বিশেষ প্রতিনিধি (লন্ডন)

২৪ এপ্রিল, ২০১৫ ২৩:০০

টাওয়ার হ্যামলেটসের পদচ্যুত মেয়র লুৎফুরের অপরাধনামা!

লন্ডনের দ্যা ডেইলি এন্ড সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার এন্ড্রু গিলিগ্যান টাওয়ার হ্যামলেটসের পদচ্যুত মেয়র লুৎফুর রহমান সম্পর্কে Lutfur Rahman: all his controversies in one place শিরোনামে এক কলাম লিখেছেন। এ কলামের মাধ্যমে ওঠে এসেছে বিতর্কিত ও পদচ্যুত এ মেয়রের কীর্তিকলাপের কিছু চিত্র। এ নিয়ে লন্ডনের বাংলা কম্যুনিটিতে চলছে ব্যাপক তোলপাড়।

আজ থেকে প্রায় একবছর আগে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় নির্বাচিত হয়েছিলেন মেয়র লুত্ফুর রহমান। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস নিজের কৃত দুর্নীতি কর্মের ফলেই ব্রিটিশ ইলেকশন কোর্টের এক যুগান্তকারী রায়েই বাতিল হয়ে যায় তার মেয়র পদবি, নিষিদ্ধ ঘোষণা করাহয় তাকে এবং জরিমানা করা হয় দুশ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড।

ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত দুর্নীতি, জালিয়াতি, ধর্মীয় বিদ্বেষ, স্বজন প্রীতি ইত্যাদি কারণে ফৌজদারি অপরাধের তদন্তে নামার কথা ভাবছে ব্রিটিশ পুলিশ। জজ রিচার্ড মাউরেই এর প্রায় দুশ পাতার রায়ে প্রমাণিত হয়েছে লুৎফুরের ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ।

পূর্ব লন্ডনের স্থানীয় ওই কাউন্সিলে নতুন করে ভোটগ্রহণের আদেশ দিয়ে তাতে লুৎফুরের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে তাকে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

আসুন এবার দেখে নেই বিখ্যাত সাংবাদিক এন্ড্রু গিলিগ্যানের লেখায় লুত্ফুর রহমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :
মার্চ ২০১০ : বৃটেনের অন্যতম দৈনিক দ্যা টেলিগ্রাফ এবং চ্যানেলফোর প্রকাশিত সংবাদে তত্কালীন টাওয়ার হ্যামলেট লেবার দলীয় নেতা লুত্ফুর রহমানের সাথে জঙ্গি সংগঠন আইএফই’র যোগাযোগ এবং আর্থিক সাহায্য দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

আইএফই কাজ করে ব্রিটেনে ইসলামিক সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি কায়েমের লক্ষে। রিপোর্টে কোনো ধরনের যোগ্যতা না থাকা সত্বেও শুধুমাত্র জঙ্গি সংগঠন আইএফই’র সাথে খুবই ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করা এক ব্যাক্তিকে কাউন্সিলের লেবার দলীয় এসিস্টেন্ট চিফ একজিকিউটিভ নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ প্রকাশিত হয়। যদিও তখন লুত্ফুর রহমান তা অস্বীকার করেন।

মে ২০১০ : লুত্ফুর রহমান লেবার দলীয় কাউন্সিল নেতার পদ হারান এবং সেই সাথে আইএফই’র মদদপুষ্ট এসিস্টেন্ট চিফ একজিকিউটিভকে পদত্যাগে বাধ্য করে লেবার পার্টির হাই কমান্ড। তখনই আইএফই সিদ্ধান্ত নেয় নিজেদের একজন কে নির্বাচিত করে পূর্ব লন্ডন এলাকার মসনদে আসীন হবে একই বছর অক্টোবর ২০১০তে অনুষ্টিত নির্বাচনে এবং বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে লুত্ফুর রহমানের জয় লাভের মধ্য দিয়ে তারা সফলও হয়।

