আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পাপ গোপন করার চেষ্টা আহতকে রক্তাক্ত করার শামিল

জুয়েল রাজ  

গত ২১ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া তার দলের  মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে  বিতর্ক আছে বলে  মন্তব্য করেন। এর পর ২৫ শে ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুর জন্য তাঁদের নির্বুদ্ধিতাই দায়ী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়ের  এমন  বক্তব্য ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির নেতাদের একের পর এক বক্তব্য আসলে এক সুতায় গাঁথা।  তাঁদের এইসব বক্তব্য  বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা শুধুমাত্র বলার জন্য বলা,  বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকেনা। খালেদা জিয়া আসলে শুরুটা করে  দিয়েছেন মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধ একটি মীমাংসিত বিষয়। ৩০ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষের অধিক বীরাঙ্গনার ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা। বাংলাদেশের একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সঠিক সংখ্যা  নিয়ে হঠাৎ করে বিএনপি শিবিরে স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মাথায় মীমাংসিত একটি বিষয়কে বিতর্কিত করার রহস্য কি? যা  বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদাজিয়ার বক্তব্য দিয়ে শুরু। যদিও এর আগে জামায়াত ইসলাম মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মাঝে মাঝে গাই গুই করতো।

পৃথিবীর কোন গণহত্যায়ই  মাথা গুনে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণের কোন ইতিহাস জানা নেই।

একমাত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠিত কালীন সময়ের যুদ্ধকালীন নিহত আহতর একটি তথ্য পাওয়া যায়। যা নিম্নরূপ: মুসলমানদের বন্দী ১ জন, আহত ১২৭ জন, শহীদ ২৫৯ জন, মোট ৩৮৭ জন। অন্যদিকে কাফের,ইহুদী-খৃষ্টান ও পৌত্তলিক বিরোধী দলের বন্দী ৬, ৫৬৪ জন। আহত নেই। নিহত ৭৫৯ জন, মোট ৭৩৩২ জন, এতে উভয় পক্ষের মোট সংখ্যা  বন্দী ৬৫৬৫ জন, আহত ১২৭ জন, নিহত ১০১৮ জন। সর্বমোট ৭৭১০ জন। এর মধ্যে ৬৫৬৪ বন্দী থেকে ৩৬৪৭ জনকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হয়। পূর্ব অপরাধের প্রেক্ষিতে মাত্র দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বাদবাকি বন্দীদেরকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে এক  প্রতিবেদনে দেখা যায়  রাশিয়ার ১৭ লাখ। জার্মানের ১৬ লাখ। ফ্রান্সের ১৩ লাখ ৭০ হাজার। ইটালির ৪ লাখ ৬০ হাজার। অস্ট্রেলিয়ার ৮ লাখ। বৃটেনের ৭ লাখ ৬ হাজার। তুর্কি ২ লাখ ৫০ হাজার। বেলজিয়ামের ১ লাখ ২ হাজার। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া ও মোলিনিরগোর ১ লাখ করে মোট ৪ লাখ। আমেরিকার ৫০ হাজার। সর্বমোট ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার। ভারত, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের  উপনিবেশ রাষ্ট্রগুলোর হিসাব এখানে আসে নাই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক কোটির নিচে নিহত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে তিন কোটিকেও ছাড়িয়ে যায় নিহতের সংখ্যা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন পক্ষই এই সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখায়নি।

২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিস এক বক্তব্যে বলেছিলেন ‘’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান শাসনের অধীনে আর্মেনিয়ায় যে বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল তা ছিল গণহত্যা। আর্মেনীয় এবং অন্য অনেক ইতিহাসবিদের দাবি, ১৯১৫ সালে তৎকালীন অটোমান শাসকদের হাতে প্রায় ১৫ লাখ আর্মেনীয় নিহত হয়েছিল। আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া ও উগান্ডা অনেক আগেই ওই ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত আজকের তুরস্ক বরাবরই সেটা অস্বীকার করে এসেছে। তুরস্কের দাবি, নিহতের সংখ্যা আদতে অনেক কম।

আর্মেনীয় গণহত্যার দায় বরাবর অস্বীকার করে এলেও গত বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান নিহত আর্মেনীয়দের নাতি-নাতনিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তিনি অবশ্য এটাও বলেন, পুরনো ওই ইস্যুর জেরে আর্মেনিয়া রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।সেই সময় বিবিসি পোপের সেই বক্তব্য নিয়ে  একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিল। প্রসঙ্গত, আর্মেনিয়া প্রথম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। সেই আর্মেনিয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তুরস্কের অস্বীকৃতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে পোপ বলেন, 'পাপ গোপন করা বা অস্বীকার করাটা আহত ব্যক্তির ক্ষতে প্রলেপ না দিয়ে রক্ত বইতে দেওয়ার সঙ্গে তুলনীয়।
 
