প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইমতিয়াজ মাহমুদ | ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নাম তো জানেন। আমাদের দেশের জাসদ না, হিটলারের পার্টি, জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা National Socialist Party ইংরেজিতে যেটাকে সংক্ষেপে বলে নাজি পার্টি, সেই জাসদের কথা বলছি। না, জাসদ নামে হিটলারের পার্টিকে রেফার করলে কনফিউশন হতে পারে। জাসদের বন্ধুরা আবার গোসাও করতে পারেন। চলেন বরং ওদেরকে নাজি পার্টিই বলি। নাজি পার্টি নামেই ওরা অধিক পরিচিত।
এই নাজি পার্টি আবার জার্মানির বাইরে অন্যান্য দেশেও আছে। ইউরোপে আর আমেরিকায় তো এখনো আছে। আমাদের এখানে আছে কিনা জানিনা, জাসদের বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি।
আমাদের স্বাধীনতার কয়েক বছর পরের ঘটনা এটা। আমেরিকাতে যে নাজি পার্টি আছে, ওরা একটা শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে, যেটা ইলিনয় রাজ্যের স্ককি গ্রামের ভিতরের বড় রাস্তা হয়ে যাবে। এই স্ককি গ্রামটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই গ্রামের ইহুদিদের বসবাস বেশী আর ইহুদিদের প্রায় প্রতিটা বাড়ীতেই কেউ না কেউ হিটলারের হলোকাস্ট ভিকটিম আছে। বুঝতেই পারছেন, এই গ্রামের মধ্যখান দিয়ে নাজি পার্টি শোভাযাত্রা নিয়ে যাবে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে।
শোভাযাত্রা বলছি, মিছিল না। কারণ ব্যাপারটা মিছিলের চেয়ে একটু বেশী। ওরা ব্যানার ফেস্টুন তো নিয়ে যায়ই, আর মিছিলে যারা থাকে ওরাও হিটলারের নানারকম বাহিনীর ইউনিফর্ম পরে যায় একদম দৃশ্যমান স্বস্তিকা লাগানো থাকে ঐসব আরকি। ফলে ব্যাপারটা আর কেবল মিছিলের মত থাকে না, প্রকৃতই শোভাযাত্রায় পরিণত হয়ে যায়। আপনি অনুমান করতে পারেন ইহুদি পরিবারগুলিতে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে এইরকম একটা শোভাযাত্রা যদি ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যায়।
ইলিনয়ের কর্তৃপক্ষ দিয়েছে সেই শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞা জারি করার আরও কারণ ছিল। নাজি পার্টির ঐরকম শোভাযাত্রা এর আগে যেদিক দিয়ে যেখানেই গেছে সবকয়টাতেই দাঙ্গা হাঙ্গামা মারামারি হয়েছে। সেজন্যে ওরা বলে দিয়েছে, ভাই, এই স্ককি গ্রাম হচ্ছে ইহুদিদের গ্রাম, এর মাঝখান দিয়ে তোমরা এইরকম শোভাযাত্রা নিয়ে যাবে, তা হবেনা। নিষেধাজ্ঞা। ইনজাঙ্কশন।
২
আমেরিকার নাজি পার্টি সেই ইনজাঙ্কশনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। কি? না, আমাদের পূর্বপরিকল্পিত শোভাযাত্রার উপর এইরকম ইনজাঙ্কশন জারি করা আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে, এটা অবৈধ। সেই মামলা গেল আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত।
নাজি পার্টির পক্ষে সেই মামলায় উকিল কে ছিল জানেন? আরিয়া নায়ার (Aryeh Neier) নামের এক ইহুদি উকিল। শুধু ইহুদি না, বেশ একটিভ ইহুদি, ওর শৈশবেই ওর পরিবারের একটা বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল হিটলারের হলোকাস্টে।