জুলাই/অগাস্ট ২০১০ : সদ্য দলীয় পদ হারানো লুত্ফুর রহমানকে মেয়র নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেবেনা বলে ঘোষণা করে লেবার পার্টি। কারণ হিসাবে দেখানো হয় আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন আল-মুহাজিরুন ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের সাথে লুত্ফুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা। যারা ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জিহাদের ঘোষণা দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়র লুত্ফুর রহমান তার দলীয় প্রার্থিতা বহাল রাখার জন্য কোর্টে রিট করেন এবং জয়লাভ করেন।

সেপ্টেম্বর ২০১০ : একটি টেলিভিশন ইন্টারভিউতে উঠে আসে লুত্ফুর রহমান এবং বৃটেনের ইসলামিক নেতারা কিভাবে বাংলাদেশী এবং সোমালিয়ান মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডন এলাকায় ধর্মীয় প্রভাবের মাধ্যমে এবং ধর্মীয় বিদ্বেষের মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করছেন। এই সব ঘটনা প্রকাশিত হওয়া সত্বেও কেবল মাত্র কোর্টের আদেশে অবশেষে ৪ঠা সেপ্টেম্বর লুত্ফুর রহমানকে লেবার পার্টি দলীয় মনোনয়ন দেয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর একজন অন্য এক লেবার মনোনয়ন প্রত্যাশী লুত্ফুর রহমানের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে লেবার পার্টির ন্যাশনাল একজিকিউটিভ কমিটিতে রিপোট পাঠান যাতে মেয়র লুত্ফুরের সহযোগী পূর্ব লন্ডনের আরো এক ব্যক্তি সিরাজ হকের বিরুদ্ধে আনা হয় বড় ধরনের দুর্নীতির অভযোগ। এর ঠিক তিন দিন পর ১৮ই সেপ্টেম্বর লুত্ফুর রহমানের সহযোগী হিসাবে চিহ্নিত সিরাজ হককে একশত হাজার পাউন্ড ডোনেশনের কারণ দর্শানোর জন্যে পুলিশী চিঠি পাঠানো হয় লুত্ফুর রহমান কে। ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে অবশেষে সবকিছু তদন্ত করে লেবার পার্টি লুত্ফুর রহমানের জন্য দলীয় মনোনয়ন বাতিল করে। এর ঠিক চারদিন পর ২৫শে সেপ্টেম্বর লুত্ফুর রহমান নিজেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করে এবং তার নিমিনেশনপেপারে ছয়জন ব্যক্তি স্বাক্ষর করেন। যাদের মধ্যে কয়েকজন জঙ্গি সংগঠন আই এফ ই’র অফিস কর্মকর্তা এবং ট্রাস্টিও বটে।

এ নিয়ে এন্ড্রু গিলিগ্যান একটি সম্পাদকীয় ও লিখেন যেখানে বলা হয় লুত্ফুর রহমান এবার ইসলামিক জঙ্গিদের নগ্ন সহায়তায় মেয়র হবার স্বপ্ন দেখছেন। অক্টোবরের মেয়র নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েই নভেম্বরের দশ তারিখে আরেক ধর্মবিদ্বেষী এবং আইএফই’র সক্রিয় কর্মী আলীবর চৌধুরী কে নিয়োগ দেন যার রয়েছে দীর্ঘ জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর ইতিহাস।

শুধুমাত্র সমর্থনের বদৌলতে মার্চের আট তারিখ ২০১১ তারিখে লুত্ফুর রহমান জামাল উদ্দিন নামের এক ক্যাব ড্রাইভার কে চারিত্রিক সদন দেন যে ড্রাইভার ছয় সপ্তাহ আগে এক নারী প্যাসেঞ্জার কে যৌন নির্যাতনের দায়ে দোষী প্রমাণিত হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে প্রায় দুশ হাজার পাউন্ড ব্যয়সাপেক্ষ লন্ডন বৈশাখী মেলায় সিরাজ হক নামের এক ব্যক্তিকে মেলা কমিটির উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য সিরাজ হককে দুর্নীতির দায়ে এর ঠিক আগের বছর কাউন্সিল মেলা কমিটি থেকে তাকে বহিস্কার করে। ইস্ট এন্ড লাইফ নামের একটি পত্রিকাকে টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মুখপত্র হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় যারা পূর্ববর্তী সময়ে ধর্মীয় ঘৃণার দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলো।