পাকিস্তান যদিও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তুরস্কের মতোই প্রতিবাদ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। সেই কাজটি বিএনপি করছে এখন। একাত্তরের পাকিস্তানের পাপকে গোপন করে বাঙালির কোমল অনুভূতির জায়গাকে রক্তাক্ত করছে।
 
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে শহীদের সংখ্যা তথ্য নিয়ে অনলাইনে  একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই তথ্যগুলো যে কেউ পাবেন। এর জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গবেষণা ধর্মী কাজ করছেন। সেইসব তথ্য থেকে দেখা যায়।

১৯৬৯ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৬৯৮ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিবেচনা করলে ১৯৭৪ সালের আদমশুমারিতে জনসংখ্যা ৮০১ লাখ হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল ৭৬৪ লাখ। যা প্রায় ৩৭ লাখ কম ছিল। তাই ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল যুদ্ধে এটি যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। এখানে ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বরের সাইক্লোনে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়াকে বিশেষ বিবেচনায় নিলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষই হয়।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গণকবরগুলোর সন্ধান খুব কম করা হয়েছে। বেশিরভাগ গণহত্যা নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ের কাছে করা হয়েছে এবং লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে দেশের ১৮,০০০ কিলোমিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। এখনো বহু গণকবর অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। যে এক কোটির ও বেশী মানুষ দেশান্তরী হয়েছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারেই কেউ না কেউ কোন না কোন ভাবে মারা গেছেন। যার কোন হিসাব কোথাও নেই।  বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা , নজরুল ইসলাম খান বলেছেন তিনি শহীদের নাম জানেন, কিন্তু কোনদিন সেই তালিকার নাম নিলেন না।  এখন শহীদ জিয়াউর রহমান দিয়ে  শুরু করে কাদের মোল্লা, কামারুজ্জজামান, গোলাম আজম, আলী আহসান মুজাহিদ কিংবা  সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীদের দিয়ে সেই তালিকা প্রস্তুত করেন কিনা সেটা দেখার বিষয়।

বেগম খালেদা জিয়া, মেজর হাফিজ, রুহুল কবির রিজভী, গয়েশ্বর রায়, নজরুল ইসলাম খান কিংবা মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তব্য শুনে শুনে ছেলেবেলার একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ছেলেবেলায় রাত্রে ঘুমাতে গেলে প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত। হঠাৎ করে বাড়ির পোষা কুকুরটি কোন কারণে ডেকে  উঠলে একে একে গ্রামের সবগুলো কুকুর ডেকে উঠত। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতাম কবে শেষ কুকুরটি ডেকে উঠবে।

কখনো পাশের জঙ্গল বা ঝোপ থেকে কোন শেয়াল হুক্কাহুয়া বলে ডাকলেই আশেপাশের সব শেয়াল ডেকে উঠত। ছোটবেলা যাদের গ্রাম বা মফস্বলে কেটেছে তারা সবাই এই দুইটি ঘটনার সাথে পরিচিত আছেন।

লন্ডনে এক টিভি টকশোতে বিএনপির এক নেতা মুখ ফসকে সত্য টা বলে দিয়েছেন ‘’ট্রিট ফর থ্রেট’’ আসলেই তাই। দিশেহারা বিএনপি কি বলছে কি করছে তাঁরা জানে না। কার্যকারণ দেখে  মনে হচ্ছে, তাঁদের  শিকল বাঁধা আছে পাকিস্তানে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে, এখন দোষী সাব্যস্ত পাকিস্তানের ১৯৫ জন সেনা সদস্যদের বিচারের দাবী ও জোরালো হচ্ছে। শীঘ্রই নিষিদ্ধ হবে তাদের পিয়ারের জামায়াত ইসলাম। নতুন নাগরিকত্ব আইনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা কারীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিধান কিংবা পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার দাবী দিনদিন বেড়েই চলছে।

পাকিস্তান  একাত্তরের  তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তা সুদে আসলে বিফলে যেতে বসেছে। তাই পাকিস্তানের দায়িত্বটা এখন সরাসরি বিএনপিকেই নিতে হচ্ছে। এখন লেজে কুকুর নয়, কুকুরেই লেজ নাড়াচ্ছে।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