প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২০ অক্টোবর, ২০১৫
বাংলাদেশে চলছে শারদ উৎসব, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে বেশি সর্বজনীন বাঙালি উৎসব হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু পূজা শুরু হওয়ার আগেই সারাদেশে ধুম পড়েছে উৎসবের তবে সেটা পূজার উৎসব নয়। প্রতিমা ভাঙার উৎসব। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সারা দেশে ৩০ টির ও অধিক প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে।
নিরপেক্ষতা হারাবার ভয়ে ধর্ম বিষয়ক কোন লেখাই লিখব না মনস্থির করেছিলাম। ধর্ষক আর ধর্ষিতার ক্ষেত্রে যেমন নিরপেক্ষ হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না তেমনি ধর্মীয় নির্যাতনের ক্ষেত্রে ও তাই নিরপেক্ষ হবার কোন সুযোগ থাকে না। নির্যাতন কারী এবং নির্যাতিত দুইজনের প্রতি সমান সুবিচার করে নিরপেক্ষতার মতো মহান হওয়া সম্ভব নয়। আমার প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ করেন অনেকেই। তাই ফুল পাখি প্রজাপতি, কিংবা প্রেমের কবিতা লিখব, ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে মৌনব্রত পালন করব ভাবছিলাম। কিন্তু হয়ে উঠে না।
একটু পিছন ফিরে তাকালে ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা হওয়ার আগেই গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে তিন দিন ব্যাপী একতরফা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলেছিল। বাবরী মসজিদ ভাঙার পর সেটা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এরপর ১৯৯২ সালে যখন খালেদা জিয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৮ দিন ব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতন চালানো হয়েছিল সারা দেশ ব্যাপী। ২০০১ সালে বিএনপি পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল তাঁর ক্ষত এখনো বিদ্যমান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনায় সাহাবুদ্দীন কমিশন গঠিত হয়েছিল।
প্রায় ১৫ হাজারের মতো ঘটনা সেদিন সাহাবুদ্দীন কমিশনের কাছে উত্থাপিত হয়েছে। তার মধ্যে হাজার পাঁচেক ঘটনা নিয়ে কমিশন তদন্ত করেছিল। তদন্তের রিপোর্ট ২০১২ সালে পেশ করা হলেও কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন কিংবা দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বরং ২০১২ সালে হাঠহাজারী, রামু চিরিবন্দরে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। মানবতা বিরোধী অপরাধে সাঈদীর বিচারের রায় হলে তাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়। এসবের কোনটারই বিচার হয়নি। বরং কোন কোন জায়গায় সম্প্রীতি রক্ষার দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারাই চাপ প্রয়োগ করে আপোষ রফা করতে বাধ্য করেছেন।
ফেইসবুকে নানা রকম মন্তব্যের কারণে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে কাঠমিস্ত্রির সন্তান, এনজিও কর্মী অনেককেই জেলে প্রেরণ করা হয়েছে এবং এরা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা সবাই কোন না কোন ভাবে ইসলাম ধর্মের উপর তাঁদের মন্তব্য দিয়ে আঘাত করেছে। শুধু মাত্র শেষ দুই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০ টির ও অধিক মূর্তি ভাঙার অজুহাতে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগার সংবাদ ও পাই নাই। যদি ও সরকার বারবার বলছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। এবং তা কার্যকরও হচ্ছে তবে শুধুমাত্র ব্লগারদের ক্ষেত্রে।
আইনের শাসনের যাত্রাপথে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প গেয়ে বেড়াই, এমপি লিটন গ্রেফতার, মহিলা এমপির ছেলের জেল, এমপি বদির জেল, কিংবা বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের নেতাদের ফাঁসির রায়। মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া। সব ঠিক প্রক্রিয়ায় চলছে শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম, জীবনের কোন মূল্য নেই রাষ্ট্রের কাছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সন্ত্রাসী যে-ই হোক, হামলাকারী যে-ই হোক, তাকে ছাড়া হবে না। সংখ্যালঘুদের বলছেন, সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু বলে নিজেদের খাটো করবেন না। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য আশার আলো দেখায় কিন্তু পূজার আগে আগে সেই আলোটি নিভে যায়।
প্রতিবছর পুলিশ প্রহরায় দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। প্রশাসনের লোকজন সংবাদ মাধ্যমে গর্বের সহিত বলেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কি অদ্ভুত! ত্রিশলক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটা রাষ্ট্র। সবাই স্বাধীন ভাবে তাঁর ধর্মকর্ম পালন করবে, সংস্কৃতিকে লালন করবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল। সেখানে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেই দেশের নাগরিককে পুলিশ প্রহরায় তাঁর ধর্মপালন করতে হবে কেন?