নিজে একজন কোয়ালিফাইড সলিসিটর এবং আইনের মার প্যাঁচে খুবই ধূর্ত থাকার ফলে ধরাছোয়ার বাহিরে থেকে পেয়ে এই ভাবে ধাপে ধাপে বেড়ে চলে মেয়র লুত্ফুর রহমান দৌরাত্ব। সাথে থাকে শুধু মাত্র বাঙালি কম্যুনিটি তথা পূর্ব লন্ডনের মুসলমান কম্যুনিটির সাপোর্ট করে চলেন একের পর জালিয়াতি আর কুকর্ম।

ধর্মান্ধ এবং অর্ধ শিক্ষিত বিটেন প্রবাসী বাঙালিদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে ভোট জালিয়াতি, স্বজনপ্রীতি, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাসহ নানান ধরনের অপরাধ। কিন্তু এবার বাদসাধে বিবিসি প্যানোরমা। গত বছর তদন্তে নামে তারা এবং পায় নানা ধরনের জালিয়াতির চিহ্ন কিন্তু সুস্পষ্ট প্রমাণ রাখেননি ফলে প্রাইস ওয়াটার কুপার্স নামে একটি অডিট প্রতিষ্ঠান কে দিয়ে অডিট করানো হয় এবং পাওয়া যায় নাম মাত্র মূল্যে সরকারী ভবন বরাদ্ধের প্রমানসহ হাজার অর্থনৈতিক জালিয়াতি।

ফলে নিয়োগ দেওয়া হয় তিনজন স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপক। এবং কিছুটা হলেও খর্ব করাহয় মেয়রের ক্ষমতা এবং আরও স্বাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে শুরু হয় বিচারিক কার্য। কম্যুনিটিতে বেশিরভাগ পরিচিত মানুষ নানা ভাবে তার কাছ থেকে নিয়েছেন নানা ধরনের সুবিধা ফলে তথাকথিত কম্যুনিটি নেতারাও ছিলেন মুখে কলুপ গুজে। এবং এভাবেই গত বছর নির্বাচনে জয়লাভ করেন প্রায় চার হাজার ভোটের ব্যবধানে। পুনরায় নির্বাচিত হন মেয়র হিসাবে। তবে এবার আর ছাড়েন নি লেবার দলীয় প্রার্থী জন বিগস এর সমর্থকরা। জাল ভোট, ধর্মীয় প্রভাব, টাকা দিয়ে ভোট কেনাসহ কয়েকটি সুস্পষ্ট অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়ের করেন এবং দীর্ঘ এক বছর পরে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয় যুগান্তকারী রায়।

যে রায়ে জয় হয়েছে রাজনীতির জয় হয়েছে নীতির এবং জয় হয়েছে স্যাকুলারিজমের। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বিলেতে বাঙালি কম্যুনিটির অবস্থান নিয়ে। আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রমে ঘামে তিলে তিলে গড়ে তোলা এই কম্যুনিটির একটা সুনাম আছে ব্রিটেন জুড়ে। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতি গ্রস্থ ব্যাক্তি ধর্মের লেবাস পরে এবং আমাদের মানুষদের ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে কম্যুনিটি জুড়ে ছড়াচ্ছে ঘৃণা আর ধর্মীয় বিদ্বেষ। আর সেই অন্ধকারের পথ যাত্রী হয়ে অন্ধকারের অতল গহব্বরে নিজেকে এবং পুরো বাঙালি কম্যুনিটিতে নিমজ্জিত করলেন একজন লুত্ফুর রহমান, একজন আলীবর চৌধুরী এবং তাদের সহযোগী মাত্র কয়েকজন দুর্নীতিপরায়ণ তথাকথিত কম্যুনিটি নেতা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত