আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ম্যাশ, আমাদের সময়ের ‘আনসাং হিরো’

কাজল দাস  

মাশরাফি রিয়েলি একটা ক্যারাক্টার হয়ে উঠেছেন আমাদের জাতীয় জীবনে।  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত মাশরাফির সাক্ষাতকারটা পড়ে এই ভাবনাটাই আমার মাথায় এলো । তবে প্রথমেই অসম্ভব ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সেই সাংবাদিককে, যিনি এই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছেন। একটা সাক্ষাতকারে বক্তা কি বলবেন এটা বের করে আনার দায়িত্ব সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর। এই সাংবাদিক এটি শতভাগ পেরেছেন। মাশরাফির অনেক কিছুই বের করে এনেছেন তিনি। হি হ্যাজ বীন ক্রেডিটেড ফ্রম মি।


সাক্ষাৎকার পড়ে মাশরাফির  লাইফ নিয়ে খুব কম্প্রিহেনসিভ ও বিচিত্র ধারণা পেলাম। মাশরাফি তাঁর মধ্যে নেতা আছে, পিতা আছে, প্রেমিক আছে আবার স্বামী ও আছে, পারিবারিক ভাবে বাবা-মায়ের কাছে লয়াল থাকা এই ব্যাপারটাও আছে। বন্ধুদের কাছে সে একটা দারুণ বন্ধুবৎসল মানুষ।আবার এই সমাজের পরিবর্তন নিয়ে তাঁর মধ্যে চিন্তা আছে। যেমন আজকের সাক্ষাতে মাশরাফি বলছেন- আগে দেখা হলে ৫/১০ মিনিট আড্ডা দিতো, এখন সবাই সেলফি তুলে চলে যায়। এটা কৃত্রিম এবং মেকি, কি অসাধারণ ধরেছেন তিনি আমাদের এই সোশাল সিকিনেসটা। এই দেশের কোন খেলোয়াড় এইভাবে সমাজ নিয়ে ভেবেছে বলে মনে হয় না। পারিপার্শ্বিক মানুষের সাথে খুব ভ্যালু এ্যাডেড হয়ে মিশে থাকলে কেউ এইভাবে বলতে পারে, ভাবতে পারে, ইমাজিন করতে পারে। মাশরাফি এটা পেরেছেন-কারণ সেলিব্রেটিজমের চাকচিক্যময়তা তাঁকে গিলতে পারেনি। তাঁর বুকে এখনো কাঁদা মাখা একটি সবুজ বাংলাদেশ খোদাই করা আছে।

মাশরাফির বলছেন-‘তামিম, মুশফিক, রিয়াদের উচ্চতা বেশি। এমন নয় যে বলার জন্য বলছি, সত্যিই অনুভব করি। ওদেরকে সব সময় আমি অন্য জায়গায় রাখি। দেখেন’।  নিজের টিমমেটকে তাঁর কোয়ালিটির মূল্যায়ন কিভাবে তিনি শতভাগ দিচ্ছে দেখেন। সবার মধ্যে দারুণ হারমোনি রাখার জন্য তিনি একজন দারুণ ম্যানেজার। আপনি পিএইচডি পাশ করা কোন এইচ আর ম্যানেজারকে দিয়ে যে মোটিভেশনাল কাজটি করাতে পারবেন না, সেটি মাশরাফির কাছ থেকে পাবেন । ডজন খানেক বার তিনি সার্জনের ছুরির নিচে গিয়ে ও অসাধারণ ভাবে ফিরে আসেন। এটা রিয়েল স্পিরিট অফ এ্যা ম্যান। আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যে বলেছিলেন- ‘ম্যান ক্যান বি ড্রেস্ট্রয়েড বাট নেভার ডিফিটেড।‘ এটা আসলেই মাশরাফিই। ভাঙ্গবে কিন্তু পরাজিত হবে না।


মাশরাফি খুব সস্তা জনপ্রিয়তাকে ইগনোর করতে পারেন। ফেইম সিকার না। একদম খেটে খাওয়া মানুষের মত বলেন-আমার কাজ আমি করতে চাই, এটাই ভাল লাগে, আমি অন্যের জন্য হেল্প করতে চাই সবটুকে দিয়ে। সে আসলেই তাই। বার বার তাঁকে হিরো বলে পত্রিকাগুলো বাড়াবাড়ি করে-অথচ তিনি বলেন , আমি না আমাদের আসল হিরো হল মুক্তিযোদ্ধারা। আপনি এই সময়ে হরেদরে মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করে খাওয়ার যুগে এইরকম দেশ প্রেমিক পেয়েছেন, এটা ভাগ্য আপনার।

নিজের খেলাকে মাশরাফি জাস্ট একটি কাজ মনে করেন। কি অসাধারণ প্রফেশনালিজম দেখেন। যেখানে গোটা সমাজ এখন কিছু করে হিরোইজম চর্চায় মানসিকভাবে ভুগছে সেখানে তিনি বলছেন-'ক্রিকেট ইজ জাস্ট আ গেম'। আবার কাজ এবং পরিবারকে নিয়ে বলছেন-পরিবার, খেলার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, তাঁর ভাষায় -'সবই পরিবার। এটি সীমানাহীন, অর্থ বের করা যাবে না'। আমরা যারা কাজ আর পরিবার নিয়ে নানান দ্বন্দ্বে পড়ে যাই, চেয়ে দেখেন -মাশরাফি সেখানে সুন্দর করে আমাদের ভাবাচ্ছেন-পরিবারের জন্যই কাজ করতে হয় সো ফ্যামিলিই প্রায়র। এটা একটি এপিক কম্বিনেশন।

