমন অভিব্যক্তির প্রকাশ তো চরম হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়! উচ্চপর্যায়ের বাহবা পেয়ে যুগে-যুগে এভাবেই অপরাধীরা সাহস পেয়ে উৎসাহিত হয়েছে আরেকটি অপরাধ করতে। বেড়েছে অপরাধ, আর সেইসাথে অপরাধ প্রবণতা।

যাইহোক সড়ক দুর্ঘটনায় গত পনের দিনের মধ্যে আমরা কলেজ ছাত্র রাজীব, গৃহকর্মী রোজিনাকে হারালাম। গত ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারওয়ানবাজার মোড়ে একটি বিআরটিসি বাস ও স্বজন পরিবহনের, আরেকটি বাস ওভারটেকিং করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে রাজীব হোসেনের ডান হাত কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি বাস থেকে পড়ে গেলে মাথার পেছনের ও সামনের হাড় ভেঙে যায়। মস্তিস্কেও আঘাত লেগে ঘটে রক্তক্ষরণ। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৬ এপ্রিল দিবাগত রাত আনুমানিক ১২টা ৪০ মিনিটে জীবনের কাছে হেরে যান রাজীব। পাড়ি জমান দূরদেশে মৃত্যুর অববাহিকায়।

ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো দরিদ্র পরিবারের এই সন্তান অভিভাবকহীন করে রেখে যান ছোট দুই ভাইকে। রাজীবের দুর্ঘটনার পর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবরটি সব গণমাধ্যম প্রকাশ করে। রাজীবহীন দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ ও তাদের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কথাও ওঠে আসে সংবাদ প্রচারে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এমন দুর্ঘটনা সত্যিই ক্ষোভ-আবেগ ও কষ্টবোধের জন্ম দেয় অনায়াসে।

গত ২০ এপ্রিল রাতে বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় ডান পা হারান গৃহকর্মী রোজিনা আক্তার। রাজীবের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৯ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটা নাগাদ তারও মৃত্যু হয়। সাম্প্রতিককালে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের সার্জেন্টের পা কাটা পড়লো, লেগুনার হেলপার পা হারালো, ইডেন কলেজের এক ছাত্রীও পা হারালো। এরপরেও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিগণ পরিবহন ব্যবস্থায় অসাবধানতা, চালকের অদক্ষতা-অসতর্কতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রকোপ, সড়কের দুরবস্থা নিয়ে নিশ্চুপ! তবে তাঁরা নিহতের ভুল নিয়ে বেশী ব্যস্ত! তাই তারা এখন ভুল খুঁজতে নেমেছে মৃত ব্যক্তির। এ নিয়ে সমবেদনা না জানিয়ে সঠিকভাবে রাস্তায় চলাফেরার দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন বিগত মৃত্যু থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্যে রাজীবের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বৈধতা পেয়েছে নিজের ভুলের কারণে!

