প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ০১ জানুয়ারী, ২০১৯
সকল সন্দেহ, সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নির্বাচনী ঢোল বেশ জোরে সোরেই বাজতে শুরু করেছে অবশেষে। গত ১০ নভেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার ফলেই দেশব্যাপী নির্বাচনী ঝড় বেশ জোরে সোরেই বইতে শুরু করেছে। এখন সবাই আলাপ করছেন তীব্র প্রতিদ্বন্দিতামূলক হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-যদিও এখন পর্যন্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনে নির্বাচন কমিশন বা সরকার আজও এগিয়ে আসেননি।
নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনকে আরও বেশী প্রতিদ্বন্দিতামূলক করে তুলতে পারতো যদি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনকে তারা যৌক্তিকভাবে সংশোধন করতো। রাজনৈতিক দল গঠন করা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নিজেদের ও দলীয় অভিমত জনগণের কাছে অবাধে প্রকাশ করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র মৌলিক অধিকার-যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। অথচ নতুন কোন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্তে দলের কতগুলি শাখা কমিটি আছে, কতজন সদস্য আছে, কতগুলি অফিস আছে, কতজন নারী সদস্য আছে-প্রভৃতিসহ অনেকগুলি অপ্রয়োজনীয় শর্ত জুড়ে দিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষ গরীব ও শ্রমজীবীদের পক্ষে কোন দল গড়ার, তাতে সংগঠিত হওয়ার বা সেই দলের পক্ষে থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ হরণ করা হয়েছে যা সংবিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী দল “ঐক্য ন্যাপ” এবং আরও কিছু নবগঠিত দল দলীয় ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। বাধাটি অযৌক্তিক এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেই বিবেচনায় জরুরী ভিত্তিতে আইনটির সংশ্লিষ্ট নির্বাচনগুলি বাতিল করে ঐ দলটি ও দলগুলিকে এখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারেন।
তদুপরি নির্দলীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধান ঐ আইনে থাকলেও তাতে পূর্বাহ্নে ভোটারদের শতকরা একভাগের অর্থাৎ কয়েক হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত সমর্থন জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা ভোটারদের ভোট প্রদান বা সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার বিধান অমান্য করা হয়েছে এবং এ আইনটি ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় অবিলম্বে বাতিল করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাশীলতা ও ধর্মাশ্রয়ী চিন্তার প্রতিফলনহীনতা দৃষ্টে মনোনয়ন লাভের যোগ্যতা হিসেবে আইন করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান অত্যন্ত জরুরী।
বিদ্যমান আইনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে সমর্থন জানানোর সুযোগ থাকলেও “না” ভোট জানিয়ে কোন দল বা প্রার্থীর এক অসমর্থন জানানোর গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি অনুপস্থিত। সুতরাং সে অধিকারের স্বীকৃতি সম্বলিত আইন জারী করা হোক।
এভাবে সমগ্র জাতিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে বৈধভাবে সংযুক্ত করলে তার স্থায়ী সুফল চলমান ও ভবিষ্যতের নির্বাচনী অভিযানগুলিতেও নিশ্চিত ভাবে পাওয়া সম্ভব হবে।
আর একটি বড় প্রয়োজন দলীয় ভিত্তিতে যাঁরা নির্বাচন করবেন-ভোট প্রাপ্তিও যাতে দলীয় ভিত্তিতেই হয় তার বিধান করা। অর্থাৎ ভোটের সংখ্যানুপাতে বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা ঘোষণা। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি দল তাঁদের মনোনীত প্রার্থীদের (সর্বোচ্চ ৩০০ জনের) প্রেফারেন্সিয়াল তালিকা ভোটের অন্তত: দুই সপ্তাহ আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন এবং নির্বাচন কমিশন তা সকল সংবাদপত্রে সঙ্গে সঙ্গে প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচনী প্রচারণা হবে দলীয় ভিত্তিতে-কোন ব্যক্তি প্রার্থীর অনুকূলে নয়। এতে করে নির্বাচনী ব্যয় ও বিপুল ভাবে হ্রাস পেতে পারে এবং কালো টাকার খেলাও বন্ধ হতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভেবে সত্বরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। একমাত্র এই পদ্ধতির মাধ্যমেই জাতীয় নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটতে পারে। দলগুলিও প্রকৃত দেশ প্রেমিক প্রার্থীদেরকে নিশ্চিন্তে মনোনয়ন দিতে পারে।
গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে ধনিকদের স্বার্থে। এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসতেই প্রতিটি এলাকার অসংখ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দানের আকুতি সম্বলিত হাজার হাজার রঙ বেরঙের পোষ্টার। শুধুমাত্র আইন বাঁচাতেই এলাকাবাসীর নাম কদাপি জানা যায় না। কারণ প্রার্থী স্বয়ংই এমন পোষ্টার ছাপিয়ে তা টাঙানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। এ গুলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। শুধুমাত্র প্রতীক ঘোষণার পরই পোষ্টার ছেপে দেওয়ালে টাঙাতে পারবেন প্রার্থীরা-নতুবা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল প্রার্থীরা কোথাও ফাঁকা পাবেন না পোষ্টার লাগানোর জন্য।
