প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সাব্বির খান | ২৬ নভেম্বর, ২০১৫
বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াতে ইসলামীর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আগে বা পরে একটা পটকাও ফোটেনি, কোন হতাহতের খবরও পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীগুলোর মাঝে পারস্পরিক সমন্বয়ের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল, যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
উচ্চ পর্যায়ের সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় আমরা সাধারণ পুলিশবাহিনীর উপর নির্ভর করি, যা একাধারে অবাস্তব এবং সেই সাথে ভয়ংকর বালখিল্য। ভাবনার এই সাধারণ ভুলের কারণেই একের পর এক ব্লগার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, প্রকাশক, লেখক, এমনকি পুলিশও মরছে জঙ্গিদের হাতে। তাদের কোনভাবেই প্রতিহত করা তো দুরের কথা, খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
সাকা চৌধুরী এবং মুজাহিদের ফাঁসির আগে বা পরে কোন জঙ্গি হামলা হয়নি বলে বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়েছে ভাবার কোন কারণ নেই। সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য জামায়াত-বিএনপি নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। আমরা জানি যে, জামায়াত ও তাদের সহযোগী বিএনপির সাথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদের নিবিড় সম্পর্কের রয়েছে। এই দল দুটি বিভিন্ন সময়ে সুবিধামত বিশ্বের বিভিন্ন সন্ত্রাসী, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে অরাজকতার চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে আইএস, আলকায়েদা, ব্রাদারহুড, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হিজবুত তাহরীর ছাড়াও আরো বেশ কিছু জঙ্গি-মৌলবাদী সংগঠন উল্লেখযোগ্য।
আদর্শগতভাবে আন্তর্জাতিক ইসলামীক জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কও ভিন্নতর। আল কায়েদা এবং আইএস বড় সংগঠন হলেও আদর্শগতভাবে পরস্পরের শত্রু হিসেবেই পরিচিত। সিরিয়াতে আইসিস ও আল কায়েদা ছাড়াও সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও তুর্কীর সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন ছোট ছোট ইসলামী জঙ্গি-সংগঠনগুলোও সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই সংগঠনগুলো আবার আদর্শিক ও নীতিগত প্রশ্নে আইসিস ও আল কায়েদাকে আলাদা আলাদাভাবে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। যার কারণে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোর এইসব ছোট ছোট জঙ্গি সংগঠনগুলো আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়াও পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে সমান তালে যুদ্ধরত।
গত ১৫ নভেম্বর গোলান হাইটস নামের একটি পার্বত্য অঞ্চলে আইসিস এর উচ্চপর্যায়ের একটা সভা চলাকালীন সময়ে আল কায়েদার আত্মঘাতি বোমা হামলায় আইসিসের উচ্চ পর্যায়ের ৬জন নেতা নিহত হন, যার মধ্যে ‘আবু আলী আল বারিদি’ নামের একজনও ছিলেন যিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘দ্য আঙ্কেল’ নামে পরিচিত। গোলান হাইটসের দুই-তৃতীয়াংশ ইজরায়েল এবং বাকী অংশ সিরিয়া সরকারের অধিকৃত হলেও বর্তমানে তা আইসিস দখল করে নেয়। (http://goo.gl/JdJknI)
বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং স্বার্থে, খুব ছোট আকারে হলেও বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে এই সংগঠনগুলোর নাম শোনা গিয়েছে এবং তারা ব্লগার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি হত্যাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে হেন কাজ নাই যে করে নাই। সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির সময় সরকারের অসাধারণ পারদর্শীতার কারণে হয়ত এই প্রথমবারের মত কোন ভয়ংকর কিছু করতে পারেনি। তবে ভবিষ্যতে যে তারা কিছু করার চেষ্টা করবে না, তা ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আগামীতে যে সব ঘটনা এসব জঙ্গিবাদের দ্বারা বাংলাদেশের মাটিতে দেখা যেতে পারে, তার লক্ষণ বা প্যাটার্নগুলো হতে পারে-
