প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ০৪ জানুয়ারী, ২০১৭
দেশ কার?
দেশ কি হিন্দুর? খৃস্টানের? মুসলমান বা ইহুদীর? না, দেশ তো মানুষের।
মানুষের ধর্ম পরিচয় থাকে। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম পরিচয় থাকে না। রাষ্ট্র সবার। মানুষ বাস করে তাঁর হাজার বছরের চেনা ভূগোল, সমাজ ও সংস্কৃতিতে। প্রজন্ম পরম্পরায়। সেখানে মানুষ ধর্মের বাইরেও নানা পরিচয়ে বাঁচে। সেখানে তার চেনা ভূগোলের নাম একসময় হয়ে উঠে দেশ, রাষ্ট্র। দেশ ও রাষ্ট্র থেকে কিছু মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকেই দেশান্তরী হয়। হয়, জীবন ও জীবিকার অন্বেষণ ও প্রয়োজনে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অজানারে জানা, কৌতূহলী মনের জিজ্ঞাসা ও পিপাসা পূরণে। কেউ ফিরে আসে, কেউ আসি আসি করে কোনদিন আর ফিরে আসে না। ডায়াস্পোরা পরিচয়ে তারা পোড়ে। তবু পোড়া হৃদয়ে তাদের সতত জাগ্রত থাকে গভীর দেশানুভূতি, মা, মাতৃভূমি। কিন্তু কিছু মানুষ দেশান্তরী হয় নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে। যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেনের মানুষ ঘরহারা হচ্ছে। কেউ পার্শ্ববর্তী দেশে, কেউ বা দরিয়ায় জীবন বাজি রেখে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করছে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
ফিলিস্তিন, কাশ্মীরের মানুষ দশকের পর দশক দশক মরছে তাদের স্বীকৃতি ও আত্মপরিচয়ের জন্য। আরাকানের মানুষ বঙ্গোপসাগর, নাফ নদী পাড়ি দিয়ে অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়ায় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে। এসব দুর্যোগ দৃশ্যমান। মানুষ দেখে। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা দৃশ্যমান কিছু করতে না পারলেও এক বেলা হাহাকার করে। কিন্তু কিছু নীরব দুর্যোগ আছে। সহসা কেউ দেখে না। নীরবে ঘটতে থাকে। এর অভিঘাতও সহসা দৃশ্যমান নয়। এমন দুর্যোগেও মানুষ অনেক কিছু হারায়। বাস্তুচ্যুত হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ তার কোন খবর রাখে না। আশাশুনির নিরঞ্জন এভাবেই একদিন নাই হয়ে যায়। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে ফিরে কাঁদেন নচিকেতা।
একটা সমাজের সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যে। আমাদের এখানে বৈচিত্র্য অভিনন্দিত নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বাইরে অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিসত্তার মানুষেরা নিরাপদ বোধ করেন না। তারা সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়েন। আমি এরকম চেনা মানুষজনকে দেখে আঁতকে উঠি। তাদের মনোজগতের দুঃখ, বেদনা, অন্তর্গত হাহাকার আমরা শুনতে পাই না, বা চাই না। চেনাজানা কিছু মানুষের কথা বলা যেতে পারে ছদ্মনামে। ধরা যাক তিনি অমলেন্দু সেন। বাংলাদেশের এক নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন আদর্শ স্কুল শিক্ষক। চিন্তা ভাবনায় প্রগতিশীল এ মেধাবী তরুণ পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। ছিলেন ভীষণ সাহিত্যানুরাগী। কবিতা লিখতেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর খুব প্রিয় কবি। একুশে গ্রন্থমেলায় বছর চারেক আগে বেরিয়েছে তাঁর নিজের একটি কাব্যগ্রন্থ। অমলেন্দু শিক্ষাছুটি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন আমেরিকায়। শিক্ষাছুটির মেয়াদ ও পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেও তিনি আর দেশে ফেরেন নি। অথচ কোনদিন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে তিনিও আরো আটদশ জনের মতো থেকে যাবেন। ফিরবেন না। আসলে ফিরছেন না দেশে তিনি আর নিরাপদ বোধ করছেন না। পরিবারের অন্যরাও দেশত্যাগ করছেন। দেখা গেছে, এদেশে যারা গরীব হিন্দু তারা ভারতে হিজরত করেন, আর কিছুটা অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুরা পাড়ি জমান ইউরোপ আমেরিকা।
রতন পাল। একজন প্রথম শ্রেণির সরকারী কর্মকর্তা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কর্মকর্তার সামাজিক অবস্থান সুসংহত। তাঁর নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। তবু তিনি অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় স্থায়ী হতে চান। কারণ দেশে সংখ্যালঘু পরিচয়, বৈষম্য ও নির্যাতন তাকে পীড়া দেয়। এ পীড়ন মনোজগতের। বোধের একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে অনেক বেশি সমষ্টিগত।
সুষমা দাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এর বাইরে জেন্ডার, নারী অধিকার ও উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ব্লগার হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন দূতাবাসে ঘুরছেন বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে। তাঁর লেখালেখির জন্য তিনি উগ্র মৌলবাদীদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। সরকার ও প্রশাসন তাঁর নিরাপত্তায় আন্তরিক নয়। উলটো রাখঢাকহীন সাহসী লেখালেখির জন্য তিরস্কৃত। জীবন নিয়ে শঙ্কিত তিনিও এখন দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় রাতের আঁধারে ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষের মতো না হলেও এভাবে চুপিসারে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এদেশে এখন নেহায়েত কম নয়।