এই আরিয়া নায়ার আবার যেমন তেমন উকিল না। সেই সময়ে আমেরিকান সিভিল লিবার্টি ইউনিয়নের (ACLU) সে ছিল পরিচালক বা নির্বাহী পরিচালক। আপনার পরিচিত 'হিউম্যান রাইট ওয়াচ' (HRW) নামে যে একটা সংস্থা আছে, আমাদের এই আরিয়া বাবু ছিলেন সেই সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
তখন কথা উঠলো, যে ACLUর কর্মকর্তা হয়ে আর নিজে ইহুদি হয়ে আরিয়া নায়ার কেন নাজি পার্টির অধিকার রক্ষার জন্যে আদালতে লড়তে গেল। ওদের যদি অধিকার খর্ব হয়ে থাকে, ওরা নিজেরা লড়ুক, নিজেরা যা খুশী তাই করুক। আপনার কি দায় পড়েছে আপনার শত্রুর হয়ে শত্রুর ফ্রিডম অভ স্পিচ রক্ষার জন্যে লড়াই করা।
এই কথাটার জন্যেই এই গল্পের অবতারণা করেছি ভাইজান। আমি যাকে অপছন্দ করি বা এমনকি আমি যাকে ঘৃণা করি সেরকম লোকের ফ্রিডম অভ স্পিচ রক্ষার জন্যে আমাকে কেন লড়তে হবে? এই প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা জন্যে।
আরিয়া নায়ার জবাবে বলেছিলেন, ‘নাজিদের কথা বলার অধিকার থাকতে হবে কারণ ইহুদিদের কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে কারণ আমারও কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে।' তিনি বললেন ‘শত্রুর অধিকার রক্ষাই হচ্ছে স্বাধীনতার শত্রুদের হাত থেকে একটা মুক্ত সমাজকে রক্ষা করার একমাত্র পথ।'
৩
এইটাই হচ্ছে আসল কথা। এইখানেই আমরা যারা মুক্তমনা যারা বাকস্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলি তারাও অনেক সময় ভুল করি। আমরা আমার নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়তে দাঁড়িয়ে যাই, বন্ধুর স্বাধীনতার জনী লড়তে দাঁড়িয়ে যাই। সেটা ঠিক আছে সেটা তো করতেই হবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী যেটা, আমার শত্রুর বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্যে লড়া, সেই সময়ে দেখা যায় বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রশ্নে আমাদের ঈমান নড়বড়ে হয়ে যায়।
শত্রুর বাক স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলেই আমরা ভুলে যাই যে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা হচ্ছে একটা বিষয় নিরপেক্ষ ব্যাপার। অর্থাৎ কিনা যে কথাটা বা যে বক্তব্যটা প্রকাশের জন্যে আমি লড়ছি সেই কথাটার গুনগত মানের উপর তার স্বাধীনতা নির্ভর করে না। আপনি কি বলতে চাইছেন তার যথার্থতা বিচার করে তারপর বলবো আপনার সেই কথাটা বলার স্বাধীনতা আছে কি নাই তা হবেনা। আপনি যা খুশী তাই বলতে পারেন। যা খুশী তাই। সেই কথাটা যদি গু-এর মত দুর্গন্ধযুক্ত হয় তবুও।
ঐযে ভল্টেয়ার সাহেবের কোটেশন মুখস্থ করেছেন, যে আমি তোমার সাথে একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথাটি বলার অধিকার রক্ষায় নিজের রক্ত দিতে রাজি আছি, কোটেশনটা মুখস্থ করে রাখলে হবেনা। রক্ত না ঝরান, বিপক্ষের কারো স্বাধীনতা খর্ব হলে অন্তত মুখের কথাটা তো বলতে পারেন আরকি। বলতে তো পারেন যে না, কণ্ঠরোধ করা অন্যায়, এমনকি সে যদি হয় শয়তানের কণ্ঠও।