আওয়ামীলীগ দলীয় মনোনয়ন ফরম প্রতিটি বিক্রি করলো সম্ভবত: ৩০,০০০/- টাকা করে। এটি অযৌক্তিক এবং ইঙ্গিতবহ যে শুধুমাত্র ধনীরাই ঐ দলের প্রার্থী হতে পারবেন। দলীয় মনোনয়ন ফর্ম কখনই ১০০০/- টাকার ঊর্ধ্বে এবং নির্বাচন কমিশনের জামানত ৫,০০০/- টাকার ঊর্ধ্বে নির্বাচন করা আমাদের মত দেশে নেহায়েতই অনুচিত। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে আমাকে জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়েছিল মাত্র ২৫০/- টাকা-সেটি বর্তমানে ২০,০০০/- টাকায় উন্নীত করে গুরুতর অন্যায় সাধন করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কাছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অনুরোধ জানিয়েছিল নির্বাচনী শিডিউল এক মাস পিছিয়ে দিতে আর যুক্তফ্রন্ট অনুরোধ জানিয়েছিল এক সপ্তাহ পেছাতে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সরকার সমর্থক যুক্তফ্রন্টের অনুরোধ রক্ষা করলো কি এই বিবেচনায় যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সহযোগী ? আর ঐক্যফ্রন্টের দাবী মানা হলো না তারা সরকার বিরোধী এবং সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটি নেহায়েতই যুক্তিহীন এবং এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের চিন্তার বাইরে যেতে বা নিরপেক্ষতার সাথে নির্বাচন পরিচালনা করতে অক্ষম। তাই একের পর এক সরকারি অভিমতের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যদি নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটি এক মাস না হোক, তিন সপ্তাহ তো পিছাতেই পারত এবং তা করতেও হয়তো যদি সরকারি দল, ১৪ দল বা যুক্তফ্রন্ট চাইতো। এহেন পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করে মাত্র।
এত কিছু স্বত্বেও বেশীর ভাগ দলের অংশ গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। তাই আগামী দিনগুলির জন্য যে যে পদক্ষেপ নির্বাচন কমিশন নিলে তা একটি সুন্দর নির্বাচনের পথকে সুগম করবে।
১. নির্বাচনে টাকার খেলা যাতে না ঘটতে পারে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ,
২. নির্বাচনে এখন থেকে ভোট গ্রহণের দিন এবং তারপরে আরও অন্তত: এক সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রক্ষা করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ;
৩. এ যাবত অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনের প্রাক্কালেই ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে। তারা অনেকেই নির্বাচনে তাঁদের স্বাধীন মতামত ব্যালটের মাধ্যমে গোপনে প্রকাশ করতে পারেন নি। তাই এবার যাতে তেমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব কোন মহল থেকেই ঘটাতে না পারে তার জন্য সর্বাত্মক এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হঠাৎ কেউ কিছু ঘটিয়ে ফেললে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ;
৪. নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈধ/অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি আদৌ নতুন কিছু নয়। সুতরাং তার প্রতি একদিকে যেমন তীক্ষ্ণ নজর রাখা এবং অন্যদিকে এই মুহূর্ত থেকে গোপনে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ব্যাপকভাবে সুরু করা প্রয়োজন;
৫. বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানের জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০ তে নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ২০১৮ এই ৪৬ বছরে ভোটার সংখ্যাও দ্বিগুণেরও বেশীতে পৌঁছেছে এবং তা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। এই বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে মোট আসন সংখ্যা অন্তত: ৪৫০ এ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আগামী নির্বাচনের পর নতুন সংসদে বসে এমন সংশোধনী এনে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে এমন প্রতিশ্রূতি প্রতিটি দলের নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে আনা হোক;
৬. আমাদের সংবিধানে নিদিষ্ট সময়ের জন্য মহিলাদের ৫০টি আসন নির্দিষ্ট করা আছে। ঐ আসনগুলিতে তাঁরা এম.পি.দের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান থাকলেও সংসদের যে দল অর্ধেকের বেশী আসন পায় তারাই সব কটি আসনে মনোনয়ন দিয়ে দলীয় শক্তিবৃদ্ধি করতে পারেন। আবার যদি নির্বাচিত সাংসদদের দলীয় আসন সংখ্যার ভিত্তিতে সকল দল ঐ ৫০টি আসন ভাগাভাগি করে দেন সেক্ষেত্রেও কার্যত: কোন নির্বাচন নয়-মহিলা এম.পি.রা হন মনোনীত এম.পি। এটি নারী সমাজের জন্য অসম্মানজনক। তাই ঐ আসনগুলিতেও সরাসরি নির্বাচনের বিধান করে জাতীয় সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৫০০ তে উন্নীত করার প্রতিশ্রæতি ও সকল দলের নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে আনা প্রয়োজন এবং
৭. দেশের সার্বিক অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে ১৯৭৫ এর পর বাহাত্তরের সংবিধান থেকে পশ্চাৎ মুখী বিচ্যুতি যার ফলে আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরাজিত পাকিস্তানী ধারার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া লক্ষণীয়। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এবারের নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে জরুরী প্রয়োজন। এ বিষয়ে নির্বাচনে কমিশনও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য