রাজীবের মৃত্যু নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য বিভিন্ন জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ পায়। রাজীবের মৃত্যুর পরদিন ১৮ এপ্রিল সকালে তিনি বলেন, ‘হতে পারে ওই ছেলেটাও ভুল করতে পারে। তার দাঁড়ানোটা সঠিক নাও হতে পারে।’ এ ঘটনার সঙ্গে সড়ক ব্যবস্থাপনার কোনো সম্পর্ক নেই বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার জন্য চালক এবং যাত্রী দায়ী। ’তাঁর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ায় সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তিনি রাজীবকে দায়ী করে কোন কথা বলেন নি। তিনি গোপালগঞ্জের যে বাস হেলপার হাত হারিয়েছে তার কথা বলেছেন। পরে সংবাদকে ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য সেইসব মিডিয়াকে তিনি দোষারোপ করেন। তবে সড়ক ব্যবস্থার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে প্রতিটি দুর্ঘটনার। রাস্তায় যে সব যান চলাচল করে সেগুলোর কন্ডিশন, চালক-হেলপারদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা, ওভারটেকিং, রাফ-ড্রাইভিং এগুলো কি সড়ক ব্যবস্থাপনার বাইরে? ‘নিরাপদ সড়ক’ –এর প্রসঙ্গ আসলে এইসব কিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা অর্থাৎ একটির সাথে আরেকটির মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের কথা প্রকাশ পাবারই কথা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয় বাদ দিয়ে একই ঘটনার অন্য প্রসঙ্গে আলোকপাত করি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত বুধবার (২ মে) গণভবনে এক প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত পোষণ করেন সাম্প্রতিক সময়ের সড়ক দুর্ঘটনাগুলো সম্পর্কে। একজন সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার এই কথাগুলো অনেকে পছন্দ করবেন না, কিন্তু যা বাস্তব, তা-ই বলছি। রাস্তায় চলার নিয়ম আছে, সেটা আমরা কতটা মানি? একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে আসছে, আমরা হাত একটা তুলে রাস্তায় নেমে গেলাম... যারা পথচারী, তাদেরও কিছু রুলস জানা দরকার, মানা দরকার।’ হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল এবং সিটবেল্ট না বেঁধে গাড়িতে চড়াও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আপনি বাসে চড়ে যাচ্ছেন, কেন আপনি হাত বাইর করে যাবেন? আপনারা (সাংবাদিক) যার হাত গেল, তার জন্য কান্নাকাটি করছেন; কিন্তু সে যে নিয়ম মানছে না—সে কথা তো বলছেন না। ’(সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অনলাইন ভার্সন)

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার রাজীবকে নিয়ে পরোক্ষভাবে যে বক্তব্য দিলেন, তাতে আসলে তিনি কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন, তা আর না বোঝার অক্ষমতা কারো নেই বলেই প্রত্যাশা করি।

কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাকে তো আরেক জন মানুষ হিসেবে বলা কতটা সমীচীন যে তার ভুলের কারণেই মৃত্যু ঘটেছে! তেমনিভাবে কারো বেডরুমে ঢুকে যদি কাউকে কোন সন্ত্রাসী হত্যা করে রেখে যায়, তারপর তো ঐ সন্ত্রাসীর স্বপক্ষে যুক্তি দেয়া তো অমানবিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়! এমন ঘটনা এর আগে আমরা পত্রিকা বা টিভির সংবাদে অহরহ দেখেছি। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তির অভিব্যক্তি পেয়েছি নিহতের বিপক্ষে। যেমন ব্লগার, বিজ্ঞানবাদী ও যুক্তিবাদী লেখক, অধ্যাপক, প্রকাশক, সংগঠক, ইমাম-খাদেম এবং পুরোহিত-সেবায়েতকে একের পর এক হত্যা করা হয়েছে; আর আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গ মিডিয়ার মাইক্রোফোনে সাফা গেয়েছেন হত্যাকারীর কর্মকাণ্ডের।

ব্লগার-লেখক-অধ্যাপককে হত্যার পর কেউ বলেছেন ধর্মের বিরুদ্ধে অবমাননাকর লেখা তাঁরা লিখেছেন বলেই তাদেরকে খুনিরা এভাবে হত্যা করেছে। কখনো এভাবেও বলেছেন, মুক্তচিন্তার নামে স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে তারা ধর্মের বিরুদ্ধে লিখেছেন বলেই একটি বিশেষ মহল বা গোষ্ঠী তা মেনে নিতে না পেরে তাঁদেরকে হত্যা করেছে। আর কলমের লেখনির জবাব দিতে সেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা মহল চাপাতির মাধ্যমে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে অধ্যাপক-ব্লগার-লেখক-প্রকাশকের শরীর; সেটাই হয়ত পরোক্ষভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখপাত্রের কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য! কেননা না লিখলে স্বাধীন দেশে মুক্তমত প্রকাশ না করলে তো আর তাঁদের মরতে হত না!

