আসমা সুলতানা

০২ জানুয়ারি, ২০১৬ ১১:০২

দি হিরো অ্যাস আর্টিস্ট: বীরের ভূমিকায় শিল্পী

If you wish to understand others you must intensify your own individualism. -The Critic as Artist, Oscar Wilde

শিল্পকলায় দুর্ভিক্ষ এবং জয়নুল আবেদিনের ক্ষুধার্ত তুলি:
বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত শিল্পী হিসাবে জয়নুল আবেদিনের (১৯১৪-১৯৭৬) অবস্থান বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বড় মাপের কোনো শিল্পীকে সাধারণত মূল্যায়ন করা হয় একাধিক স্তরে - সমাজ, সহকর্মী, চেতনার উত্তরসূরি, সমালোচক ইতিহাসবিদদের দ্বারা। আমাদের ভৌগলিক সীমানায় এই প্রত্যেকটি স্তরে তাঁর অবস্থান সুনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি তাঁর প্রকৃত অবস্থানটিকে যৌক্তিক পর্যালোচনা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে, আর সেই শূন্যস্থানটি প্রায়শই সুযোগ করে দিয়েছে কিছু ভিত্তিহীন সমালোচনার।



উপমহাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসবিদরা জয়নুল আবেদিনকে উপমহাদেশের শিল্পকলায় আধুনিক শিল্পীদের প্রথম সারিতে রেখেই মূল্যায়ন করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমরা তাঁর স্বদেশীরা ব্যর্থ হয়েছি জয়নুল আবেদিনের তুলি থেকেই উপমহাদেশে আধুনিক শিল্পকলা বৈপ্লবিক সূচনা হয়েছিল সেই বাস্তব সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করতে, আর এই প্রবন্ধের মূল প্রস্তাবনা সেটাই। আমরা জয়নুল আবেদিনকে অখণ্ড ভারতের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তাঁর যোগ্য অবস্থানটি এখনও দিতে পারিনি। নেতিবাচক না হয়েও এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি, শিল্পকলার ইতিহাসের বৈশ্বিক পটভূমি সম্বন্ধে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, যোগ্যতা সংক্রান্ত সংশয় থেকে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার ইতিহাস চর্চার অনীহা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে সুপরিকল্পিত উপায়ে সত্যকে প্রকাশিত না হতে দেবার প্রচেষ্টা।



সবার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে শিল্পী হিসাবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল কিশোরগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। তিনি এই উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক নানা পট পরিবর্তনের সাক্ষী, যে ঘটনাগুলো তাঁর শিল্পী মানসতো বটেই আমাদের আর্থ সামাজিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। একজন শ্রেণী, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিল্পী হিসাবে তিনি বাস্তবতার এই স্বরূপটিকে তাঁর শিল্পী মানসে আত্তীকৃত করে নিতে পেরেছিলেন। আর সেকারণেই আমরা তাঁকে সেই সাহসী বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি কলকাতার রাস্তায়, যেখানে মানব অস্তিত্বে তীব্র টানাপড়েন তাঁর মেধা, দক্ষতা আর মননকে অনায়াসে সমন্বয় করেছিল বাস্তবতা আর মানবিক ট্রাজেডিকে একটি নতুন রূপ দেবার জন্য। উপমহাদেশে যে কাজটি আর কোনো শিল্পী এর আগে করতে পারেননি।



পঞ্চাশের মন্বন্তরের মানবিক দুর্দশা যেভাবে রেখাচিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর সৃজনশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে তা অভূতপূর্ব। কোনো শিল্পীই এই ভূখণ্ডে তাঁর আগে এভাবে নির্মোহ অথচ তীব্রতম প্রতিবাদের মহাকাব্য রচনা করতে পারেননি, যা আমাদের সম্মিলিত অবচেতনে অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে। আর সেটাই শিল্পকলার আধুনিকতার একটি বিস্ফোরণ ছিল শিল্পকলায়। তিনি শুধু সেখানে স্ফুলিঙ্গ নন, আগুনের লেলিহান শিখাও, যে শিখার আলোয় আমরা এখনও আমাদের উপেক্ষিত শিল্পকলার স্বরূপ সন্ধানে উদ্যোগী হতে পারি।  



শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন তাঁর সমসাময়িক সময়ের উপমহাদেশীয় শিল্পকলার জগতে প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী যিনি এই উপমহাদেশের মাটিতেই জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং  শিল্পকলা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন, এবং আজীবন এই উপমহাদেশের সীমানার মধ্যেই শিল্পচর্চা করেছিলেন। তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের সংগ্রাম। এবং  তাঁর পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে তাঁর পারস্পারিক সম্পর্কের প্রতিক্রিয়াগুলোরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তিনি তাঁর অন্তর্গত অনুভূতিগুলোকে অভিব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এবং আধুনিক ভঙ্গিমায়। কোনো কাব্যময় ভাবপ্রবণতাকে তিনি তাঁর কাজে স্থান দিতে চাননি। তাঁর শিল্পকর্মের উপস্থাপনা ছিলো অত্যন্ত বাস্তব ঘনিষ্ঠ, রাজনীতি ও সমাজ সচেতন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর কাজের মাধ্যমে এই উপমহাদেশে আধুনিক শিল্পকলার বীজ বপন করে দিয়ে  গিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। উপমহাদেশের শিল্পকলার জগতে যে দুর্ভিক্ষ বিরাজমান ছিলো, সেখানে জয়নুল অবেদিনের  ক্ষুধার্ত তুলি সর্বদাই খুঁজে ফিরেছে মুক্তির নিঃশ্বাস।



শিল্পীর সংজ্ঞা:
শিল্পী জয়নুল আবেদিনের শিল্পচর্চাকে বিশ্লেষণ করবার পূর্বে কিছু সংজ্ঞা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হওয়া প্রয়োজন। শুরু করা যাক খুব সরল একটি প্রশ্ন দিয়ে; একজন শিল্পী বলতে আমরা কি বুঝি?  সম্প্রতি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ভাস্কর ও স্থাপনা শিল্পী আনিশ কাপুর (জন্ম ১৯৫৪) এনডি টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি একজন ‘শিল্পী’ হতে চেয়েছিলেন এবং তিনি কেবল সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তিনি কখনই ভারতীয় শিল্পকলার চর্চা করতে ইচ্ছুক ছিলেন না, তাই ‘ভারতীয় শিল্পী’ হতে চাননি। আনিশ কাপুর মূলত ‘ভারতীয় শিল্পী’ এবং ‘শিল্পী’ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? যে শিল্পকলা মূলত শুধুমাত্র ভারতীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে, তাকে ভারতীয় শিল্পকলা যেমন বলা যায় তেমনভাবে, ভারতীয় শিল্পী বা ঐতিহ্যবাহী শিল্পী বলতে বোঝায়, যে শিল্পীরা ভারতীয় ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট শিল্পচর্চা করে থাকেন তাদেরকে ( যাদের শিল্পচর্চার মূল অনুপ্রেরণা ভারতীয় সংস্কৃতি)। যদি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে দাড়িয়ে একজন দর্শক, এই শিল্পকলা দেখলে ভারতীয় বলে শনাক্ত করতে পারেন, তবে তাকেই আমরা ভারতীয় শিল্পকলা বলতে পারি। অন্যদিকে ‘শিল্পী’ বলতে আনিশ কাপুর বুঝিয়েছেন  সমসাময়িক শিল্পী অথবা  আধুনিক বা উত্তর আধুনিক যুগের শিল্পী  বা স্টুডিও শিল্পী। যিনি নিজের চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে স্বাধীন ভাবে শিল্পচর্চা, সৃজনশীলতার চর্চা এবং নান্দনিকতার চর্চা করে থাকেন এবং  যিনি তার সৃষ্ট শিল্পকর্মের মাধ্যমে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাবে নিজের মনোভাবকে অভিব্যক্ত করতে পারেন। যেহেতু আনিশ কাপুর এ যুগের শিল্পী আমরা ধরে নিচ্ছে তিনি উত্তর আধুনিক সময়ের শিল্পী এবং তাঁর কাজকে আমরা আধুনিক বা সমসাময়িক বলতে পারি।


