আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আত্মহত্যা : অপরাধ, নাকি অজ্ঞানতা!

দেবজ্যোতি দেবু  

ভালোবাসাময় এক পরম আকুতির নাম জীবন। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তেও মানুষ চায় ‘আর কিছুদিন যদি বেঁচে থাকতে পারতাম’! কিন্তু শেষ অবধি তা আর হয়ে উঠে না। তাকে চলে যেতেই হয়। তাকে চলে যেতে হয় কারণ তার সময় শেষ। কোথায় যেন শুনেছিলাম, ‘জীবন মানে কিছু সময়ের সমষ্টিমাত্র’। আসলেই তাই। কিন্তু এরমাঝেও কিছু মানুষ আছে যারা সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃত্যুকে পছন্দ করে জীবনযাত্রার ইতি ঘটায়। কারো কাছে তারা কাপুরুষ, কারো কাছে পাগল, কারো কাছে নেশাখোর ভ্রান্ত পথের পথিক, আবার কারো কাছে ভৌতিক কিছুর শিকার। কারো কাছেই তার মৃত্যুটা সহজে গ্রহণযোগ্য কিছু না। মৃত্যুর পর তারা তিরস্কারের রশদ মাত্র।

আমার পরিচিত খুবই দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন দু’জন মানুষ যখন আত্মহত্যা করলো তখন বিষয়টা সহজে মেনে নিতে পারিনি। এখনো পারিনা। ব্যক্তিগত ভাবে তাদের চিনতাম বলেই তাদের এমন চলে যাওয়াটা আমার মনে বিরাট একটা ধাক্কা দেয়। তাই চলমান বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের বাইরে এসে আজ একটু ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘স্বেচ্ছামৃত্যুর’ দিকে ফিরে তাকাতে চাই। কেনই বা মানুষ অমূল্য জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দেয়ার পথে পা বাড়ায় তা একটু দেখে নিতে চাই।

মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু নির্দিষ্ট কারণের দিকে আলোকপাত করেছেন। সহজ ভাষায় তারা এটাকে একটা মানসিক রোগ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও যেসব কারণের কথা তারা বলে থাকেন সেগুলো হচ্ছে- বিষণ্ণতা, দ্বিমেরু ব্যাধি, সিজোফ্রেনিয়া (ভগ্ন মনস্কতা বা বিভক্ত ব্যক্তিতা), ব্যক্তিত্ব রোগ, মাদকাসক্তি, ওষুধের অপব্যবহার বা মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মানসিক অশান্তির কারণ তারা চিহ্নিত করেছেন যার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। সেগুলো হলো- অর্থনৈতিক সমস্যা, সম্পর্ক জনিত সমস্যা, কারো দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া কিংবা কারো দ্বারা ভয় প্রাপ্ত হয়ে জোরপূর্বক নিজেকে হত্যা করতে বাধ্য হওয়া।

উন্নত বিশ্বের কিছু দেশের মানুষের উপর গবেষণা করে অবাক করার মত আরেকটা কারণ অনুসন্ধান করেছেন কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সেটা হচ্ছে ‘সিজন্যাল এফেক্ট’ বা ‘মৌসুমি প্রভাব’।

ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্ট ফ্লোরিডার হেলথ এন্ড সাইন্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ‘এফ. স্টিফেন ব্রিজ’ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, শীতের সময়ে অল্প হলেও বসন্ত এবং গ্রীষ্ম ঋতুতে আত্মহত্যার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যায়। তার গবেষণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড’র অধিবাসীদের উপর চালানো একটি জরিপে এমন তথ্যই পেয়েছেন।

গ্রীক গবেষকরা বলছেন, ‘তাপমাত্রার তারতম্যের চেয়ে বরং মৌসুমি সূর্যের তারতম্যের প্রভাব আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়’। এমন তথ্য দেখে অনেকেই অবাক হলেও এর পিছনে রয়েছে অনেক যৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং প্রমাণ।