খুব সন্তান বৎসল মাশরাফি একজন জেন্টল ফাদার। খুব নির্ভরতা হয়ে উঠতে পারেন তিনি কাছের মানুষের কাছে। এটা সিম্পলি অসাধারণ। আবার তাঁর নিজের ও কিছু নিজস্ব নির্ভরহীনতা আছে। এটা থাকে প্রতিটি মানুষের জীবনে। মাশরাফি বলছেন -'' কিন্তু কেবল দু্ই জায়গায় আমি একটু ভিন্ন। আমার মা ও আমার বউ। ওদের সঙ্গে আমি যা কিছু করতে পারি। হয়ত অন্য রাগ ওদের ওপর দিয়ে প্রকাশ করে ফেলি অনেক সময়। ওরা আমার জন্য সেই নির্ভরতার জায়গা।'' এই যে নির্ভরতা বা একান্ত আশ্রয়, এটি প্রতিটা ব্যক্তির থাকতে হয়। জীবনানন্দ এটিকেই বলেছেন-‘ থাকে শুধু অন্ধকার/মুখোমুখি বসিবার নাটোরের বনলতা সেন'। সেটা মার কাছে হবে, বন্ধুর কাছে হবে, অথবা মায়ের মত বিশ্বস্ত প্রেমিকার কাছে হবে। এটা লাগবে কারণ-এটি এটা মানবমনের অভয়ারণ্য।


মাশরাফি এই ক্যারেক্টারের মধ্যে আবার আপনি খুব সহজাত দুর্বলতা ও পাবেন। কুসংস্কার পাবেন। যেমন তিনি বলছে- '' আফগানিস্তান সিরিজের শেষ ম্যাচের পর বললেন, ম্যাচের আগে থেকেই মনে হচ্ছিলো ইনজুরিতে পড়বেন। মুমিনুলকে আপনি বলেন দলের লক্ষ্মী, ও স্কোয়াডে থাকলেই নাকি দল জেতে। কোন হোটেল দলের জন্য বেশি পয়া'' । আবার তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড হোম সিকনেস আছে। এই যে ধারণা এগুলো আসলে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের গড়নের সরলতা। এটি মানুষের মধ্যে থাকতেই পারে। এটা সহজাত অনেকটা। কাউকে ক্ষতি না করলে ,কারো জন্য আপদ না হলে একজন গ্রেট পার্সনের এইগুলো থাকলে বিশেষ কোন ক্ষতি নেই।

আবার এই কন্ট্রাডিকশনের বিপরীতে দেখেন-তিনি অসাধারণ একজন নেতা। নেতৃত্বের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে –অন্যতম একটি ব্যাপার হল- রিসোর্স মোবিলাইজ ও তাঁর ইউটিলাইজ করা, মাশরাফি সেটা পারেন- তাঁর হাতে যে রিসোর্স আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল নেয়ার কাজে বরাবরের মতই দক্ষ। আমাদের ক্রিকেট খেলায় বহুবার তিনি সেটা দেখিয়েছেন। সবাইকে নিজের পুরোটা সামর্থ্য দিয়ে রেজাল্ট বের করে আনতে তিনি খুব গাইড করতে পারেন। আবার দেখেন-সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেন না। একটি বড় ফলাফল লাভের আশায় সিদ্ধান্তহীণ না থেকে ছোট সিদ্ধান্ত  নিয়ে ছোট ফলাফল বের করার জন্য দারুণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আসল কথা তোমাকে জিততে হবে, ছোট থেকে বড় এভাবেই আগাতে হবে। মাশরাফি এটি পারেন। এটি  একজন লিডারের ইউনিক এ্যাটিচুড।

খুব বাস্তববাদী একজন মানুষ মাশরাফি।  খুব টিউনড। স্বপ্নকে বাস্তবের সীমানায় খুব বেশি রাখতে পছন্দ করেন। যেমন তিনি অবসর নিয়ে বলছেন- ‘আমার অবসরটাও হবে হুট করে। একদিন ইচ্ছে হবে, ছেড়ে দেব। বলে কয়ে কিছু হবে না, নিশ্চিত থাকতে পারেন।’ নিজের এতো বর্ণাঢ্য বিদায়কে কি দারুণ মহাকাব্যিক করেছেন তিনি। ইটস রিয়েলি মেসমেরাইজিং এ্যাটিচুড অফ এ্যা হিরো।

মাশরাফি আমরা বেঁচে আছি তোমার সময়ে, অনেক সৌভাগ্যবান যে , আমরা আমাদের সময়ে মাশরাফিকে খেলতে দেখেছি। একটি সচল জীবন প্রেমিক, প্রচণ্ড আমুদে, বন্ধুবৎসল, ক্ষিপ্র এটিচুডের এ্যাথলেট, এ্যা জেন্টল ফাদার, লাভলি বেটার হাফ, লয়াল চাইল্ড, এ্যা গুড লিডার, এ্যা রিয়েল প্যাট্রিওট, এই রকম একজন সেলুলয়েডের ফিতার মত সচল মাশরাফি আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস হচ্ছেন। লাভ ইউ ম্যান। লাভ ইউ।

শুভ জন্মদিন, ম্যাশ!

কাজল দাস, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