শিল্পকলায় আধুনিকতা:
শিল্পকলায় আধুনিকতা বলতে সাধারণ ভাবে ধরে নেয়া হয় শিল্প বিপ্লব এবং তৎপরবর্তী সময়ে শিল্পকলাতে যে নতুন পরিবর্তন আসে, মূলত সেই নতুন ধারাটিকে। আধুনিক শিল্পকলার ব্যাপ্তি ধরা হয় ১৮৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে । শিল্পীরা পুরাতন ভাবধারাকে বাতিল করে দিয়ে, নতুন কৌশলে, নতুন শৈলীতে শিল্পচর্চা শুরু করেন। শিল্পের বিষয়বস্তু, কৌশল, আকার এবং উপাদান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন।  শিল্পকলার আধুনিক যুগের সাথে আধুনিক সময়ের আর্থসামাজিক এবং সংস্কৃতি এবং আরো অনেক আনুষঙ্গিক বিষয় জড়িত। ক্যামেরা আবিষ্কারের ফলে আলোকচিত্রও বদলে দেয় শিল্পকলা সম্পর্কে মানুষের গতানুগতিক ধারণা। শিল্পীর স্বতন্ত্রতা এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আধুনিক সময়ে এক একজন শিল্পী স্বতন্ত্র ভাবে এক একটি মতবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম এবং  মনে রাখতে হবে যে আধুনিক শিল্পকলা উপলব্ধির বিষয়, এটি পূর্বের মতো বর্ণনা মূলক নয় বা ইতিহাস ব্যাখ্যাকারী কোনো মাধ্যম নয়। আধুনিক শিল্পকলার শুরুতে দার্শনিক নীচাহ এর প্রভাব অনস্বীকার্য। একজন শিল্পীকে আধুনিক হতে হলে তাকে মুক্তচিন্তার ও মুক্তবোধের হতে হবে। যাতে করে সে কোনো কিছু নতুনকে যেমন আমন্ত্রণ জানাতে পারেন,  তেমনি প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় পুরাতন কোনো কিছুকে বর্জন করতেও কুণ্ঠা বোধ করবেন না।

Art is not merely an imitation of the reality of nature, but in truth a metaphysical supplement to the reality of nature, placed alongside thereof for its conquest. -Friedrich Nietzsche

উপমহাদেশের শিল্পকলায় আধুনিকতা:
উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পকলার সংজ্ঞা এবং শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকজন শিল্প সমালোচক এবং শিল্পকলার ইতিহাসবিদ গবেষণা করেছেন। তবে বিষয়টি নানা ভাবে অসমাধান অবস্থায় রয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।  শিল্পকলার ইতিহাস কোনো বিজ্ঞান নয় যে যুক্তি, তথ্য প্রমাণ দিয়ে সবাই প্রমাণ করে দেবেন। যদিও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও চাক্ষুষ প্রমাণ এবং তথ্যের কোনো বিকল্প নেই, তবুও শিল্পকলায় স্বতন্ত্রের নান্দনিক ব্যাখ্যার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে সেটা যত বাস্তবধর্মী হয় ততই মঙ্গল। যদিও এশীয় বা উপমহাদেশীয় অঞ্চলে ভাবাদর্শের প্রতি মানুষের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।  আধ্যাত্মিকতা এবং মৃত্যুর  পরের জীবনকে প্রাধান্য দেবার কারণে তারা প্রায়শই যুক্তি প্রমাণ এবং বাস্তব ব্যাখ্যা না খুঁজে, কাল্পনিক অলীক অনেক  ব্যাখ্যাতেই তুষ্ট থাকেন।

আমার মতে অনেক সময়, এখানে শিল্পকলার ক্ষেত্রে সময়ের ধারাবাহিকতাকেই আধুনিক বলে ধরা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আধুনিক সময়ে জন্ম গ্রহণকারী শিল্পীদেরকেই আধুনিক বলা হয়ে থাকে সাধারণত। তাদের শিল্পকর্মে কতটুকু সেই আধুনিকতা ফুটে উঠেছে সেটা যাচাই বাছাই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করেই। কিছু কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রমে অবস্থান করেছেন এবং আজো করছেন। এবং তারা কারা? সেই আলোচনাও এখানে প্রাসঙ্গিক। যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পী অমৃতা শের - গিল, শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন প্রমূখ। যদিও উপমহাদেশের শিল্পকলার চর্চার ধারাবাহিক কোনো ইতিহাস নেই তবুও আমরা ইতিহাস চর্চা করে যে সব তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারি, তার উপরেই ভিত্তি করে আমরা আমাদের গবেষণার বিষয়াদিকে সাজাতে পারি।  

আধুনিকতা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামত:
আমার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা শুধু মাত্র সময়ের কোনো ধারাবাহিক চলমানতা নয়; আধুনিকতা অর্থটি এর থেকেও ব্যাপক। সময়ের খাঁচায় বন্দি থাকবার নাম আধুনিকতা নয়। আধুনিকতা হলো সময়কে মুক্ত করে দেবার একটি প্রক্রিয়া। একজন ব্যক্তি, তার কাজের মাধ্যমে নিজের স্বতন্ত্রতাকে প্রকাশ করা। কোনো নিদিষ্ট জাতি বা ধর্ম বা সংস্কৃতির পরিচয় বহনের নাম আধুনিকতা নয়। মানব জাতির প্রতিনিধি হিসেবে একজন মানুষের তার চিন্তাধারা বা কাজের মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার নামই আধুনিকতা। যার মাধ্যমে তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রুচির প্রকাশ ঘটবে এবং অন্যরা সেটাকে নিজের বোধের মাধ্যমে উপলব্ধি করবে।


উপমহাদেশে আধুনিকতার হাওয়া:
বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকেও ভারতে শিল্প বিপ্লবের হাওয়া লাগেনি, সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যগুলো তখনও ভেঙ্গে পড়েনি। উপমাহদেশের শিল্পীরা তখন ঔপনিবেশিকতার শিকল থেকে বের হয়ে দেশাত্মবোধে, জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন ভাবে নিজেদের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাদের কাজের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ব্রিটিশ শিল্পকলার গুরু ই. বি. হাভেলের সহযোগিতায় উপমহাদেশের শিল্পীরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছিলো পশ্চিমা রীতির সাথে। ১৯২২ সালে জার্মানের বাউহাউজের আধুনিক শিল্পীদের শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় কলকাতায়। যেখানে শিল্পী পল ক্লি, ভাসিলি কান্দিনস্কি,   ইয়োহানেস ইত্তেন প্রমুখ শিল্পীদের শিল্পকর্ম স্থান পায়। উপমহাদেশীয় শিল্পীরা সেই প্রদর্শনী দেখে পশ্চিমা আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে ধারণা পান। তাদের প্রতিক্রিয়া যদিও বেশ ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। এবং তাদের সবার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।  শিল্পীরা ঔপনিবেশিকতার কুফল এবং জাতিয়তাবোধের সুফল বুঝতে ব্যর্থ হন নানা কারণে। তাদের শিল্পসৃষ্টি মধ্যে সেই টানাপোড়নের গ্লানি ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