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অপ-রাজনীতির শুরু হয়েছিল সেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন বা দেশান্তরী হতে বাধ্য করার মতো ঘটনা অনেকেই সহজ ভাবে মনে নিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যখন দেশ পরিচালনায় থাকে তখন এ সমস্ত ঘটনা স্বস্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়ার কোন উপায় থাকে না। প্রতিটা প্রতিমা ভাঙা কিংবা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলে কোন না কোন ভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম চলে আসে। নিকট সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লন্ডনে দলীয় নেতা কর্মীদের সাথে ছোট পরিসরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন যা মূলত আলোচনা সভা-ই ছিল। আমার নিজেরও সৌভাগ্য হয়েছিল দুইটি সভায় উপস্থিত থাকার।
অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ আগামী প্রজন্মকে উপহার দেয়ার অঙ্গীকার দুই বক্তার বক্তব্যেই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো দুইটি অনুষ্ঠানই শুরু হয়েছে পবিত্র কোরআন তেলোয়াতের মধ্য দিয়ে।অন্য কোন ধর্মের প্রার্থনা বা উপস্থিতি সেখানে ছিল না। বিষয়টা খুব সাধারণ কারও চোখে পড়ার কথা না হয়তো। প্রধান দুই নেতার ও দৃষ্টিগোচর হয়নি সেটা। এই ব্যর্থতা হতে পারে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের। বা তাঁরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই সেটা করেছেন। আওয়ামী লীগ ও তাঁর নেতাকর্মীরা যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন না করেন, শুধুমাত্র গলাবাজির জন্য অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ান তাহলে যা ঘটে চলছে সেটাই স্বাভাবিক। আব্দুল আজিজ ইউসুফ নামে এক মাওলানা যখন তাঁর ওয়াজে বলেন ‘’আমার রক্তে মিশে আছে মূর্তি ভাঙার নীতি, তুমি কি জানো না আমি মূর্তি কে কবর দিতে এসেছি, আমি মুসলমানের সন্তান। কিংবা ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে যখন তিনি শিরীক বলে ঘোষণা দেন ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস কে উনি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, দেওয়ান বাগী নিজকে যখন খোদা হিসাবে দাবী করেন, তাঁর প্রমাণ ইউটিউব জুড়ে কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। মামলাও হয়না জেলেও যায়না, তখন আমি দেশব্যাপী প্রতিমা ভাঙা কে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নেই। কারণ “আমার রক্তে মিশে আছে মূর্তি ভাঙার নীতি”।
পত্রিকায় দেখলাম লালমনির হাটে ১৫ টি পূজা মণ্ডপ কমিটি প্রতিমা ভাঙার প্রতিবাদ স্বরূপ পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তাঁদের এই সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানাই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তাই করা উচিৎ, এই বছর ঘটে যাওয়া ৩০টি প্রতিমা ভাঙার ঘটনার বিচার না হলে আগামী বছর থেকে একযোগে সব পূজা বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।
দেশে কোন ভিন্ন মত থাকবেনা, একদল অতি ধার্মিক প্রতিমা ভাঙবে। আরেক দল চাপাতি দিয়ে মানুষ দ্বিখণ্ডিত করবে।তার চেয়ে নীরব থাকাই শ্রেয়।
বাংলার আকাশে শরত আসে কবির কবিতায়, গানে ছন্দে উপমায়, রঙতুলি ক্যানভাসে। একদল মানুষ ভয়ে থাকে, সারা বছরের প্রতীক্ষার পর তাঁদের ধর্মীয় উদযাপনটুকু করতে পারবে কিনা। যেন নিষিদ্ধ কোন কর্মসূচী পালন করতে যাচ্ছে তাঁরা। মাটির মূর্তি একবার ভাঙলে হাজারবার গড়া যায়। হাজার হাজার বছরের যে বিশ্বাস সেটি ভাঙলে আর গড়া যায় না। তাই বিচার হীনতার চক্র ভেদ করে আওয়ামী লীগকে বের হয়ে আসতে হবে। পুলিশি প্রহরা নয়, বিশ্বাসের জায়গাটাকে শক্ত করুন। দেশের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে যাদের পূর্ব পুরুষের শ্রম ঘাম রক্ত। তাঁদের নিরাপত্তা হীনতার দায় আওয়ামী লীগ কোনভাবেই এড়াতে পারে না। এই মাটি এই দেশ কোন নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, বিশ্বাসী অবিশ্বাসী, আস্তিক, নাস্তিক, হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব মানুষের হোক। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য