দৈনিক প্রথম আলো তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনায় করে দেখিয়েছে, ১৯০১ সালে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৩৩ শতাংশ। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আদমশুমারিতে এই হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫ এবং ২০০১ সালের শুমারিতে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। পরবর্তীতে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ৯ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫ ভাগে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, গত ১০ বছরে দেশে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে। আমরা দিনে দিনে এভাবে একটি এবস্যুলেট ধর্ম পরিচয়ধারী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছি। অথচ ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চল ছিল পরমত ও ধর্মসহিষ্ণু। ভিন্ন মত, পথ ও বিশ্বাসীদের আবাসস্থল। বৌদ্ধরা তাদের অহিংস ধর্ম প্রচার করেছেন, সুদূর আরব, ইরান-তুরান থেকে পীর পয়গম্বররা ইসলামের সাম্য ও শান্তির সুমহান বাণী নিয়ে এসেছেন। যখন ইউরোপে ধর্মীয় উগ্রবাদ ভয়াবহ এই ভারতবর্ষের মানুষ সবাইকে সাদরে গ্রহণ করেছে। শত সহস্র বছরের ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য রয়েছে। তাহলে এই দেশ কবে থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসবাসের জন্য এতোটা অনুপযোগী হয়ে উঠল? এ প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকে খুঁজতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দুজোট সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৯৮ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ১০০৯ জনকে। বিভিন্ন সময় প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে ২০৯ টি। এছাড়াও ধর্ষণ, অপহরণ, সম্পত্তি দখল, উচ্ছেদের ঘটনা, দেশত্যাগের হুমকিসহ গেল বছর জোটের দাবি মতে ১৫ হাজার ৫৪টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের এ দাবি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটা খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। কথা হলো এসব ঘটনার নেপথ্যে কারা আছেন? ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের তৈরি আতঙ্কের পাশাপাশি এসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখতে পাওয়া যায় স্থানীয় সরকার দলীয় ক্ষমতাসীনদেরও। এরা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চেয়েও এককাঠি সরেস। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সংখ্যালঘুদের উপর সংগঠিত ধর্মান্ধ হামলায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত সবাই একাট্টা। দিবালোকে যারা “জয় বাংলা” স্লোগান দেন রাতের আঁধারে তারাই এর মর্মচেতনার হত্যার আয়োজন করেন। তাই ‘জয় বাংলা’ আর বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিয়ে রাজনীতি করলেই কেউ মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশে আস্থাশীল এমন ভাববার কোন কারণ নেই।
রামু থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং সর্বশেষ গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লীতে সাঁওতালদের উচ্ছেদে খোদ প্রশাসনের উপর অভিযোগ আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ে বৈ কমে না। এসব ঘটনা সংখ্যালঘুদের শঙ্কিত করে, সন্ত্রস্ত করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বছর শেষে মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে ২০১৬ সালকে উদ্বেগজনক বছর বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ আমাদের সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম অঙ্গীকার অনুযায়ী রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করার কথা বলেছে। পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করে অনুচ্ছেদ ৪১ বলছে, প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম অবলম্বন, পালন প্রচারের অধিকার ছাড়াও প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার আছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল যাদের নেতৃত্বে আমাদের সংবিধানও রচিত হয়েছে তাদের শাসনামলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের এ চিত্র আমাদের উদ্বিগ্ন করে। যুগপৎ বিক্ষুব্ধ ও হতাশ করে।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধ করেছিলেন ধর্ম বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পন্ন একটি রাষ্ট্রের জন্য। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা একটি উন্নত দেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে এগোচ্ছি। সে স্বপ্ন আর সুদূর নয়। সব ধর্ম, মত-পথ ও বিশ্বাসীদের জন্য নিরাপদ ও সমঅধিকারের একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্নও যেন অধরা না থাকে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য