বেঙ্গল স্কুল:
ঔপনিবেশিক শাসনামলে উপমহাদেশের শিল্পীরা যখন পশ্চিমারীতির শিল্পকলা অনুকরণে শিল্পচর্চা করতে অস্বীকৃতি জানান তখন তারা পুরাতন শৈলীর বা অতীতের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন তাদের শিল্পকলার মাধ্যমে। উপমহাদেশের মুঘল মিনিয়েচার, রাজপুত মিনিয়েচার, পারস্য রীতির মিনিয়েচার, অজন্তা ইলোরার  চিত্ররীতি, উপমহাদেশের লোকজ শিল্পকলা বিভিন্ন উৎসকে তারা তাদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু করে নিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ফলে, কোম্পানি রীতি ও অ্যাকাডেমিক বাস্তবতাকে তারা বাতিল করে দিয়ে, তাদের হারিয়ে ফেলা ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন  বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ শিল্পকলার শিক্ষক  ই. বি. হাভেল (১৮৬১-১৯৩৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতায়, উপমহাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য শিল্পীদের অনুপ্রেরণা দেন, সেই বিশেষ শিল্পরীতিকে বলা হয় বেঙ্গল স্কুল । তারা অতীতের শৈলীকে অনুকরণ করেন স্বদেশী চেতনায়, জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে  শিল্পকলা চর্চার প্রচেষ্টা করেন। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), নন্দলাল বসু (১৮৮২-১৯৬৬) সুনয়না দেবী (১৮৭৫-১৯৬২), যামিনী রায় (১৮৮৭-১৯৭২), গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮) প্রমুখ বেঙ্গল স্কুলের রীতিতে শিল্পচর্চা করেন । যদিও হাভেল মহতী উদ্যোগ সমাধানের পথ না দিয়ে সমস্যাটাকে বেশ ঘনীভূত করে দিতে থাকে। কারণ হাভেল বোঝতে মূলত ব্যর্থ হন উপমহাদেশের শিল্পীরা, পশ্চিমের শিল্পরীতি অনুকরণ না করেও নিজস্ব ভঙ্গিমায় শিল্পকলার চর্চা করতে পারতেন। হাভেলের ব্যর্থতার কারণ উভয় পক্ষের দূরদৃষ্টিতার অভাব এবং তৎকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিল্পকলার ভূমিকা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টির ঘাটতি। বিশ্বের শিল্পকলার জগতে  ইংল্যান্ডের শিল্পকলা তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। শুধুমাত্র রোমান্টিকতা, শিল্পী কনস্টেবল এবং শিল্পী টার্নারের (১৭৭৫-১৮৫১) নিরীক্ষাধর্মী নিসর্গচিত্র এবং তার পূর্বে প্রি-র‌্যাফালাইট (১৮৪৮) ঘরানার আর্বিভাব, পরবর্তীতে ভর্টিসিজম (১৯১৪) মতবাদের জন্ম।  এই কতগুলো মতবাদের জোর নিয়ে তারা ভারতবর্ষের শিল্পীদের অধুনিক শিল্পকলার শিক্ষা দেবেন সেটা আশা করা দূরদৃষ্টিটার লক্ষণ নয়। তাছাড়া ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক বাস্তবতা, ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রতি ক্রমশ বাড়তে থাকা আনুগত্য শিল্পকলার জগতে সৃষ্টি করেছিল নতুন ধরনের আত্মপরিচয়ের একটি সংকট। যার প্রতি তৎকালীন শিল্পীদের প্রতিক্রিয়াও ছিল শিল্পীভেদে ভিন্ন। তবে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে  প্রকৃত শিল্পী / সাহিত্যিকরা সব সময়ই শোষণ আর নিপীড়নের বিপক্ষে কথা বলেছেন। উপরন্তু ভারতবর্ষের বাইরের শিল্পী/সাহিত্যিকদের সাথে তখন ভারত বর্ষের বা উপমহাদেশের মানুষে যোগাযোগ তেমনিভাবে শুরু হয়নি আজকের মতো যে, আধুনিক সমাজে শিল্প সাহিত্যচর্চা কিভাবে হচ্ছে তার খোঁজ তারা ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন।


গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর:
শিল্পী গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮) যিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র, তিনি  বেঙ্গল স্কুলের চিত্ররীতিতে শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে চাননি বলে নব্য বেঙ্গল স্কুল শৈলীতে তাঁর শিল্পভাষাকে প্রকাশ করতে গিয়ে, কিউবিজমের মতো করে শিল্পকলা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। তবে তাঁর অঙ্কিত, ক্যারিকেচারগুলো ছিলো বুদ্ধিমত্তায় ভরপুর এবং তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর। তবে শিল্পকলার জগতে ক্যারিক্যাচোরকে কখনও হাই আর্ট বলে মনে করা হয়নি। গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আধুনিকতার চর্চা করেছেন নিজের মতো করে।  তাঁর কিউবিজমকে পশ্চিমের কোনো শিল্পসমালোচক পিকাসো বা ব্র্যাকের কিউবিজমের সমতুল্য বলে মেনে নিতে রাজি হননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হতাশ হয়ে ছিলেন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) যখন উপমহাদেশের শিল্পীদের বোঝাতে ব্যর্থ হলেন শিল্পকলায় আধুনিকতা কি হওয়া উচিৎ । এমনকি তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকেও বোঝাতে সক্ষম হননি, যারা সেই সময় উপমহাদেশীয় শিল্পকলাতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। শেষে তিনি নিজেই তুলি হাতে তুলে নেন এবং উপমাহদেশের শিল্পীদের, তথা সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দেন আধুনিক ভঙ্গিমায় শিল্পকলার চর্চা করে। কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে  উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পকলার উন্মুক্ত আলো প্রবেশ করা শুরু করে যাঁর হাতে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপরেও যদিও অনেক শিল্পী আধুনিক শিল্পচর্চার নামে ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকবারও কোনো অবকাশ নেই তবে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য হলো রবীন্দ্রনাথ কোনো প্রতিষ্ঠিত পেশাদারী চিত্রশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং কবি এবং দার্শনিক বা সঙ্গীতজ্ঞ। শিল্পকলায় আধুনিকতা আসতে হবে মূলত পেশাদারী শিল্পীদের হাত ধরে, যাতে করে পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পায়। মূলত তাঁর শিল্পভাষা ছিল আত্মজীবনীমূলক,তিনি তার নিজের অন্তর্জগতকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন তার একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিমায়।  এর ব্যতিক্রম জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাষায় জায়গা করে নিয়েছিল সম্মিলিত জীবনের বর্ণনা, যে জীবনের বর্ণনা তার নিজস্ব শ্রেণী অবস্থানে যেমন দায়বদ্ধ, তেমনি তিনি শিল্পকলার ভাষাকেও ব্যবহার করেছেন আধুনিক শৈলীর সুস্পষ্ট ব্যাকরণে। আর সেটাই আমরা আশা করি কোন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং দৃশ্যমান চিত্রকলা নির্মাণের কোন পেশাজীবীর কাছে, যাকে শিল্পী বলতে আমাদের সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ থাকে না।