এমন দায়িত্বহীন বক্তব্য বাংলাদেশ অনেক দেখেছে। প্রকাশক কেন ঐ অমুক লেখকের বই ছেপেছে তাই তাঁকেও মরতে হয়েছে এভাবে। অধ্যাপক-সেবায়েত-পাদ্রি কেন লোকসংগীত, বাউল গান, লালনের গান ভালোবাসবেন, কেন এই সমাজে সংগীতচর্চা করবেন? তাঁরাও বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছেন সাতচল্লিশ বছর বয়সী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে! এখনো দৃষ্টান্তমূলক একটি বিচারও দেখাতে পারেনি রাষ্ট্রের বিচারিক ব্যবস্থা! রয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের বহু ফাঁক-ফোঁকর। রাঘববোয়ালরা এখনো কলকাঠি নাড়ছেন। সময় অনুকূল হলেই হয়তবা হিংস্র পশুর বেশে আবারো প্রস্তুতি গ্রহণ করবে একের পর এক মুক্তমত প্রকাশের কণ্ঠরোধ করে শিকার সম্পন্ন করতে।

তেমনিভাবে আমরা দেখছি, দেখেছি ও দেখে যাচ্ছি একের পর এক ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেই চলেছে দেশের আনাচে-কানাচে। সব খবর তো আর পত্রিকায় সামনে আসে না! অনেক ধর্ষণের খবর ধামাচাপা পড়ে গ্রাম্য মাতুব্বরের প্রহসনের সালিশে। কত নারী কর্মস্থলে, রাস্তায়, বিপণিবিতানে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্লীলতাহানির কথা একরাশ ক্লেশ, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নিজের ভেতরে চেপে যান সমাজের কাছে নিজের সম্মানহানির ভয়ে! আবার কেউ প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিলেও কালক্ষেপণের লড়াইয়ে মহড়া দিতে হয় কাঠগড়ায়! পুলিশবাহিনী কর্তৃক ধর্ষিত দিনাজপুরের ইয়াসমিন থেকে পূর্ণিমা, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিরাপত্তা বলয়ে ধর্ষিত তনু থেকে তাসফিয়া আমিন এই চারটি নামের বাইরেও আমার হাজার হাজার বোনের মধ্যে ক’জনের ধর্ষণের ও হত্যার বিচার হয়েছে? ক’জনের পূর্ণাঙ্গ বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয়েছে? ক’জন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি এদেশের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে? প্রত্যাশিতভাবেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাঠক হৃদয়ের অজানা নয়!

একজন কিশোরীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করার পর এদেশের শিক্ষিত সমাজ বলছে মেয়েটি বেপর্দা ছিল, গান-বাজনা ভালোবাসতো, সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল; এজন্যেই এভাবে ধর্ষিত হয়ে মরতে হলো।

আমরা বক্তব্যের ফুলঝুরিতে নারীর অবাধ স্বাধীনতার কথা বলি, নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করি। যদিও মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিটি বক্তব্যে আর ‘সোস্যিও-পলিটিকাল পাবলিক ফেইসে’ বেশী সমাদৃত! দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন উচ্চপদে নারী নেতৃত্বে আস্থা রাখি। আর একজন নারী শ্লীলতাহানি হলে, ধর্ষিত হলে আমরা ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে ফেলি। আর সে ধর্ষক বা শ্লীলতাহানিকারী যদি সমাজে ক্ষমতাবান ও প্রতিপত্তিশীল হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই! নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের আইন ও তার কিছু করতে পারবে না অস্ত্র-ক্ষমতা আর অর্থের আধিপত্যে। তাই এ দেশে কোথাও নিরাপদ নয় আজ নারীরা; ঘরে কিংবা বাইরে!

বহু আগে থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজ, সুশীল সমাজ দোষ দিয়ে আসছে শিশু বা কিশোরী বা যুবতী বা নারীর পোশাকের ওপর। তিন বছরের অথবা পাঁচ বছরের শিশুর কী পোশাক পরার ধরণের দোষ থাকতে পারে? আর সেই দোষের কারণে দুধের বাচ্চাকেও এই জঘন্য সমাজ ব্যবস্থায় হতে হচ্ছে ধর্ষিত বা গণধর্ষিত! আমাদের সুস্থ-সবল মস্তিস্ক কি এই শিক্ষা দেয়, এই ধরণের বিবেকবোধ জাগ্রত করে?