আপাতত আলোচনার মূল কেন্দ্রে রাখতে চাই আমাদের দেশ এবং এই দেশের মানুষদের কথা। আমাদের দেশে কেন আত্মহত্যার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে সেই দিকে একটু আলোকপাত করতে চাই। সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে আসলে এই রোগের মূল উৎসগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

১) বিষণ্ণতা : বিষণ্ণতা একটি মারাত্মক মানসিক রোগ। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার জন্য তীব্র বিষণ্ণতাকে অনেকাংশেই দায়ী করেছেন অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। একাকীত্ব, পারিবারিক কলহ, হতাশা, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকা, ঘনিষ্ঠজনদের তিরস্কার, কোন কাজে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে বিষণ্ণতার জন্ম হয়ে থাকে।

একটা সময় ছিল যখন আমাদের সমাজে একান্নবর্তী পরিবার প্রচুর ছিল। একই পরিবারের সবাই মিলে একসাথে আনন্দযজ্ঞে মেতে থাকতো। তখন এই বিষণ্ণতা জিনিসটা অনেকাংশেই কম ছিল। যত দিন যাচ্ছে আমাদের পরিবার ততোই ছোট হচ্ছে।

একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙ্গে আমরা একক পরিবারের দিকে ঝুঁকছি। বাবা মায়ের ব্যস্ততা ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে সন্তানদের। যার ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে নিজের তৈরি ভুবনে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে। আরো একটি বিষয় লক্ষ করলে দেখা যায়, বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের সাথে বাবা মায়ের দূরত্ব সন্তানকে বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিতে পারে। ঐ সময়টাতে ভাল মন্দ বিচার করার মত পর্যাপ্ত বোধ তাদের থাকে না বলে অনেক ভুল সিদ্ধান্তকেই তারা সঠিক বলে ধরে নিয়ে সেই পথে পা বাড়ায়। রঙ্গিন জগত থেকে হঠাৎ করে যখন সে বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তখনই সে হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আত্মহত্যার মত নিষ্ঠুর পথ বেছে নিতেও পিছপা হয় না।

২) দ্বিমেরু ব্যাধি: এই রোগের কারণ এখনো অনেকটাই অজানা রয়ে গেছে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে। ধারণা করা হয় এটা বংশগত কারণে হতে পারে। এটা সাধারণত কিশোর বয়সে কিংবা বয়সের সাথে সাথে মানসিক পরিপক্বতার অভাব থাকা মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। চরম রাগী মানসিকতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া সহ নানান কারণে এরা অন্যদের কাছে উপেক্ষিত হতে পারে। এইরকম উপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে তারা আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে।

৩) সিজোফ্রেনিয়া:  এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত প্রায়শই বিভ্রান্ত থাকে। বিভ্রান্তিকর শব্দ শোনে। বিশৃঙ্খল কথা বার্তা, চলাফেরা করে। দ্বৈতসত্ত্বা অনুভবের কারণে এদের চিন্তার জগত হয় বিক্ষিপ্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, জেনেটিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সাধারণত এই রোগের জন্ম হয়ে থাকে। একই শহরে বেড়ে ওঠা, গাঁজার ব্যবহার, কোন নির্দিষ্ট রোগের সংক্রমণ, গর্ভাবস্থায় অপুষ্টিজনিত সমস্যা ইত্যাদি কারণে এই রোগ হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং আশ্রয়হীনতার মতো সামাজিক সমস্যাও এই রোগের কারণ হতে পারে।

উপরে উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আরো অনেক কারণে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কেউ কেউ বিভিন্ন সময় নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় এবং জ্ঞানী ভাবতে শুরু করে। কেউ আবার মনে করে তার কোন যোগ্যতা নাই। কেউ তাকে ভালোবাসে না, মূল্যায়ন করে না। কেউ তাকে পছন্দ করছে না। দীর্ঘদিন এমন সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষ একসময় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে একসময় নিজেকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। পরিণাম আত্মহত্যা।

এছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত মাদক সেবন এবং ভুল ওষুধ সেবন করাও মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাদক এবং ভুল ওষুধের বিষক্রিয়া মানুষের চিন্তা শক্তিকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। যার ফলে আত্মহত্যা জনিত সমস্যার লক্ষণগুলো তার মাঝে ব্যাপক আকারে দেখা যায়।

সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক কীটনাশক ও সার জমিতে খুব বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে  এবং সেই সবজি অনেক দিন ধরে খেতে থাকলে মানসিক সমস্যা দেখা দেয় বলে দাবি করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তার থেকেই জন্ম নেয় হতাশা। চীনে কিছুদিন আগে একটি গ্রামে পরপর বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছিল। সেখানকার বাসিন্দাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাওয়া যায়, জমিতে দেয়া কীটনাশকের কারণে এবং সেই জমির ফসল গ্রহণের কারণে মানুষের মাঝে হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকেছে।   

এখন আসি সম্পর্ক জনিত সমস্যায়। কেউ যদি অন্য কোন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে কিংবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অতি মাত্রায় দুর্বল হয়ে পরে তাহলে সে ঐ নির্ভরযোগ্য মানুষটির বা ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয়ের মাঝে বাঁচতে শুরু করে। তখন তার মনের মাঝে নানান ধরনের খারাপ চিন্তা, ভ্রান্ত কাহিনী, অবিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে হারানোর ভয়ে মানসিক ভাবে দুর্বল হতে থাকে। দেখা দেয় বিষণ্ণতা। একসময় ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিতেও সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে না। পরিণাম হয় ভয়াবহ। আবার কেউ কেউ সেই ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ভাবতে শুরু করে তার জীবনের শেষ অবলম্বনটুকুও সে হারিয়ে ফেলেছে। অতিরিক্ত বিষণ্ণতায় ডুবে থাকতে থাকতে একসময় তার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও মরে যায়। পরিণামে ঘটিয়ে ফেলে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা।

আরেকটি কারণ আছে যার খবর আমরা তেমন একটা রাখি না। আত্মহত্যার নাম শুনেই আমরা বিভিন্ন কল্পকাহিনী বানিয়ে মূল কারণটাকে অদেখা করে চলে যাই। কারণটা হচ্ছে, কারো দ্বারা ভয় প্রাপ্ত হয়ে কিংবা প্রণোদিত হয়ে আত্মহত্যা করা। এখানে আত্মহত্যাকারী নিজেকে এতোটাই অসহায় ভাবতে শুরু করে যে দ্বিতীয় আর কোন উপায় তার মাথায় আসে না। সে সেটাই করে যা তাকে করতে প্ররোচিত করা হয়।

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডন জ্যাকসন আত্মহত্যার কারণ গুলোকে তিনটি শ্রেণীতে  ভাগ করেছেন:  
১) মানুষ স্বনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসী প্রেষণা নিবৃত্তির জন্য আত্মহননের পথ বেছে  নেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তি হিসেবে ফ্রয়েড’র ‘মৃত্যু প্রবণতা’ ধারণাকে  গ্রহণ করেছেন। ফ্রয়েডের তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, ‘মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা ও  মৃত্যুবরণ করা এই দুই ধরণের বিপরীত মুখী প্রবণতা রয়েছে। আত্মহত্যার ঘটনা  মৃত্যু প্রবণতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ঘটনা।’

২) পুনর্জন্মের প্রত্যাশা: অনেক মানুষ বিশ্বাস করে তাদের বর্তমান জীবনের দু:খ-কষ্ট সহ নানান সমস্যাগুলো এ জন্মে সংশোধনযোগ্য নয়। তাই পরবর্তী জন্মে ভাল হয়ে জন্মানোর মানসে তারা আত্মহত্যাকেই বেছে নেয়।

৩) মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক কারণ: মানুষ যখন নানাবিধ কারণে প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখিন হয়, তখন তার আত্ম ধারণা বিনষ্ট হয়ে যায়। সে নিজেকে সমাজে, পরিবারে অবাঞ্ছিত, ভালবাসা ও সহানুভূতি বঞ্চিত একজন হিসেবে অনুভব করে। অথবা যখন নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখিন হয়, তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