শিল্পী অমৃতা শের-গিল:
উপমহাদেশের শিল্পী অমৃতা শের-গিলকে (১৯১৩-৪১) ভারতীয় শিল্প সমালোচকেরা বেশ উচ্চ কণ্ঠে ভারতের প্রথম সারির আধুনিক শিল্পী হিসেবে বিবেচিত করে থাকেন তবে প্রথম মহিলা পেশাদারী শিল্পী হিসেবে তাঁর মর্যাদাতো অবশ্যই অনস্বীকার্য। কিন্তু তারা এটাও বলতে দ্বিধা বোধ করেন না যে অমৃতা কখনই  জন্মগতভাবে এবং আদর্শিকভাবে ভারতীয় ছিলেন না। তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে, মা ছিলেন হাঙ্গেরিয়,  পিতা ছিলেন ভারতীয়।  অমৃতা সেই সময় ইউরোপে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং খুব সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি তাঁর শিক্ষার অনুশীলন করবার সুযোগ পান ভারতের মাটিতে এবং ইউরোপে। সমাজের উঁচুস্তরের সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের মাঝে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং বাকি জীবন। তাঁর প্রতিভা বিকাশের পথ বেশ প্রশস্ত ছিলো তাঁর প্রতিভার চেয়ে। প্রথমদিকে তিনি  শিল্পী পল গগ্যাঁর প্রিমিটিভিজমে অনুকরণে শিল্পচর্চা করলেও পরবর্তীতে তিনি তাঁর জন্মস্থান হাঙ্গেরি থেকে হাঙ্গেরিয়ান শিল্প শৈলীর প্রভাবে প্রভাবিত হন।   ভারতীয় মানুষের জীবন যাত্রার কথা তিনি ইউরোপীয় প্রিমিটিভিজম বা পল গঁগ্যার শৈলীতে তুলে আনার চেষ্টা করেন। তাঁকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ভারতীয় শিল্পী যিনি কিনা ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলার চর্চা শুরু করেন, বলা প্রায় অসম্ভব । এছাড়া তার সংক্ষিপ্ত জীবন ও ট্র্যাজিক পরিণতি সুযোগ করে দিয়েছিল তাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পুরাণের অনুপ্রবেশ ও মরণোত্তর খ্যাতি প্রতিষ্ঠাকরণে । তবে ভারতীদের জাতীয়তাবোধ বেশ গভীরে প্রোথিত, সেখানে অমৃতাকে নিয়ে তাদের গর্বের জায়গাটা বেশ স্পর্শকাতর। প্রিমিটিভিজম শিল্পশৈলীকে পশ্চিমা শিল্পকলার জগতে খুব একটা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয় না যদিও।


শিল্পী যামিনী রায়:
কোম্পানির অ্যাকাডেমি রীতি এবং বেঙ্গল স্কুলের রীতিকে অস্বীকার করে শিল্পী যামিনী রায় (১৮৮৭-১৯৭২) নিজস্ব শৈলীতে শিল্পচর্চা শুরু করেন বলে তিনি দাবী করেন। যদিও তাঁর শিল্পকলাকেও প্রিমিটিভিজমের দলে ফেলা যায় এবং বাংলা লোকশিল্পের সাথে তাঁর শিল্পকর্মের কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই। এমনকি কালীঘাটের পটচিত্রের সাথেও রয়েছে সাদৃশ্য। নিজেকে পটুয়া বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। ভারতীয় অনেক শিল্পসমালোচক তাঁকে আধুনিক শিল্পী বলে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসালেও, আমি তাঁর কাজে কোনো আধুনিক উপধান খুঁজে পাই না। বরং তাঁর কাজ আলঙ্কারিক এবং নকশাবহুল। যেকোনো লোকশিল্পের থেকেও নির্জীব এবং দ্যোতনাবিহীন । আমি আগেই বলেছি কাল্পনিক এবং কাব্যময়তার স্থান আধুনিক শিল্পকলাতে নেই। সেটা শুধুমাত্র আধুনিক সময়ে সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু গুণগত বিচারে নান্দনিকতায় আধুনিক না অবশ্যই।


পাকিস্তানি আধুনিক শিল্পকলা:
আব্দুর রাহমান চুঘতাইকে পাকিস্তানের প্রথম সারির আধুনিক শিল্পীর মর্যাদা দেয়া হয়। তাঁর কাজেও মুঘল মিনিয়েচারের অনুকরণ ছাড়া বিশেষ কোনো চরিত্র খুঁজে বের করা প্রায় সম্ভব নয় । এমনকি পরবর্তী শিল্পীদের কাজেও আধুনিকতার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। যেমন যুবাইদা আগা (১৯২২-১৯৯৭), শাকের আলি (১৯১৪-১৯৭৫) প্রমুখদের কাজে রক্ষণশীলতা এবং ভাবপ্রবণতার প্রভাব সুস্পষ্ট। প্রহেলিকাময় শিল্পকর্ম ব্যতীত আর কিছু নয়।


ক্যালকাটা গ্রুপ:
বেঙ্গল স্কুলের ভাবাদর্শকে এবং জাতীয়তাবোধের অতিরঞ্জিত নাটকীয় শৈলীকে মেনে নিতে পারেননি নতুন প্রজন্মের কিছু শিল্পী । তাঁরা মূলত পশ্চিমা বাস্তববাদিতা বা শিল্পরীতিতে শিল্পচর্চাকে আধুনিকতার চর্চা বলে মনে করতেন। ইম্প্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট এবং অন্যান্য শিল্পকলার মতবাদগুলো হয়ে উঠলো তাদের অনুপ্রেরণার উৎস। সেই প্রতিবাদের প্রকাশরূপে ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্যালকাটা গ্রুপ।  শিল্পী পরিতোষ সেন (১৯১৮-২০০৮), শিল্পী প্রদোষ দাশগুপ্ত (জন্ম ১৯১২-মৃত্যু অজানা) , শিল্পী নীরোদ মজুমদার (১৯১৬-১৯৮২), শিল্পী  শুভো ঠাকুর (অজানা), শিল্পী গোপাল ঘোষ (১৯১৩-১৯৮০), শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রমুখও ছিলেন প্রতিবাদী, প্রগতিশীল শিল্পকলা মতবাদের অনুগামী। নতুন প্রজন্মের এই আভোঁ গার্দ শিল্পীরা ঐতিহাসিকতার বর্ণনা, পৌরাণিক কাহিনীর অভিব্যক্তি, স্বপ্নাচ্ছন্নতার খেলা ও রূপকথার মায়াজালকে পরিত্যাগ করার চেষ্টা করেন। তারা নিজস্ব ভঙ্গিমায় শিল্পকলার চর্চার শুরু করেন। তবে তাদের অধিকাংশের কাজ ছিলো অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে এবং পশ্চিমারীতির অন্ধ অনুকরণ। তাঁরা সবাই যেনো অনির্দিষ্ট কোনো  যাত্রার সহযাত্রী ছিলেন । সেখানে শুধুমাত্র জয়নুলের গন্তব্য ছিলো সুনির্দিষ্ট এবং ভিন্ন।  

I believe in the God-given genius of certain individuals, and I value a society that makes their existence possible.- Kenneth Clark, Civilisation

জয়নুলের স্বতন্ত্রতা ও শিল্পকলার আধুনিকতায় জয়নুলের অবদান:
ব্রিটিশ শিল্প সমালোচক জন বার্জার তাঁর ওয়েজ অব সিইং বইতে বলেছিলেন, অতীত থেকে আমাদের বঞ্চিত করবার অর্থ আমাদের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা।  আমাদের ভবিষ্যৎ গড়বার জন্য প্রয়োজন অতীতকে খুঁড়ে বের করে, প্রতিনিয়ত নতুনভাবে পর্যালোচনা করার মাধ্যমে। সময়ের দাবিতে অতীতকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো দরকার সত্যের নির্মোহ আলোয়। যে কাজটি করতে প্রায়শই আমরা আলস্যে ভুগি। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য প্রমাণ, পুস্তক ও রশদের অভাবে আমরা পুরাতন ও সহজলভ্য ধ্যান ধারণাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। কারণ সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে পরিমাণ পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়, যে পরিমাণ আত্ম-বিশ্লেষণ এবং অতীত ইতিহাসকে পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়, অনেক সময়ই আমাদের সেই গুণগুলোর ঘাটতি থেকে যায়।

এই অংশের আলোচনার শুরুতেই বলে নেয়া দরকার বাংলাদেশে তিনি যেমন প্রতিষ্ঠিত, শিল্পকলার প্রথম প্রাণ পুরুষ হিসেবে তেমনি, পাকিস্তানের শিল্পসমালোচকেরাও তাকে তৎকালীন দুই পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে তাঁর নাম উচ্চারণ করে থাকেন। আমাদের উপমহাদেশের মধ্যে জাতীয়তাবোধ একটু মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে থাকার কারণে আমরা ভিন্ন দেশের প্রতিভাবানদেরকে নিজের দেশের থেকে অগ্রগামী বলে ধরতে কখনই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। এই দায়িত্ব আমাদের বাংলাদেশীদের নিতে হবে, যদিও আমরা কিংবদন্তী বলতে জোর পূর্বক কোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে বিশেষ কোনো ব্যক্তির নাম প্রতিষ্ঠা করি, তাতে করে আসল প্রতিভাবানেরা অন্ধকারেই হারিয়ে যায়।

ফরাসী শিল্পী এ্যাডওয়ার্ড মানেকে প্রথম আধুনিক শিল্পী হিসেবে মনে করা হয়। তেমনি আমাদের বাংলাদেশের মাটিতে জন্মানো জয়নুল আবেদিন ছিলেন এই উপমহাদেশের প্রথম শিল্পী যিনি তারঁ কাজে আধুনিকতার মূলসুরটি ধরতে পেরেছিলেন সফল ভাবে। ইউরোপে মানেকে একবাক্যে আধুনিক শিল্পের জনক হিসেব মনে করা হতো না একসময়, ইতিহাসের  তাঁর পর্যালোচনার প্রক্রিয়াটি ঘটেছে ধীরে ধীরে। কেন মানেকে প্রথম আধুনিক শিল্পী হিসেবে ধরা হয় তার একটা সূক্ষ ব্যাখ্যা রয়েছে । মানে ছিলেন সাহসী শিল্পী যিনি নিজস্ব শিল্পভঙ্গি অভিব্যক্ত করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। তাঁর প্রতিবাদী স্বরূপটি বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর কাজে - যেমন আমরা জয়নুল আবেদিনের কাজেও খুঁজে পাই তাঁর প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বটিও।


যদিও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল থেকে পশ্চিমা রীতিতে শিক্ষা লাভ করেছেন, কিন্তু তিনি অ্যাকাডেমি রক্ষণশীল ভঙ্গিমায় শিল্পকলার চর্চ করতে চাননি । আবার এশিয় ভাবদার্শ বা কল্পনাপ্রবণ ভঙ্গিতেও তিনি শিল্পচর্চা করতে চাননি । তিনি এই দুটোর সংমিশ্রণে এক অভিনব শৈলী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের লোক-জীবনের ধারাবাহিকতাকে বিষয়বস্তু করে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছেন সফলতার সাথে। তাঁর বিষয় নির্বাচন থেকে শিল্পের উপাদান, পরিসর নির্বাচনে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র।

শিল্পী জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাষার প্রধান গুণ হলো তাঁর বলিষ্ঠ কম্পোজিশন। তিনি যে কোনো কাজ খুব অল্প উপাদানে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে কম্পোজিশন করেছেন। কোনো কোনো কম্পোজিশন দেখলে মনে হয় যেনো কোনো ফিল্মের শট। একটু পরেই ক্যামেরা হয়তো ঘুরো পুরো দৃশ্যটা দর্শকদের দেখিয়ে দেবে। অনেক গুলো শিল্পকর্মে বেশ পরিচ্ছন্ন কম্পোজিশন দেখা যায় যে গুলোতে তিনি মানুষের ফিগার বা অবয়বকে ব্যবহার করেছেন বিষয় বস্তু হিসেবে । আবার অনেকগুলো রেখাচিত্রে বা পেইন্টিং এ তিনি মানুষের ফিগারগুলোকে মনুমেন্টাল ভাবে উপস্থাপন করেছেন । মানুষগুলোকে তিনি প্রকৃতির থেকে অনেক বিশাল করে দেখাতে চেয়েছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যা বেশ ব্যতিক্রম সেই সময়টিতে। এমনকি তিনি একজন গাড়িয়ালের গরুর গাড়ী ঠেলার দৃশ্যকে এমন করে উপস্থাপিত করেছেন যেনো মনে হয় ভাস্কর্য অথবা এরও একটি মনুমেন্টাল আবেদন আছে । যুধবদ্ধ মানুষের কম্পোজিশন  দেখলে মনে হয় তারা ঐক্যবদ্ধ এবং সংঘটিত। তাদের শক্তি তাদের ঐক্যে এবং ভাতৃত্ববোধে।  আর প্রকৃতির কম্পোজিশন দেখলে মনে হয় বিশাল এবং বিস্তৃত, সবর্দা বেড়ে চলছে। দিগন্তের কোনো সীমা নেই যেনো।

জয়নুল আবেদিনের তেল রঙের চিত্রকলা ব্যতিত, খুব স্বল্প, সীমিত রঙের ব্যবহার দেখা যায় কাজে। তেল রঙের চিত্রে উজ্জ্বল রঙোর ব্যবহার।  লাল হলুদ, সবুজ, ধুসর কিংবা বাদামি- এই সব রঙই প্রকৃতি বা ভূমিকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই সব উষ্ণ রঙের ব্যবহারের কারণে তাঁর চিত্রকলাকে নিবিড় বলে মনে হয়। তারা যেনো দর্শকদের কে কাছে টানে। যেমন বিদঘুটে রঙয দর্শকদেরকে দূরে ঠেলে দেয়। তবে উষ্ণ রঙ সর্বদাই ইতিবাচক মনসিকতাকে ব্যক্ত করে। তিনি তেমনভাব শীতল রঙ ব্যবহার করেননি। তাঁর চিত্রকলাকে মানুষের যন্ত্রণার কথা থাকলেও তারা কখনও বেদনাচ্ছন্ন নয়। মোটা বলিষ্ঠ কালো রঙের রেখা জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাষার প্রধান উপদান। চীনা ও জাপানি চিত্রকলার উন্মুক্ত জল রঙ বা রেখা প্রধান রেখা চিত্রের প্রভাব ও বলা যায়। সুনির্দিষ্ট কিছু রঙ ব্যবহারের কারণে, তাঁর শিল্পকর্মগুলো হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন এবং দর্শকের হৃদয়ের গভীরে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে পেরেছে। সে দিক থেকে তিনি উপমহাদেশের ঐতিহ্যকে দিয়েছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। মুগল মিনিয়েচারের মতোও তাঁর শিল্পকর্মে মৃদু রঙের ব্যবহার শিল্পকর্মে দেখা যায়। তিনি নিজের অবস্থান থেকে দূরে সরে যাননি। তিনি তাঁর অবস্থানে দাড়িয়েই শুধু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন ভিন্ন মাত্রায়।

জয়নুল আবেদনি মূলত দ্বিতলে চিত্র নির্মাণ করেছেন। দ্বিতলের উপরে ত্রিমাতৃক চিত্র নির্মাণ করেছেন নিরলসভাবে। তাঁর স্ক্রল চিত্রগুলো প্রমাণ করে তিনি তাঁর শিল্প সৃষ্টির পরিসরকে মুক্ত করে দিতে চেয়েছিলেন। আকাশের মতো উদার করতে চেয়েছেন এবং দিগন্তের মতো বিস্তৃত করতে চেয়েছেন। এই সাহসিকতা সেই সময় কোনো শিল্পীই দেখাতে পারেননি। জলরঙ, চারকোল, তেল রঙ, টেম্পেরা, গোয়াশ, মোম রঙ, কালি, প্যাস্টেলের মতো সহজ সরল মাধ্যম ছিলো তাঁর শিল্প সৃষ্টির হাতিয়ার। এই সামান্য কতগুলো উপাদান বা মাধ্যম দিয়ে তিনি নির্মাণ করে গেছেন অসামান্য শিল্পকর্ম।

শিল্পী জয়নুল আবেদিন হলেন অদ্বিতীয় এক শিল্পী যিনি ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের  দৃশ্যকে সার্থক ভাবে চিত্রিত করে গিয়েছেন। বলিষ্ঠ  বিয়ষবস্তু, সরল রেখা, সহজলভ্য উপাদান ব্যবহার করেছেন তিনি এই রেখা চিত্রগুলো নির্মাণ করতে। আজ আর কারো অজানা নেই যে এই রেখাচিত্র গুলোই মূলত তাকে দিয়েছে বিশ্ব পরিচিতি এবং এই রেখাচিত্রগুলোর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মাটিতে তিনি বপন করে দিয়েছে আধুনিক শিল্পকলার বীজ খুব স্বভাবজাত ভাবে। যেনো প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটেছে বিষয়টি। হাতের কাছে তিনি  যা পেয়েছেন শিল্প উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। স্বল্প মূল্যের এবং সহজলভ্য। তরুণ শিল্পীকে তাড়া করে ফিরেছে মানুষের সৃষ্ট এই কৃত্রিম অভাব। তিনি মেনে নিতে পারেননি দেশভাগের নামে এই নোংরামীকে। খাদ্য রাজনীতি তথা বিশ্ব রাজনীতির কুৎসিততম অবয়বকে তিনি শাশ্বত করে রাখলেন তাঁর তুলির আচড়ে। জয়নুলের সমসাময়িক আরো অনেক শিল্পীরাও দুর্ভিক্ষের চিত্র নির্মাণে অবদান রেখেছেন। কিন্তু কারো চিত্রই জয়নুল আবেদিনের মতো বলিষ্ঠ নয়। দুর্ভিক্ষের চিত্র অংকনে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রথম সারীর এমনও বহু শিল্পী ছিলেন সেই সময় যারা তখন সমাজের উঁচু স্তরের মানুষজন, তাঁরা ভুলেও মনে করেননি যে দুর্ভিক্ষ কোনো বিষয় হতে পারে, শিল্প সৃষ্টির জন্য অতিরিক্ত রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়েছিলেন। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সরল, সাহসী এই রেখাচিত্রগুলো দিয়েই যেমন কলকাতায় রাস্তায় সে দিন জন্ম হয়েছিলো বাস্তববাদিতার তেমনি শুরু হয় আধুনিক শিল্পকলার যাত্রার।

জয়নুল আবেদিনের বিষয়বস্তু নির্বাচনে যে স্বতঃস্ফূর্ততা সেই সময়কার খুব কম শিল্পীদের মধ্যে লক্ষণীয়। তিনি মানুষ, প্রকৃতি, পশু পাখি, জীবন, রাজনীতি, চলমান বিশ্বের পরিস্থিতি, তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া যে কোনো ঘটনাকেই তাঁর শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু করে নিতে জানতেন। একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করতেন, সেগুলো তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে অভিব্যক্ত করতে পারতেন সফলভাবে। এবং একজন আধুনিক শিক্ষিত নাগরিকের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।

জয়নুলের শিল্পকর্মের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সাধারণ মানুষের শ্রম। তিনি মাঝি মাল্লা, ফসলের জমিতে কর্মরত কৃষক, ঘরে ফেরা শ্রমিক বা জেলে, বাংলাদেশের পরিশ্রমী নারী পুরুষের জীবন যাপন চিত্রিত করেছেন অত্যন্ত নান্দনিক ভাবে। শ্রমিকেরা কখনও কর্মরত, কখনও নিয়তির কাছে পরাজিত, কখনও আবার উৎসবে মুখর। ১৯৭০ সালে আঁকা নবান্ন স্ক্রল চিত্রটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল ও বিসম্য়কর ঘটনা। জলরঙ, মোম রঙে মিশ্র মাধ্যমে আঁকা এই চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশর শিল্পকলার ইতিহাসে তিনি বাড়তি মাত্রা সংযোজন করে দিয়ে গেছেন।

জয়নুল আবেদিনের শ্রেষ্ঠত্ব  বর্ণনা  করে শেষ করা সম্ভব নয়। ছোট্টো একটি অবহেলিত পাখিকে কেউ শিল্পকর্মে স্থান দেবার কথা হয়তো ভাবেননি তখনও তাঁর ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্বের প্রকাশ সেখানেই। তিনি লাস্যময়ী রমণীদের চিত্র নির্মাণ করলে আরো ভালো ভাবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারতেন। কিন্তু তিনি অবহেলিত এই পাখিটিকে আমাদের শিল্পকলার জগতে বিশেষ স্থান দিয়েছেন।  বাঙালি সমাজের আটপৌরে জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক সঙ্গি হলো কাক।  বাস্তবধর্মী ভঙ্গিতে অঙ্কিত তাঁর কাকগুলোকে দেখলে মনে হয় না কোনো কাক,  মনে হয় যেনো সমাজের বিপ্লবী মানুষের প্রতিকী প্রকাশ, মনে হয় যেনো উদ্ধত কোনো তরুণ, মনে হয় না ময়লা আর্বজনা খুঁজে খাওয়া কোনো নোংরা প্রাণী, মনে হয় আমাদের চেনাজানা কেউ । একজন মানুষের অবয়ব  নিয়ে সে দাড়িয়ে থাকে। কালো কাককে অলুক্ষনে বলা হয় আমাদের সমাজে। জয়নুলের কাক গুলো যেনো সাহসের বার্তাবাহক।  কত স্বল্প, রেখা ও রঙ ব্যবহার করে তিনি দক্ষতার সাথে কাক গুলোকে আঁকতেন , তাতে তাঁর দক্ষতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি তিনি মিনিমালিজমের আভাস দিয়ে যান তাঁর প্রকাশ ভঙ্গিমায়। আমাদের মনে করিয়ে দেন, আধুনিক শিল্পকলার প্রকাশ ভঙ্গিমায় ;  মোর ইজ লেস । লন্ডনের টেট মর্ডানের শিল্পী ইয়ানিস কুনেলিস এর দেয়ালে রেখা চিত্রের সাথে সেটে দেয়া দুটো মৃত কাককে (১৯৭৯) দেখে আমার জয়নুলে কাকের কথা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। জয়নুল আবেদিনের কাক আরো কয়েক দশক আগের আঁকা (১৯৪৩)। জয়নুলের আবেদিনের কাকগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় টিকে থাকার সংগ্রামে সফল এক প্রজাতির কথা।