জামায়াত সুবিধামত খন্ড খন্ড ভাবে এইসব সংগঠনগুলোর সহযোগীতায় ভিন্ন ভিন্ন হত্যা, গুম এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাংলাদেশের মাটিতে ঘটাতে পারে।
এই সংগঠনগুলো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে নিজেরাই ছোট ছোট সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে পারে এবং সন্ত্রাস পরবর্তী সে দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে প্রচারের লক্ষ্যে মিডিয়ায় স্থান পেতে পারে টুইটার, মেইল এবং ফেইসবুকের মত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের দ্বারা, যা আমরা ইতিপূর্বে বিভিন্ন হত্যাকান্ডের পরে দেখেছি।
সাংগঠনিক সক্ষমতা সচল রাখতে এবং অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য সর্বহারা বা পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির অনুকরণে বিভিন্ন জেলা বা স্থানীয় পর্যায়ের গডফাদারদের ফরমায়েশী খাটার নামে বিশাল অংকের অর্থের বিনিময়ে এই সংগঠনগুলো হত্যা, গুম, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কাজ করতে পারে। এসব কাজেও দেশ অস্থিতিশীল হবে এবং একটি অনিরাপদ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পাবে, যাতে সরকার বিব্রত হবে।
সন্ত্রাসবাদি এই সংগঠনগুলোর মধ্যে বিরাজমান অভ্যন্তরিণ শত্রু-মনোভাবাপন্নতার কারণে, নিজেদের মধ্যে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ, হানাহানি, শক্তিপ্রদর্শন এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে ভূরাজনীতিতে স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের ভাবমূর্তি প্রচন্ড মাত্রায় ক্ষুণ্ণ হবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মত সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে, যা বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশ্য হাসিলের নামান্তর হবে।
আদর্শগতভাবে সন্ত্রাসী এই সংগঠনগুলোর কাজও ভিন্নতর হয়। যেমন আল কায়েদার ছাতা সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ব্লগার হত্যা করার পক্ষে এবং তারা তা করেছেও। সরকারের বাহিনীগুলো স্বভাবতই হত্যাকারীদের ধাওয়া করেছে এবং নির্মূল করার যাবতীয় কাজ করছে। এক্ষেত্রে আল কায়েদা এবং এর সমর্থক ভিন্ন নামের সংগঠনগুলোকে সায়েস্তা করার জন্য আইএস এবং এর ভাবাদর্শীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো ব্লগার, প্রকাশক বা লেখক হত্যা করে টুইট, ফেইসবুক, মেইল বা ফোনে আল কায়দা বা আনসারুল্লার নামে হত্যার দায় স্বীকার করবে। একই কাজ আনসারুল্লাহ বা আল কায়দাও করবে আইএসকে সরকারের গান-পয়েন্টে আনার জন্য। অভ্যন্তরিণ শত্রুতার জের হিসেবে হলেও এইসব জঙ্গিবাদের সন্ত্রাসের কারণে মূলত দেশ ও সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হবে। অস্থিতিশীলতার সুযোগ নেবে বিএনপি ও জামায়াত এবং বিপাকে পড়বে দেশের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের ধারা।
বিশ্বে বর্তমানে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে, সেখানেও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর সরব উপস্থিতি নিঃসন্দেহে ভীতিকর। জঙ্গিবাদ নির্মূলের নামে আরব মহাদেশে যা কিছু হচ্ছে, তা বিশ্বরাজনীতিকে দুইভাগে বিভক্তির সরলীকরণ মাত্র। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ কয়েক যুগ ধরেই বিশ্বের শক্তিধর মোড়ল দেশগুলোর কাছে বেশ লোভনীয় একটা দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনের একচেটিয়া ঠিকাদারি নেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ তার মিত্রদেশগুলো বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এঅঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি ঘটাতে। একারণে তারা যেকোন উপায়েই হোক বাংলাদেশে দুর্ধর্ষ আইএস ও আল কায়েদার উপস্থিতি প্রার্থনা করছে, যা তাদের স্থানীয় কূটনৈতিক আলোচনা-বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়।