এবার আসি মূল কথায়। আশা করি উপরোক্ত কারণগুলো থেকে কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়েছে যে আত্মহত্যা করা বা করতে চাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি মানসিক সমস্যার ফসল। মনোবিজ্ঞানীরা বেশ জোর দিয়েই দাবি করেছেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা একটা মানসিক সমস্যা ছাড়া আর কিছুই না। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যা কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপ্ন মেয়াদী মানসিক সমস্যার কারণেও যে কেউ আত্মহত্যার মত ভুল একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু আমরা কি আদৌ এই বিশেষজ্ঞ মতামতগুলো গ্রহণ করি? কিংবা বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মধ্যে কতজন আছেন যারা আত্মহত্যার এই কারণগুলো সম্পর্কে জানেন?

কেউ আত্মহত্যা করলে আমরা শুরুতেই তাকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা শুরু করে দেই। সবার আগেই প্রশ্ন করি তার প্রেম ঘটিত কোন সমস্যা আছে কি না। তার চরিত্র কেমন ছিল। সে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে কি না। কিন্তু কেউ একবারের জন্যও ভাবি না একজন মানুষের আত্মহত্যার জন্য তার মানসিক সমস্যা দায়ী নয় তো? আমরা বরং আত্মহত্যার পরে সেই মানুষটার লাশ দেখতেও ঘৃণা বোধ করি। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা এই ঘৃণাকে জায়েজ করে নেন আত্মহত্যাকারীকে ‘কাপুরুষ’ আখ্যা দিয়ে। এখনো গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায় দেখা যায় কেউ আত্মহত্যা করলে বলা হয় তার উপর ‘জিনের আছর’ লেগেছে। মানসিক সমস্যা দেখা দিলে বলা হয় জিনে ধরেছে। যা সম্পূর্ণই ভ্রান্ত এবং অবাস্তব ধারণা মাত্র।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সহকারী রেজিস্টার মোঃ রাশিদুল হক রানা’র মতে, আচরণগত অসুবিধা, ব্যক্তিগত সমস্যা, মানসিক বিপর্যয়, অবসাদগ্রস্ততা ও মাদকাসক্তি মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়। আত্মহত্যা  মানে ‘সেলফ মার্ডার’। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে পুরুষদের মধ্যে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মহিলাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। শিক্ষা ও মোটিভেশন  কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।            

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলেছেন, এই সব আত্মহত্যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য দরকার সচেতনতা, কুসংস্কারকে কাটিয়ে ওঠা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দীর্ঘমেয়াদে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে কোন না কোন ভাবে তার অন্তর্গত ইচ্ছার কথা কারো না কারো কাছে ব্যক্ত করে। কেউ যদি  আত্মহত্যার কথা বলে তবে তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। তার সমস্যাটা চিহ্নিত করে তাকে সেভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতে হবে। যারা আত্মহত্যা করে তারা  যেসব চিঠি বা চিরকুট লিখে যায়, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা  মৃত্যুর আগে কিছু নির্দেশ দেয় এবং চিঠিতে তাদের তীব্র মনঃকষ্ট এবং ক্রোধ প্রকাশ পায়। তাই তাদের এ অনুভূতিগুলোকে গুরুত্বের সাথে সমাধানের চেষ্টা  চালাতে হবে। তাহলেও অনেক আত্মহত্যার ঘটনাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

আমি মনে করি একজন মানুষের আত্মহত্যার পিছনে তার নিজের যতোটুকু দায় আছে তার পাশাপাশি এই দায় তার পরিবারের, সমাজেরও আছে। কারণ, আমরা যখন বাধ্য করি একজন কিশোর বা কিশোরীকে একা একা বেড়ে উঠতে, তখন তার ভিতরে জন্মানো বিষণ্ণতার দায় মূলত কার? আমরা যখন দেখি পরিবারের বা সমাজের একজন সদস্য অস্বাভাবিক কোন আচরণ করছে তখন তাকে সামলে না নিয়ে, কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা না করে, উলটো দূরে ঠেলে দিয়ে আরো অন্ধকারের দিকে যেতে বাধ্য করার দায়টা কার?