বাংলাদেশে যখন যা ঘটে তা ট্রেন্ডিং হয়ে উঠে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে দেশব্যাপী ধর্ষকদের পেশিশক্তির মহড়া বেড়েই চলে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়িচালক সচেতন না হয়ে একের পর এক মানুষ নির্বিচারে মারতে থাকে। কেননা এ দেশে দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই; হতেই পারে বলে চালিয়ে দেয়া যায়! দৃষ্টান্তমূলক আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের অভাব এখানে চরমভাবে দৃশ্যমান। তাই সবকিছুতেই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে রাষ্ট্রের নড়বড়ে দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, আইনের ফাঁক-ফোকর, বিচারিক অনুশাসনের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের স্খলন, ঘুষ-দুর্নীতি, পেশাদারিত্বের অভাব, শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা চর্চার অভাব। আমরা এমন একটা সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে পরিবহন চালক রাজপথে দুর্ঘটনায় অজস্র প্রাণ কেড়ে নিলেও তিনি নির্দোষ বনে যান! গ্রেপ্তার হলেও রাতারাতি জামিনে মুক্তি পান।

ডাক্তারের চিকিৎসার ভুলে রোগী মারা গেলেও এখানে ডাক্তার নির্দোষ! মেডিকেল সায়েন্সের বিভিন্ন ব্যাখ্যায়, তত্বে পার পেয়ে যান প্রাণ হরণকারী চিকিৎসক। কলুষিত হতে থাকে পৃথিবীর মহত্তম এই পেশা। যাই হোক ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, স্বনামধন্য সাংবাদিক আশফাক মুনীর চৌধুরীসহ (বহুলভাবে পরিচিত মিশুক মুনীর নামে) পাঁচজন সড়ক দুর্ঘটনায় মানিকগঞ্জের ঘিওরে নিহত হন। গতবছর ২৩ ফেব্রুয়ারি হত্যাকারী বাসড্রাইভার-হেলপার বিচারালয়ের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে গ্রেপ্তার করা হয়। অপর এক মামলায় ২০০৩ সালে ঢাকার সাভারে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে এক ট্রাকচালক হুমকি দিয়ে এক নারীকে (খোদেজা বেগম) চাকায় পিষ্ট করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে আদালতের রায়ে চালককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে রায় ঘোষণা করে। এই দুইটি মামলার রায়ের ফলশ্রুতিতে গতবছর মার্চ মাসের শুরুতেই সারাদেশ ‘পরিকল্পিত পরিবহন ধর্মঘট’ -এ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা থেকে। দেশের নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান রাতারাতি ফিরে যান নিজের পুরনো রূপে! সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েও তিনি হয়ে উঠেন শ্রমিকদের প্রধান মুখপাত্র। সেসময় তাঁর মন্ত্রী পরিচয়ের চেয়ে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কর্ণধারের চেহারা বেশী প্রতীয়মান হয়েছিল জনসম্মুখে। তাঁর সমর্থন কোনদিকে ছিল তা তখনকার কর্মকাণ্ড ও উল্লেখযোগ্য বক্তব্য শুনেই বোঝা যায়। দেশে অচল করার পরিবহন ধর্মঘটকে উনি ‘শ্রমিকদের কর্মবিরতি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন খাতে শ্রমিক ও শ্রমিকের নেতারা সুসংগঠিত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তারা বেপরোয়া এবং নিজেদের প্রচলিত আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে মনে করে থাকেন।তাদের ভাবটা এমন- নিজেদের দোষে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করবে অথচ তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে না। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এখন দুর্বিষহ এক যন্ত্রণার নাম হয়ে ওঠেছে। জনসাধারণের ক্ষোভ-নিন্দা-প্রতিবাদ কোনোকিছুই সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারছে না। পারছে না শ্রমিকদের বিবেক জাগ্রত করতে। সড়কপথে নীরব হত্যাকাণ্ড চালিয়েও নিজেদের প্রাণের ভয় নেই বললেই চলে! সতকর্তাহীন বদভ্যাস পরিবর্তনের কোন নামগন্ধ নেই। সড়ক পরিবহনের শ্রমিকরা যানচলাচলের অসাবধানতার মানসিকতা থেকে এখন পা বাড়িয়েছে ধর্ষকামিতায়। টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে রূপাকে গণধর্ষণ ও পরে হত্যা করে লাশ গহীন জঙ্গলে ফেলে রেখে যাওয়া –এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমন ঘটনা আরও ঘটছে, সব হয়ত আসছে না আলোর সামনে! লোকাল বাসে হেলপার-কনট্রাকটর কর্তৃক শ্লীলতাহানির ঘটনা অনেক পুরনো হলেও এই ধর্ষকামি পাশবিক উৎপাতও দিনের পর দিন ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিন রাজধানী ঢাকার মালিবাগেও দু’জন তরুণীর উপর এমন পাশবিক আক্রমণের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে তাদের সাহসিকতায়।