I should paint my own places best. - John Constable

জন কন্সটেবলকে (১৭৭৬-১৮৩৭) ব্রিটিশ শিল্পকলায় আধুনিকতার গুরু বলা হয়। কারণ তিনিও পুরাতন ধারণাকে বাদ দিয়ে প্রকৃতির কাছে আত্ম সমার্পণ করেছিলেন। তিনি ক্রমাগত বিরামহীনভাবে ভূদৃশ্যের চিত্র নির্মাণ করে গেছেন।  জয়নুল আবেদিনের ভূদৃশ্যগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিল্পী কন্সটেবলের কথা। নদী, নৌকা, বিস্তৃত ভূমি, খোলা মাঠ বা ধান ক্ষেত, খোলা জায়গা, উচুঁ নীচুঁ পাহাড়, উপত্যকা। বিস্তৃত খোলা ভূমির বুকে একেঁ বেঁকে চলে নদী। ডাচ ভূদৃশ্যের সাথেও যার রেয়েছে সদৃশ্যতা । বাংলাদেশের অপরূপ রুপের যে সহজ সরল বহিঃপ্রকাশ তা জয়নুল আবেদিনের আগে কেউ অংকন করতে পারেনি। নিজভূমির এমন অপার সৌন্দর্য্য শিল্পকর্মে সাবলিলভাবে আশ্রয় দেয়ার মতো সাহসিকতায় বা কার ছিলো। সীমিত কিছু রঙ ও রেখা ব্যবহার করে জল রঙে বা রেখা চিত্রে তিনি যে ভূদৃশ্য নির্মাণ করে গেছেন তা তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি।

জয়নুল আবেদিনের কাজ আর প্রকৃতিকে কোনো ভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়। কারণ তিনি প্রকৃতির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। একজন শিল্পীর জন্য প্রকৃতির থেকে মহান কোনো শিক্ষক আর কেউ হতে পারে না।  প্রকৃতির নানা উপাদান তিনি তাঁর কাজে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির ভালো মন্দ সব কিছুকে তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। যেমন ভূদৃশ্য অংকন, গাছ পালা, পশু পাখির ব্যবহার, প্রাকৃতি দূর্যোগের চিত্রও তিনি অংকন করেছেন। বিষয়ের বৈচিত্রতা নির্মাণে তাঁর দক্ষতা অনবদ্য। তেমনি প্রকৃতির রুক্ষ দিকটিও তুলে ধরতে পিছপা হননি। মনপুরা স্ক্রল চিত্রটিতে তিনি ১৯৭০ সালের জলোচ্ছাস পরবর্তী ভয়াবহতার দৃশ্য চিত্রিত করে গেছেন।

জয়নুলের কাজে যুগল দম্পতি বিষয় হয়ে এসেছ বেশ অনেকবার। তাঁর সুপুরুষ ব্যক্তিত্বের গভীরে যে প্রেমিক মন তিনি তা লুকাতে পানেনি। হয়তো চেষ্টাও করেননি। তিনি সাঁওতাল যুগলের চিত্র অংকন করেছেন। তিনি যুগল হিসেবে এঁকেছেন সাঁওতাল রমণীদের। যুগল পুরুষ, এমনি জোড়া পশুরও চিত্রে নির্মাণ করেছেন। পরিবারের চিত্র, যুথবদ্ধ মানুষের চিত্র অংকন করেছেন। তাঁর মৃত্যু শয্যাতেও তিনি শেষ চিত্র হিসেবে এঁকেছেন যুগল মুখাবয়ব।

জয়নুল আবেদিনের দক্ষতার গোপন সূত্র হলো তাঁর পর্যবেক্ষণ অসাধারণ ক্ষমতা। তিনি তাঁর চোখকে এমন ভাবে তৈরী করে ফেলে ছিলেন যে, কয়েক মুহূর্ত দেখা মাত্র তিনি একজন মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হতেন তাঁর রেখাচিত্রের মাধ্যমে। আমরা দেখি তিনি খুব অল্পকতগুলো রেখার মাধ্যমে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বা নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছেন। এছাড়া অন্য যে কেনো প্রতিকৃতি চিত্রনে তিনি সেই বিশেষ ব্যক্তিটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরতে সক্ষম হতেন । যেমন ব্যক্তিটির রেখাচিত্র দেখা মাত্রই দর্শক বুঝতে সক্ষম যে তিনি কোন পেশার মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধে মতো সাম্প্রতিক বিষয় নিয়েও তিনি চিত্র নির্মাণ করেছেন । এমনকি সুদূর প্যালেস্টাইন ভ্রমনে গিয়ে তিনি সেখান মানুষের দুঃখ দুর্দশার চিত্র অংকন করেছেন। স্প্যানীশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়ার (১৭৪৬ -১৮২৮) মতো তিনি সমাজের অন্যায় অত্যাচারের কথা তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন।

শিল্পী জয়নুলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বাংলাদেশে শিল্পকলা শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যে সুবিধা তিনি নিজ দেশে থাকতে পাননি। এটা বলা বাহুল্য যে, তখন বাংলাদেশে শিল্পকলা শিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না । ১৯৪৮ সালে প্রথম তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আজকের চারুকলা অনুষদের প্রথম রূপ। তিনি সময়টা তাঁর খ্যাতি অর্জনের পেছনে ব্যয় করতে পারতেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো তিনি শিল্পকলা চর্চার মধ্যে  সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তাঁর সমাজের মানুষ এবং দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছেন। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে জয়নুল বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিজের পেশাগত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালে,  সোনারগাঁতে গড়ে তোলেন বাংলাদেশের লোক শিল্প যাদুঘর । যা ছিলো  তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন , এই সব অবদান তাঁকে আরো বেশী করে একজন আধুনিক সভ্য সমাজের অনুকরণীয় একজন মানুষ করে তোলে।

শিল্পী জয়নুল আবেদিনের রাজনৈতিক সচেতননা, তাঁর আত্ম পরিচয়ের অনুসন্ধানের পরিক্রমার প্রতিবন্ধকতা তাঁর চলার পথে যেমন বাধার সৃষ্টি করেছে তেমনি তাঁকে অসীম সাহসও যুগিয়েছে। তাঁর পরিচয় ছিলো বেশ জটিল তিনি ব্রিটিশ উপমহাদেশের পূর্ব বাংলায় জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁর শিক্ষা জীবন কাটে ভারতের কলকাতায় এবং পরবর্তীতে দেশ ভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন, সর্বশেষে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং সব পরিস্থিতিতে তিনি রাজনৈতিক ভাবে ছিলেন সক্রিয় এবং তাঁর অবস্থানও ছিলো স্বচ্ছ এবং সৎ। শিল্পী  দিয়েগো রিভেরার (১৮৮৬-১৯৫৭) এবং শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর (১৯০৭-১৯৫৪)  সাথে এক্ষেত্রে সদৃশতা মেলে। যারা কমিউনিজমকে কেন্দ্র করে শিল্পচর্চা করেছেন এবং প্রচলিত ধারার পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন।

জয়নুলের কাজে যে শিশু সুলভ সরলতা এবং সততার দেখা মেলে যে কোনো শিল্পপ্রেমিক এই সাদৃশ্যতা খুঁজে পাবেন।  ভ্যান গো এর মতো তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন প্রকৃতির মাধ্যমে, মানুষের মাধ্যমে। ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দিনের শেষে যেমন শুধু এক টুকরো আলু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে, তেমনি জয়নুলের কাজে অসাধারণ ভাবে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দিনের দৃশ্যবলিও। যেখানে তারা একটি আগুনের চারপাশে  ঘিরে বসে  থাকে,  শীতের সন্ধ্যায় একটু উষ্ণতার আশায়। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁর সীমিত ব্রাশ স্ট্রোক এবং জলরঙের আভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন, আগুনের ধোঁয়া , মানুষের জড়ো সড়ো হয়ে বসার ভঙ্গিমা এবং খুঁটিনাটি সব বিষয়াদি। ভ্যান গো এর রেখাচিত্রের মতো জয়নুলের রেখা চিত্রে ফুটে উঠেছে গ্রামের সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার মহাকাব্য।