একটি মেয়ে যখন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় তখন তাকে মানসিক ভাবে সমর্থন না দিয়ে উলটো আমরা যখন তাকে নিয়ে তিরস্কার করি, তার জীবনকে নরক বানিয়ে দেই, তখন তার সামনে বেঁচে থাকার কি আর কোন রাস্তা খোলা থাকে? যেখানে পরিবারের কাছ থেকে ধিক্কার, সমাজের কাছ থেকে তিরস্কার, রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ প্রতিনিয়ত মানসিক ভাবে ধ্বংস করে দেয় কাউকে, সেখানে সে কিভাবে মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে?

সম্প্রতি ঢাকায় আত্মহত্যা করা সাবিরা’র মৃত্যুর জন্য কি আমরা দায় এড়িয়ে যেতে পারবো? সাবিরা মৃত্যুর আগে আত্মহত্যার চেষ্টা ভিডিও করে যেভাবে অনলাইনে প্রচার করেছিল সেটা যারা দেখেছেন তারা কি কেউ সাবিরাকে বাঁচানোর জন্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? যদি কেউ না কেউ তখন এগিয়ে আসতাম তাহলে কি সাবিরাকে আত্মহত্যা করতে হতো?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করার লক্ষণগুলো আগে থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। যেমন- অযথাই ঝগড়া করা, রাগ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়া, অহেতুক সবকিছুতে বিতৃষ্ণা জাগা, কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়া, সব সময় বিষণ্ণ থাকা ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলো কিন্তু আমরা প্রায়ই আমাদের বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের মাঝে দেখি। কিন্তু আমরা এর প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা করি না। করি না বললে ভুল হবে, আমরা ওগুলোকে পাত্তাই দেই না। কিন্তু আমাদের উচিৎ ছিল এই লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং তাকে বা তাদেরকে কাছে টেনে নিয়ে যতোটুকু সম্ভব যত্নসহকারে বুঝানো, প্রয়োজনে মানসিক ডাক্তারের কাছে কাউন্সিলিং এর জন্য নিয়ে যাওয়া বা যাওয়ার পরামর্শ দেয়া। সেসব না করে আমরাই বরং একটি সম্ভাবনাময় প্রাণকে অকালে ঝরে যাওয়ার জন্য তৈরি করতে থাকি।

আমরা মানসিক ডাক্তার বলতেই মনে করি ‘পাগলের ডাক্তার’। সাইক্রিয়েটিস্ট দেখানোর কথা বললেই অনেক শিক্ষিত লোকও মনে করে তাকে পাগল বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক না। মানসিক সমস্যা কম বেশি প্রায় সবারই আছে। কারো সেটা প্রকাশ পায়, কারো পায় না। নিয়মিত কাউন্সিলিং করলে সেটা দূর করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত কাউন্সিলিং এবং ওষুধ সেবনের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। কিছুটা সুস্থ অনুভব করেই চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে এই সমস্যা আবারও ফিরে আসতে পারে এবং পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

পরিশেষে বলতে চাই, যারা আত্মহত্যা করে তারা সর্বক্ষেত্রে কাপুরুষ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মানসিক অসুস্থতার শিকার। তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন। প্রয়োজন একটু বেশি আদর, স্নেহ, ভালোবাসার। আমাদের পরিবারের সদস্যদের, আত্মীয়-স্বজনদের, বন্ধুদের মাঝে যে কেউ শিকার হতে পারে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। সেজন্য প্রয়োজন একটু সচেতনতা, একটু আপন ভাবাপন্ন মানসিকতা। প্রয়োজন কুসংস্কার ত্যাগ করে দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন করা। মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, বরং আপন করে নিয়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়া উচিৎ। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সত্যিই যদি এমনটা করতে পারি তাহলে আত্মহত্যা নামক অযাচিত ঘটনাকে প্রতিহত করা অনেকাংশেই সম্ভব।

জয় হোক মানবতার, জাগ্রত হোক সামাজিক সচেতনতা।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