উদ্দেশ্য সফল হলে সিরিয়ার মত জঙ্গিনির্মূলে নামে এঅঞ্চলে প্রবেশ করতে তাদের কোন অনুমতি লাগবে না এবং প্রক্রিয়াগত কারণে বাংলাদেশে ঘাটি গড়তেও শক্তিধর দেশগুলোর কোন অসুবিধা হবে না। সুতরাং তারাও যে এইসব জঙ্গিবাদকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে, এসন্দেহ থেকেও বেরিয়ে আসার কোন কারণ নেই। তবে প্রক্রিয়া যা-ই হোক, আখেরে বর্তমান সরকারই বিপাকে পড়বে।
সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির পরে পাকিস্তান সরকারের যে ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়া আমরা বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যক্ত করেছে, তাতে একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে, পাকিস্তান সাকা-মুজাহিদের ফাঁসিকে পাকিস্তানের দুইজন নাগরিকের ফাঁসি বলেই মনে করেছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ লালনের চারিত্রিক বৈশিষ্টের কথা কারো অজানা নয়। ব্যক্তিগত শত্রুতার দৃষ্টান্তস্বরূপ পাকিস্তান আবারো বিভিন্ন ধরণের ’২১-আগষ্ট’ এর জন্ম দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে তারা সরাসরি অথবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহযোগীতা নিতে পারে।
সন্ত্রাসবাদ কোন দেশের জন্য একক কোন সমস্যা নয়। এক সময় ইউরোপীয়রা ভাবতো, জঙ্গিবাদের সমস্যা শুধুই আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশের। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে আমরা ফ্রান্সে জঙ্গিবাদের যে ভয়বাহতা দেখেছি, তা দুঃস্বপ্নের সাথে তুলনা করলেও ভুল হবে। দেরিতে হলেও পশ্চিমা গোষ্ঠী আজ হয়ত কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে যে, যে সমস্যাটা বৈশ্বিক ভেবে তারা এতোদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, তা আজ তাদের নিজেদের ঘরেই উপস্থিত। জঙ্গি ও মৌলবাদের যে সন্ত্রাসের কালো ছায়া, তা আন্তর্জাতিক ঐক্যেই সম্ভব মোকাবেলা করা। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, যার যার ঘর নিজেকেই আগে সামলাতে হয়।
বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বিষয়টি নিঃসন্দেহে পরীক্ষিত এবং আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ঠ সমাদৃত। তবে এটা ভেবে কোন মতেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা উচিত হবে না যে, ‘সন্ত্রাসবাদ আমাদের আর কিছুই করতে পারবে না’। বরং বাংলাদেশে ইতিপূর্বে ঘটা বিভিন্ন সন্ত্রাস মোকাবেলায় সরকার যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তাকে আরো বেশি মাত্রায় পূঁজি করে আগামীর সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আরো বেশি সতর্ক অবস্থানে থাকাটাই বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে। এজন্য পুলিশবাহিনী সহ দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও সংস্থাকে আরো বেশি মাত্রায় এবং যথাসাধ্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিভিন্ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরিণ সমন্বয়কে আরো অধিকতর গুরুত্বের সাথে ক্রিয়াশীল করতে হবে। সেজন্য তৈরি করতে হবে এমন এক ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয়-সেল’, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোন ছোট অথবা বড় ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমণের আগে, পরে বা মূহুর্তের মধ্যে একযোগে প্রতিহত করা সম্ভব হয়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পর্যায়েও ঢেলে সাজাতে হবে জঙ্গিবাদ প্রতিহতের অনুকূল করে। দেশের জনগণকে করতে হবে অতিমাত্রায় সতর্ক এবং জঙ্গিবাদের ভয়ংকর রূপের ব্যাপারে দিতে হবে পর্যায়ক্রমিক তথ্য ও জ্ঞান। যেকোন মাত্রার সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সরকারের সাথে সরাসরি জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া আধুনিক যুগের সন্ত্রাসবাদ দমন অসম্ভব প্রায়। এব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরগুলো নিশ্চয়ই অবগত আছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য