বাস্তবতা হলো আধুনিকতার পূর্বশর্ত। ফরাসী শিল্পী জ্যাঁ-ফ্রাসোয়া মিলে (১৮১৪-১৮৭৫) অগুস্তাভ কুর্বের (১৮১৯-১৮৭৭) মতো জয়নুল আবেদিন উপমহাদেশের শিল্পকলায় বাস্তবতার জন্ম দিয়ে গেছেন। কর্মরত শ্রমিকদেরকে যারা নিজের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু করেছিলেন সবার আগে। জীবনকে বাস্তব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন যারা। পশ্চিমা শিল্পকলার জগতে আধুনিকতার শুরুটাও হয়েছিলে বাস্তববাদিতা দিয়ে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি আমাদের এই উপমাহদেশেও। কারণ বাস্তবতার দিকে পা দেবার অর্থই হলো আধুনিকতার দিকে পা বাড়ানো।

বাস্তবতার কদর্যতাই আধুনিকতার আয়না:  
ভারতীয় ব্রিটিশ শিল্পকলার ইতিহাসবিদ পার্থ মিত্রও স্বীকার করেছেন যে এখন ভারতীয় শিল্পকলায় যে আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া বইছে সেখানে আনিশ কাপুরের মতো ভারতীয় শিল্পীও নির্দিষ্ট কোনো মানচিত্রের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে রাজি নন। আমাদের আজকের এই সুবাতাসের দরজা যিনি খুলে দিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন আমাদের প্রিয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আধুনিক শিল্পকলার শুরুটা পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে, শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অবদানের সাথে সুস্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের আধুনিক কবিতার  সৃষ্টির সাথে। সাহিত্যের প্রাঙ্গণে কাঁদা মাটি মাখা পথে আমাদের হাটিয়েছেন যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তেমনি শিল্পকলার পথে জয়নুল আবেদিন।  যদিও খুব দৃঢ়ভাবে বলা সম্ভব না যে, সর্বত্রই তিনি আধুনিকতার আলো ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সফলতার সাথে। ব্যর্থতার দায়ভার তাঁর একার নয় অবশ্যই । সে দায়ভার আমাদের সমাজের ঘাড়ে যেমন বর্তায় তেমন প্রতিটি শিল্পীর কাঁধেও।

জয়নুল আবেদিনের শেষের দিকের  কাজে কিছুটা কিউবিস্ট বা পিকাসোর বা জাতিয়তাবোধের প্রকাশ থাকলেও তিনি বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্রকে, বিশ্বের শিল্পকলা দেখবার জন্য দিয়েছেন ছোট্টো একটি জানালা । তিনি আধুনিকতা শব্দটির সাথে শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন শিল্প হলো এমন একটি ভাষা, যে ভাষা, দেশ, জাতি, সমাজ, ধর্ম সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে একজন মানুষের একান্ত নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ করবার একটি মাধ্যম মাত্র।  সে তাঁর চারিদিকের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তাঁর ভাষায় অভিব্যক্ত করে গেছেন। রেখে গেছেন ইতিহাস আমাদের মতো নতুন প্রজন্মের জন্য।  একজন শিল্পী শুধু শিল্পকর্মেই আধুনিক হবেন না, হবেন তার জীবন যাপনে, কারণ জীবন যাপনই একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম । ব্রিটিশ শিল্প সামলোচক ও ইতিহাসবিদ গমব্রিখের ভাষায়,  শিল্পীই মুখ্য, শিল্পকর্ম নয়।

পরিশেষে:
আমরা জেনেছি যে, অজন্তার দেয়াল থেকে নিয়ে কোনো কোনো শিল্পী কল্পনাপ্রবণতাকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলেন। সেখান থেকে তারা পৌরাণিক কাহিনী চিত্রণের জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কিন্তু অজন্তার দেয়ালের ৯ ও ১০ নম্বর গুহার চিত্রে  বর্ণিত বাস্তব জীবনের রেখাচিত্রেরও চিহ্ন মেলে। যার শুরুটা হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ বা প্রথম শতাব্দীর শুরুর দিকে। সেখানে দেখা যায় ভারানসির রাজার শিকারের দৃশ্য। সেই একি গুহাচিত্র থেকে জয়নুল ছেঁকে তুলে নিয়েছে বাস্তবতার নির্যাস টুকু। এবং এখানেই তাঁর বুদ্ধিবাদিতার প্রকাশ। আমার বক্তব্যের মূল সূর হচ্ছে, জয়নুল আবেদিন ছিলেন উপমহাদরে প্রথম পেশাদারি শিল্পী যিনি শিল্পকলার আধুনিকতা বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং নানা ভাবে তাঁর বহুমুখী কাজের মাধ্যমে তিনি  তাঁর আধুনিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আধুনিক শিল্পকলার চর্চার জন্য আমাদের প্রয়োজন আগে একটি আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা, কুসংস্কার মুক্ত, আত্মবিশ্বাসী এক সমাজ যেখানে মানুষ আত্মপরিচয়ে পরিচিত হবে, নিজের নিজস্বতাকে সাবলীল ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে তার কাজে, শিল্পকর্মে বা সাহিত্যে। আমার মনে হয়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই জায়গাাটতে সফল হয়েছিলেন। তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে আধুনিক হবার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো একজন সৎ মানুষ হওয়া। সৎ হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রমী এবং আত্মসচেতন হওয়াটাও কতটুকু জরুরী। প্রতিভাবান হওয়াটাই্ শেষ কথা নয়। একজন কিংবদন্তী হবার জন্য নিজের যোগ্যতা তিনি প্রমাণ করে গেছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে।



লেখক: চিত্রশিল্পী
টরোন্টো, ২০১৬


*নামকরণ করা হয়েছে কেনেথ ক্লার্কের সিভিলাইজেশন থেকে।
ফেসবুক এ্যালবামের লিংক:
https://www.facebook.com/Meetasultana/media_set?set=a.10154454136058136.1073741930.747803135&type=3&pnref=story
https://www.facebook.com/Meetasultana/media_set?set=a.10154454126888136.1073741929.747803135&type=3&pnref=story
তথ্যসূত্র:
ওয়েজ অব সিইং, জন বার্জার (অনুবাদ: আসমা সুলতানা এবং কাজী মাহবুব হাসান)
সিভিলাইজেশন, কেনেথ ক্লার্ক (অনুবাদ: আসমা সুলতানা এবং কাজী মাহবুব হাসান)
জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা: বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
ছবি কাকে বলে: অশোক মিত্র
ভারতের চিত্রকলা: অশোক মিত্র
দি মিনিং অব আর্ট: হারবার্ট রিড (অনুবাদ : সন্দীপন ভট্টাচার্য )
বাংলাদেশের চিত্রকলা: মইন্নুদীন খালেদ
সমকালীন শিল্প ও শিল্পী: নজরুল ইসলাম
Gardner's Art through the Age: The Non western Perspective
Shock of the New: Robert Hughes
Master drawing: The Woodner collection  
Indian Art: Partha Mitter
The Triumph of Modernism: India’s artists and the avant garde – 1922-1947: Partha Mitter
Modernism and the Art of Muslim South Asia: Iftikhar Dadi
This is Modern Art:
The Story of Art:  Gombrich
Very Short Introductions of Modern Art:  David Cottington
The Social History of Art Vol 4 - Naturalism, Impressionism, the Film Age
লিংক:
http://parthamitter.com/books.html
https://www.youtube.com/watch?v=S2nM3GeFk6k
http://inventors.about.com/od/pstartinventions/a/stilphotography.htm
 http://www.theartstory.org/definition-modern-art.htm
http://www.tate.org.uk/learn/online-resources/glossary/m/modernism

আপনার মন্তব্য

আলোচিত