এভাবে যদি হত্যাকারীর, ধর্ষকের, পরিবহন চালকের অপরাধের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে তাদেরকে দিনের পর দিন বক্তব্যের প্রেরণায় পুরস্কৃত করা হয়; তাহলে এদেশে অপরাধ সংঘটিত হবার প্রবণতা বাড়বে না কেন?

ভারতের কাশ্মীরে এক মন্দিরে আটকে রেখে আট বছরের শিশু আসিফাকে সাতদিন ধরে পুলিশ, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও হিন্দুধর্মের পূজারিসহ কয়েকজন মিলে গণধর্ষণ করে তাকে হত্যা করে। এই বছরের জানুয়ারিতে জম্মু ও কাশ্মীরের শহর কাঠুয়াররাসানা এলাকায় মুসলিম বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের আসিফা বানুকে এই ভীতিকর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, তা কল্পনাতেও অনুভব করা কষ্টসাধ্য। আসিফার গণধর্ষণ ও হত্যার সেই অকল্পনীয় বর্বরতার বর্ণনায় উত্তাল হয়েছিল ভারত। প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত ৮ জনকে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও ধর্মীয় প্রলেপ দিয়ে ধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষে আন্দোলন হয়েছে। সেখানেও বাঁধ সাধলো কথিত সাম্প্রদায়িক পরিচয়। হিন্দু বনাম মুসলমান। হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন জানালো ধর্ষকদের প্রতি। প্রায় তিনমাস পর জঙ্গলে পাওয়া ধর্ষিত শিশুর গলিত লাশ দাফন করতেও বাধা দিলো হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই রাজ্যমন্ত্রী আসিফা বানুর ধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষ নেয়। বাহবা পাওয়ার যোগ্য পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নিদর্শন! এখানেও পক্ষপাতিত্বের রাজনীতি, সমর্থনের কৌশলগত ইন্ধন! যদিও এটা বেশ পুরনো একটা পন্থা। সারা পৃথিবী জুড়েই এভাবেই বেড়ে চলছে অপরাধ আর অপরাধীর দুঃসাহসিক প্রবণতা। অবনমনের কোন পর্যায়ে এসে নেমেছে যে মানুষের মূল্যবোধ, তা কোনকিছুর মানদণ্ডেই পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও এমন কোনকিছুর ব্যতিক্রম নয়! মরতে মরতে আর মার খেতে খেতে আমরা সাধারণ মানুষ এতটাই আত্মকেন্দ্রিকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে প্রতিবাদের ন্যুনতম সাহসও বের হয় না বুকের ভেতর থেকে।

ইতিহাসের ধর্ষকামী মানসিকতার রক্তপ্রবাহ আজো নদীর মতো বয়ে চলে এই উপমহাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী! কোথায় গিয়ে পৌঁছাবো আমরা? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো আমরা? এই যে এত মোটা মোটা কাগজের সার্টিফিকেট, ভারী ভারী বইপত্রের জ্ঞান নিয়ে সত্যিই কী মানুষ হতে পেরেছি আমরা? নাকি শুধু চেহারায়, রক্ত-মাংস-চামড়ায় ধারণ করছি মানুষের অবয়ব? জানি না এর শেষ বলতে আরও কতো দেখতে হবে পাশবিক পৃথিবীর বিকৃত এই চেহারা?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