এইটা যদি করতে না পারেন, তাইলে আপনার স্বাধীনতাও সুরক্ষিত হবে না।
৪
প্রসঙ্গটা আমাদের এখানে, আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে এখন খুবই জরুরী। কেন? কেননা আমাদের এখানে একটা ভয়াবহ প্রবণতাটা হয়েছে। কথায় কথায় মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়া। আর একজনের যখন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে তখন তার প্রতিবাদে কেবল ওর বন্ধুরাই এগিয়ে আসে। অন্যরা তখন হয় নীরব থাকে নইলে মিন মিন করে বা কিন্তু তবে যদিও শুরু করে দেয়।
অভিজিৎ খুন হয়েছে আজকে এক বছর হতে চললো প্রায়। মুক্তমনাদের উপর আক্রমণ প্রসঙ্গে আমাদের বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া দেখেছেন? মুক্তকণ্ঠে কেউ বলেছে যে না এটা অন্যায়, একজন নাস্তিক বা ধর্মবিদ্বেষীরও কথা বলার অধিকার আছে? কেউ বলেছে যে কথার বিষয়বস্তু যাই হোক, কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবেনা? না। বলেনি। যারা এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন ওরা মুক্তমনাদের পক্ষের লোক। আর বাকিরা ইতং বিতং করে ইয়ে পেঁচিয়ে ধুম্রজাল তৈরি করেছেন।
ওদের এই আচরণের আমি নিন্দা করবো কি করে। যখন দৈনিক আমার দেশ বন্ধ হয়েছিল তখন কি আমরা বলেছি যে না, একটা খবরের কাগজ এরকমভাবে বন্ধ করা ঠিক না? আমি বলেছি ফেসবুকে, কিন্তু আমার কণ্ঠের আর জোর কি? আমার বন্ধুরা তখন বলেছেন যে না, ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে, শয়তানটার কণ্ঠ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।
ওদের কণ্ঠ যখন রুদ্ধ হয়েছে আমরা প্রতিবাদ করিনি আর আমার কণ্ঠ যখন রুদ্ধ হচ্ছে তখন ওরা প্রতিবাদ করবে না। ফলাফল যা হয়ে সেটা ভয়াবহ। এইসবের ফলে রাষ্ট্র এবং সরকার স্বৈরাচারী হয়ে পরে। রাষ্ট্রের যেসব অগণতান্ত্রিক অঙ্গ নিজেদের হাতে ক্ষমতার সুতা ধরে রাখতে চায় ওরা তখন মাস্তানে পরিণত হয়। আমাদের এখানে, আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে আমরা যদি এই অবস্থানটা নিতে না পারি, যদি নিশ্চিত করতে না পারি যে কারো কণ্ঠই রুদ্ধ করা হবেনা তাইলে সামনে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর।
৫
ইতিমধ্যে লক্ষণ একটা দুইটা করে দেখা যাচ্ছে। 'ম থ্যাংগারি' নামে চাকমা ভাষার সিনেমাটার সেন্সর সার্টিফিকেট হয়নি সেনাবাহিনীর আপত্তির কারণে। চিন্তা করতে পারেন? সেনাবাহিনী বলে দিয়েছে এই সিনেমা দেখানো যাবেনা, ব্যাস, দেখানো যাবেনা। দৃশ্যতই অন্যায় এবং অবৈধ একটা কাজ। কিন্তু সেরকমভাবে কেউ প্রতিবাদ করেছেন? করেননি। আরও উদাহরণ দিতে পারি। যে ছেলেটা সিনেমাটা বানিয়েছে সে আদালতে গিয়েও কোন প্রতিকার পাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
এরকমই হবে। এখনই বলেন যে, না, লিবার্টি হচ্ছে একটা বিষয় নিরপেক্ষ ব্যাপার, কারো কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবেনা, এমনকি সে যদি হয় শয়তানের কণ্ঠ, তবুও না। নাইলে আগামীকাল আপনার কণ্ঠও রুদ্ধ হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য